অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বিরোধী রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও বিশিষ্টজনসহ জনমতকে উপেক্ষা করেই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও তৎকালীন বিএনপি সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত কে এম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। নুরুল হুদা সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তাকে নিয়ে যে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নবনিয়োগপ্রাপ্ত কোনো প্রধান নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে এত বিতর্ক উঠেনি। এসব বিতর্কের মূল কারণ হল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে নুরুল হুদার ঘনিষ্ঠতা। আর তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নির্বাচিত একজন সম্পাদক ছিলেন।
জানা গেছে, প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এখনও মেনে নিতে পারছে না। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যেই নুরুল হুদাসহ পছন্দের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে বলেও বিএনপির অভিযোগ। বলা যায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে চলা বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যে তিনি আবার বিতর্কিত ইভিএম পদ্ধতিকে সামনে এনে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করলেন।
গত নভেম্বরে রাষ্ট্রপতির সংলাপের সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিন সংসদেও এনিয়ে আলোচনা করেছেন। তখন বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিকদলগুলো এটাকে ভোট চুরি করতে সরকারের ডিজিটাল ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দিয়েছে। বেশ কিছুদিন এনিয়ে আর কোনো কথাবার্তা হয়নি। হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশন এটাকে আবার সামনে নিয়ে এসেছেন। এনিয়ে শুরু হয়েছে আবার বিতর্ক।
জানা গেছে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এটা এখন সারা বিশ্বেই একটা বিতর্কিত পদ্ধতি। এটা এখন চুন খেয়ে দই খাওয়ার মতো হয়েছে। যেসব দেশে এ পদ্ধতিটা একবার ব্যবহার হয়েছে তারা এখন আর এটার নামও শুনতে পারে না। আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ড. অ্যালেক্স হালডারমেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছিলেন, আমেরিকায় ইভিএম টেম্পারপ্রুফ নয়। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকায় ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোতেও তা নিষিদ্ধ হওয়ার পথে। পৃথিবীর শতকরা ৯০ ভাগ দেশে ই-ভোটিং পদ্ধতি নেই। যে কয়েকটি দেশ এটি চালু করেছিল তারাও এখন এটি নিষিদ্ধ করেছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল ভোট ইভিএমকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট ৩টি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করে। নেদারল্যান্ডে ই-ভোটিং কার্যক্রমের প্রয়োগ হয়। তবে, জনগণের আপত্তির মুখে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় ডাচ সরকার।
আমাদের পাশবর্তী দেশ ভারতেও ইভিএম নিয়ে নানা বিতর্ক শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অভিযোগ করছে ইভিএম এ ভোট জালিয়াতির সুযোগ রয়েছে। সদ্য সমাপ্ত উত্তরপ্রদেশের ভোটে ইভিএম -এ ব্যাপক কারচুপি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। তাদের অভিযোগ ইভিএম যন্ত্রগুলিতে বড় ধরণের কারচুপি করা হয়েছে, যার ফলে শুধু বিজেপি’র দিকেই ভোট চলে গেছে। অন্য দলকে ভোট দিলেও সেগুলো বিজেপি’র দিকে চলে গেছে বলে তাদের অভিযোগ।
অপরদিকে, বাংলাদেশে ২০১০ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির মুখে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কেন্দ্রে ইভিএমের কারিগরি ক্রটি ধরা পড়ে। এ নিয়ে মামলাও হয়। ইভিএম নিয়ে সবচেয়ে বেশি জটিলতা হয় ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। জটিলতার কারণে ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে পুনরায় নির্বাচন আয়োজন করতে হয়েছিল ইসিকে। এরপর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও একটি কেন্দ্রে ইভিএম বিকল হয়ে যায়। এসব কারণে ২০১৩ সালের পর থেকে আর কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়নি।
এখন নাম পরিবর্তন করে ডিজিটাল ভোটিং মেশিন বা ডিভিএম নাম দিয়ে এটা নিয়ে আবার মাঠে নেমেছেন বিতর্কিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা। বিতর্কিত ইভিএম পদ্ধতিকে সামনে নিয়ে আসায় এনিয়ে বিশিষ্টজনসহ সচেতন মানুষের মনে নানা সন্দেহ-সংশয় দেখা দিয়েছে। সরকারের ইশারাতেই নুরুল হুদা এটাকে আবার আলোচনায় এনেছেন বলেও মনে করছেন তারা।
কেউ কেউ বলছেন, এই ডিভিএম পদ্ধতির চিন্তা প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়ের মাথা থেকে এসেছে। নির্বাচনের দিন ডিভিএম মেশিন বাংলাদেশে থাকলেও এর নিয়ন্ত্রণের চাবিকাটি থাকবে যুক্তরাষ্ট্রে। মানুষ ভোট দেবে ধানের শীষে আর ব্যালটে ছাপ পড়বে নৌকা প্রতীকে।
Discussion about this post