গৌতম দাস
কাশেম বিন আবুবাকার নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে মিডিয়ায় মানে, টিভি টকশো নিউজ প্রিন্ট ইলেকট্রনিক বা সোস্যাল মিডিয়া সবখানেই তোলপাড়; এক বহুল উচ্চারিত নাম। তাও শুধু দেশে নয়, প্যারিসভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এএফপির কল্যাণে তা নিয়ে তাদের করা নিউজটা যেসব দেশে স্থানীয় মিডিয়া প্রকাশ করেছে সেসব দেশেও কাশেম বিন আবুবাকারের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কী সে খবর? আবুবাকারের কী খবর? এখানে একটু দম ধরে থামতে হবে।
মূল খবর হলো, বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক কাশেম বিন আবুবাকার ইসলামি মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে উপন্যাস লেখেন। শ’খানেক উপন্যাস লিখেছেন। মডার্নিটি বা আধুনিকতাকে গ্রহণ শুধু নয়, রীতিমতো আলিঙ্গন না করে উপন্যাস লেখা সম্ভব কিনা তা নিয়ে আধুনিক জগতে অনেকের সন্দেহ থাকতে পারে। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে বিচার করলে মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, মডার্নিটিকে পাশ কাটিয়ে সমান্তরালে ইসলামি মরালিটির ওপর দাঁড়িয়ে উপন্যাস লেখা কি সম্ভব নয়? বিশেষ করে যখন ইউরোপের আধুনিকতার যেসব ভিত্তিগত ধারণা ও মূল্যবোধ, সেই মরালিটির ওপর ভর করে সাহিত্য উপন্যাস লেখা ও চর্চার ধারা গড়ে উঠেছে এবং এর প্রভাবে দুনিয়াতে প্রায় সব জায়গায় প্রবল প্রভাব পড়েছে! দুনিয়াতে নানা জায়গায় এর প্রভাব পড়েছে পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শাসক সূত্রে; তাদের আধুনিকতা ও এনলাইটেনমেন্টের চিন্তা ও তৎপরতার প্রভাবে আমাদের মতো দেশে এরই প্রভাবিত ধারা ও এর চর্চা গড়ে উঠেছে। আর সেটাই প্রধান ধারা হওয়ার দাবিতে নিজের আসন পোক্ত করে ফেলেছে! এরপরে আর কি ইসলামি মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে উপন্যাস বা ফিকশন সম্ভব নয়?
এমন বাস্তবতাতেও কাশেম বিন আবুবাকার হলেন সেই লোক যিনি আধুনিকতার ভিত্তিগত ধারণা ও মূল্যবোধের বাইরে সমান্তরালে (যদিও আধুনিকতার প্রভাবের পুরোপুরি বা ঠিক বাইরে নন তিনি ) ইসলামি মরালিটির ওপর দাঁড়িয়ে উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন। নয়া ধারা সৃষ্টি করেছেন। এর চেয়েও বড় কথা তার উপন্যাস আবার যে সে উপন্যাস নয়, একেবারে ৮৫ শতাংশ মূলত রোমান্টিক উপন্যাস। আধুনিক উপন্যাসের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কথা খেয়াল রেখে বললে, আবুবাকার অবশ্যই মনোযোগ পাওয়ার দাবিদার। মনে হতে পারে বা অনেকেই তো অনেক কিছু লেখেন, লিখেছেন, কিন্তু তা হয়তো শেষে ঠাঁই পায় বালিশের তলায়, আবুবাকার কী এই অর্থে রোমান্টিক উপন্যাস লেখক, বলা হচ্ছে? উপন্যাসের সাহিত্য-মূল্য বিচার, এটা সেকুলার মডার্ন জগতেও জটিল, সেটেলড্ নয়। ফলে সে দিকটা উহ্য রেখে বলা যায়- তার লেখার পাঠক আছে কিনা, পাঠকেরা ব্যাপক কিনা, সে পাঠকেরা আবুবাকারের উপন্যাসের সাথে নিজেকে সম্পর্কিত, যেন নিজেরই ঘটনার প্রতিচ্ছবি বলে মনে করেন কিনা, এই বিচারে বলা যায় আবুবাকার একজন ঔপন্যাসিক। তিনি তার পাঠকপ্রিয় এবং প্রধান ধারার ঔপন্যাসিকদের চেয়ে তার পাঠক সংখ্যা বেশি। তবে স্বভাবতই তার পাঠকরা ভিন্ন ক্যাটাগরির যাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি, সামাজিক স্তর ভিত্তি, মূল্যবোধের ভিত্তি ইত্যাদি অনেক কিছু দিয়েই আলাদা করা সম্ভব। আবার যারা প্রধান ধারার পাঠক সেই ক্যাটাগরিরও কিছু অংশ তারও পাঠক। এই বিচারে এক কথায় বলা যায়, আবুবাকার প্রতিষ্ঠিত ঔপন্যাসিক। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘ফুটন্ত গোলাপ’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল আর, ২০১১ সালের খবর হলো ত্রিশতম সংস্করণ প্রকাশিত হলো সেটা। আবুবাকারের দেয়া ধারণা মতে, প্রতি বইয়ের প্রকাশ সংখ্যা ৩০০০-এর কম নয়।
