হামিদ বিশ্বাস
সরকারি পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা ক্রমেই প্রকট হয়ে পড়েছে। এসব ব্যাংক ঋণের মান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় পুরো হোঁচট খেয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো নিজের মূলধন তো হারিয়েছেই, উপরন্তু সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে। ব্যবসার পরিবর্তে এসব ব্যাংক এখন মূলধন জোগান নিয়েই চিন্তিত। ইতিমধ্যে মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। কারণ ঘাটতিতে থাকায় এসব ব্যাংক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে।
ব্যাংক ৫টি হল- সোনালী, রূপালী, বেসিক, কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এর মধ্যে সোনালী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক ঋণের মান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রসঙ্গত, মুনাফার অংশ থেকে ব্যাংকগুলোকে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর খেলাপি বাড়লে মান অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে হয়। সে কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। আর বাস্তবতা হল, এভাবে একদিকে জনগণের জমানো টাকা ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ হিসেবে দেয়া হচ্ছে একশ্রেণীর মাফিয়ার হাতে, যা আদায়ও করতে পারছে না। বিপরীতে সরকারের তহবিল থেকে টাকা নিয়ে মূলধন ঘাটতি মেটাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সরকারি ব্যাংকগুলো। এ টাকাও জনগণের ট্যাক্সের টাকা। অথচ জড়িতদের কারও কিছুই হচ্ছে না। মাঝখানে কৌশলে জনগণের পকেট কাটা হচ্ছে। তাই যতদিন ব্যাংকিং সেক্টরের এসব ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিচার না হবে, ততদিন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও ঋণ অবলোপন বাড়তেই থাকবে। অভিযোগ আছে, সরকারি দলের প্রভাবশালীরা এসব ঋণ অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। সে কারণে সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোর খারাপ ঋণের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। কাদের ঋণ দেয়া হচ্ছে, এসব সঠিকভাবে দেখতে হবে। যারা ঋণ পরিশোধ করছেন না তাদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, যেসব ঋণ নিয়ে মামলা রয়েছে, তা নিষ্পত্তির জন্য জোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক, অ্যাটর্নি জেনারেল ও প্রধান বিচারপতি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে পারেন।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৬ সাল শেষে সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকে ঘাটতি হয়েছে ২ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা ও রূপালী ব্যাংকের ৭১৪ কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৮৩ কোটি টাকা ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ৭৪২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে পাঁচ ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়. সরকারি ব্যাংকগুলোকে ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেট থেকে ৩৪১ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৪১ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেয় সরকার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা জোগান দিলেও চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো চেয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
এর মূল কারণ হিসেবে জানা যায়, গত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে তিন ব্যাংকে। এগুলো হল- সোনালী, বেসিক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।
সূত্র জানায়, ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভালো হিসেবে স্বীকৃত ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। এরপর থেকে নজিরবিহীন লুটপাটের শিকার হয় ব্যাংকটি। শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। এরপরই ব্যাংকটি ২ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। যদিও আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে গত তিন বছরে বেসিক ব্যাংককে ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছে সরকার। বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছে নতুন করে আরও ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বন্ড চেয়েছে ব্যাংকটি।
মূলধন ঘাটতির পাশাপাশি ব্যাংকটিতে বেড়েছে খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি। ২০০৯ সালে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করে বেসিক ব্যাংক। ২০১২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকায়। ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। সে বছর নিট লোকসান হয় ৫৩ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ কোটি টাকা। আর ২০১৫ সালে তা ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০১৬ সালে নিট লোকসানের পাল্লা আরও ভারি হয় বেসিক ব্যাংকের। এছাড়া সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ৭ হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ক্ষত আজও শুকায়নি সোনালী ব্যাংকের। সে কারণে মূলধন ঘাটতিতে পড়ে ব্যাংকটি বেহাল অবস্থায় আছে।
এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দেয়া ঋণ আদায় করতে না পেরে সরকারি তিন ব্যাংক ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু ২০১৬ সাল শেষে উল্লেখিত তিন ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এ সময়ে বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে ৪ হাজার ৬৩ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ২৪১ কোটি টাকা।
এ দুরবস্থা প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় গত কয়েক বছর ব্যাংকিং খাত চলেছে তার উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সুতরাং ব্যাংকের মূলধন হারিয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এভাবে মূলধন যাবে আবার মূলধন দেবে। এসব এখন পুরনো ঘটনা। কারণ মূল জায়গায় পরিবর্তন না এলে এটা চলতেই থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, যাচাই-বাছাই না করে দেয়া ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে দেয়া ঋণও আদায় করা যাচ্ছে না। এতে করে এসব ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। আবার মুনাফা না হওয়ায় এ সারির ব্যাংকগুলো সঞ্চিতিও রাখতে পারেনি। এতেই টান পড়ছে মূলধনে।
সূত্র: যুগান্তর
Discussion about this post