কিন্তু যতগুলো মিডিয়া আলোচনা ও মন্তব্য শোনা জানা বা কাউকে করতে দেখা গিয়েছে তার খুবই নগণ্য সংখ্যক (প্রায় কেউ নয়) দাবি করেছেন বা জানিয়েছেন যে, তিনি আবুবাকারের কোনো উপন্যাস পড়েছেন। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগেই খোদ এএফপির রিপোর্টে এক বিপজ্জনক মন্তব্য আছে। তা থেকে এই রিপোর্ট এখন প্রকাশ করার উদ্দেশ্য কী তা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। বলা হয়েছে, ‘আবুবাকারের (কাজকে এখন নাকি) এক নবজাগরণের বা এক রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তা হলো, যাতে বাংলাদেশের যুগ যুগ ধরে জারি থাকা মডারেট মুসলমান পরিচয় থেকে সে এখন ধর্মীয় কালামের আরো রক্ষণশীল ব্যাখ্যার দিকে ঢলে পড়ছে।’
‘Now his work is undergoing something of a renaissance as Bangladesh slides from the moderate Islam worshipped for generations to a more conservative interpretation of the scriptures.’ এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আবুবাকারের রোমান্টিক উপন্যাসের সাথে সাম্প্রতিককালের হেফাজতের সম্পর্ক আছে এবং এটা নেতিবাচক।
একাত্তর টিভির একটা টকশো হয়েছিল যার শিরোনাম ‘লেখক কাসেম বিন আবুবাকার লাইভে এসে লেখা ও নিজের সম্পর্কে যা বললেন’- এভাবে সেটা ইউটিউবে ২৮ এপ্রিল আপলোড হয়েছে। আলোচনায় প্যানেলে রবীন আহসান, প্রকাশক ও সম্পাদক বই নিউজ ২৪; তিনিই ছিলেন আসলে আবুবাকারের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগকারী, একমাত্র তিনি অভিযোগ তুলছিলেন। এএফপি কী বুঝাতে ওই রিপোর্ট করেছিল তা তার অভিযোগ থেকে আঁচ করা যায়। তবে রবীনের বক্তব্য ছিল একটা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মতো। এএফপির রিপোর্ট ছিল যেন ‘বিদেশীদের ষড়যন্ত্র’ আর তা বলতে চাওয়ার ছলে রবীন আঙুল তুলেছেন আবুবাকারের দিকে। বলছেন, আবুবাকার সেই ‘ষড়যন্ত্র প্রজেক্টে’ শামিল । রবীনের কিছু বক্তব্যের অংশ বিশেষ তুলে ধরছি: ‘তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধ তৈরি করার জন্য উপন্যাস লিখেছেন। আমার যেটা মনে হয়েছে, এটা একটা প্রজেক্টের মতো। আবুবাকার একটা প্রজেক্টের মধ্যে ছিলেন। ত্রিশ বছরে তিনি যা লিখেছেন, এর প্রতিফলন সমাজের মধ্যে পড়েছে। তার উপন্যাসের নাম হচ্ছে ‘বোরখা পরা সেই মেয়েটি’ [ফ্যাক্টস হলো এটা আবুবাকারের লেখা উপন্যাসই নয়]। তার উপন্যাসের ভেতর তার নায়ক-নায়িকারা যেভাবে কথা বলেন এবং বোরখা পরে, হিজাব পরে, এরকম সব চরিত্র হচ্ছে তার উপন্যাস এবং নিজেই যখন বলেছেন ইসলামি মূল্যবোধ তৈরি করার জন্যই তিনি লিখছেন। এজন্য কিন্তু তিনি সফল। মানে বাংলাদেশের যে সমাজ, যে সমাজের মধ্যে আমরা আছি, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এই যে ইসলামি মূল্যবোধ নিয়ে লেখা এবং ইসলামি মূল্যবোধকে সাহিত্যের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে সমাজের মধ্যে প্রয়োগ করা, এতে কিন্তু কাসেম সফল হয়েছেন। তার আজকে যে ঢালাও করে প্রচার প্রপাগান্ডা পশ্চিমা দেশে হয়েছে, সেটার কিন্তু প্রমাণ হচ্ছে যে, হঠাৎ করে নিউজটা হয়েছে যখন কোনো বইমেলা নেই; তখন দেখা যাচ্ছে ইসলামি বই লাখ লাখ বিক্রি হচ্ছে-এই রকম একটা সংবাদ হয়েছে। আমি বলব, সমাজে যখন হেফাজতে ইসলামের একটা গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে, ইসলামি সব দলের একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে এবং এই গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে আবুবাকারের একটা অবদান আছে। এই যে ত্রিশ বছর পর্যন্ত তিনি লিখেছেন যে ইসলামি মূল্যবোধ তৈরি করবেন, ইসলামি নায়ক বানাবেন, নায়িকা বানাবেন, বোরখা পরে চলাচল করবে, আমরা কিন্তু সেটাই সমাজে দেখছি।’
[এই অনুলিপি আমার করা, কাজ চালানোর জন্য। এতে দু-একটা শব্দ এদিক ওদিক হতে পারে। তাই একেবারে সঠিক স্ক্রিপ্টের জন্য মূল ইউটিউব নিজে দেখে নেবেন, অনলাইনে যা পাওয়া যায়।]
এখন মূল কথা হলো, রবীন এখানে আবুবাকারকে অভিযুক্ত করছেন ইসলামি মূল্যবোধ আনা, চর্চা বা জাগানোর চেষ্টা করার জন্য। যদি এটাকে ফ্যাক্টস হিসাবে-একেবারে সত্যি বলে ধরেও নেই, তার পরেও বলতে হয়-ইসলামি মূল্যবোধ জাগানোর চেষ্টা করা কি অন্যায়? অপরাধ? কাউকে বাধা দেয়া যায়? আবুবাকার এখানে ইসলামি এথিক্স মরালিটির কথা বলছেন। একটা মরালিটির চর্চাকে অন্যায় বলবেন কি করে, একে অপরাধ বলবেন কী করে? আবুবাকার কারও কপালে বন্দুক ধরে মূল্যবোধের চর্চার কথা বলছেন না। তিনি এটা করতে আহ্বান রাখছেন প্রবন্ধ লিখেও না- একেবারে রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস লিখে। এটাকেও রবীন আহসান অপরাধ মনে করছেন। ফলে এটাকে এক জাতীয় ইসলামবিদ্বেষ ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ দেখছি না। এটা হতেই পারে যে, তিনি ইসলামি মূল্যবোধ পছন্দ করেন না, তাই তিনি এই মূল্যবোধ গ্রহণ করতে পারেন, এমনকি এর ‘অসুবিধা’র দিক নিয়েও কথা বলতে পারেন। তিনি অবশ্যই ইসলামি মূল্যবোধের চেয়েও ভিন্ন, ভালো এবং কার্যকর মূল্যবোধ নিয়ে এর পক্ষে প্রচার চালাতে পারেন। কিন্তু তিনি এটা ইসলামি হওয়াটাই যেন অপরাধ হিসেবে ধরে নিয়ে কথা বলেছেন।
রবীন আহমদ হেফাজতসহ ইসলামি দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ আনছেন। কোন চিন্তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে গেলে কি কাউকে অভিযুক্ত করা যায়? এটা তো ওই চিন্তা প্রচারকারীদের গৌরব যে, মানুষ তাদের কথা শুনেছে। রবীনের উলটো এটাকে অভিযোগ হিসেবে নেয়া বা অন্যায় মনে করাটা ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করা নয়? এটা আইনি বিচারেও অন্যায় কাজ।
এএফপি যেন আসলে ঠিক রবীনের মতোই সাজেশন রাখতে চেয়েছিল। অভিযুক্ত করতে চাইছিল যে কাসেম বিন আবুবাকার রোমান্টিক উপন্যাস লিখে দোষী। কারণ এতেই ইসলামি দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে, আর যেন ঠিক এ কারণেই হাসিনা হেফাজতের সাথে আপস করেছেন। এটা কাকতালীয় শব্দটার চেয়েও বেশি কাকতালীয় বক্তব্য সন্দেহ নেই। এমনকি ৭১ টিভির ওই টকশোতে অংশগ্রহণকারী ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তকেও রবীন আহসান তার কাকতালীয় দাবি ‘খাওয়াতে’ পারেননি। শ্যামল দত্ত অন ক্যামেরা প্রকাশ্যে তার আপত্তির কথা জানিয়েছেন।
ওদিকে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আরেক তথ্য জানা যাচ্ছে। উপরে এএফপির ইংরেজি উদ্ধৃতি দিয়েছি, যেটা ওই নিউজ উদ্বেগ হিসেবে জানিয়েছিল, একই উদ্ধৃতি আমেরিকান প্রেসিডেন্টের চিফ স্ট্রাটেজিস্ট স্টিভ ব্যাননও তার নিজের ওয়েবসাইটে তুলে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এটা সত্যিই মজাদার ব্যাপার যে, রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাসে লিখে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াকুদেরও উদ্বেগের মুখে ফেলা যায়।
বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান একাডেমিক, গবেষক ও বাংলাদেশ এক্সপার্ট ড. আলী রিয়াজ। তিনি আবুবাকার ইস্যুতে ফেসবুকে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাকে সম্ভাবত এই প্রথম একাডেমিকের ভঙ্গিতে দেখা গেল যে, কোনো ইস্যুতে তিনি সহজে কোনো পক্ষ না নিয়ে একাডেমিক অবজারভারের অবস্থান নিলেন। অবশ্য তার বক্তব্যের বেশ কিছু অংশ ফ্যাক্টস হিসেবে সত্যি নয়।
তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সোস্যাল মিডিয়ায় যারা সক্রিয় তাদের এক বড় অংশ শেষ পর্যন্ত ঔপন্যাসিক কাসেম বিন আবুবাকারকে ‘আবিষ্কার’ করতে সক্ষম হয়েছেন; সে জন্য তারা অবশ্যই পশ্চিমা গণমাধ্যমের, বিশেষত ব্রিটেনের ডেইলি মেইল-এর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন, অবশ্যই এএফপির কাছে। কিন্তু আবিষ্কারের পরে তাদের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই লেখকের বিষয়ে তারা কিছু না জানায় বিস্মিত এবং খানিকটা ক্ষুব্ধ।’
এটা আলী রিয়াজের স্টাটাসের প্রথম দুই বাক্য। কিন্তু … আবুবাকারকে ‘আবিষ্কার’ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে… ‘সে জন্য তারা অবশ্যই পশ্চিমা গণমাধ্যমের, বিশেষত ব্রিটেনের ডেইলি মেইল-এর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন’- এই বাক্যটা ফ্যাক্টস নয়। এটা বরং উলটো। আগে সোস্যাল মিডিয়ায় আবুবাকার ‘আবিষ্কৃত’ হয়েছেন অন্তত গত বছর ডিসেম্বরে। পরে এএফপিতে তিনি রিপোর্টেড হয়েছেন মাত্র সেদিন।
দ্বিতীয়ত আলী রিয়াজ ‘ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডলব্যবস্থার’ আলাপ তুলেছেন। অর্থাৎ এএফপির মতো কাকতালীয় উদ্বেগ জানাতে যাননি ঠিকই, তবে একাডেমিকভাবে আর খুবই নরমভাবে প্রায় একই কথা বলছেন। ‘জনপরিমণ্ডল’ খুবই খটমটে শব্দ সারকথায়, তিনি বলছেন, বাংলাদেশ আরও ইসলামি মূল্যবোধের গভীরে ঢুকে গেলে এর যে সামাজিক প্রভাব তৈরি হবে (যা ভালো মন্দ বহু কিছু) এরপর আবার সেগুলোর পরোক্ষ ফলাফলে তা কতটা আমেরিকার বিরুদ্ধে যাবে, সেটা সমাজতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করে বুঝতে হবে। ফলে সরাসরি আবুবাকারের রোমান্টিক উপন্যাস লেখা দেখে আমেরিকার জন্য কেঁদে উদ্বেগে হাহুতাশ করে ওঠা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
তিনি বলছেন, ‘এ ধরনের উপন্যাস জনপরিমণ্ডলের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এ বিষয়ে মনোনিবেশ করা দরকার কাউকে নিন্দা করার (ভিলিফাই অর্থে) জন্য নয়, বরঞ্চ জনপরিসরের মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো ঘটছে তা বোঝার জন্য।’
এরপরেও তিনি বলেছেন, ‘জনপরিমণ্ডলের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ’- এখানে ‘ইসলামীকরণ’ শব্দের ব্যবহার না করলে ভালো করতেন। যে দেশের ডেমোগ্রাফি মুসলমানের, তাকে ‘ইসলামীকরণ’-এর অভিযোগ করা কি চলে? আর তবুও তিনি যদি অভিযোগ করতেই চান, তবে এতে নন-ইসলামি পশ্চিমা জনগোষ্ঠীর কি দায় ভূমিকা নেই?
সংক্ষেপে আরো কিছু সিরিয়াস স্পষ্ট আপত্তির কথা জানিয়ে রাখা যায়। ঘটনা হলো, কাসেম বিন আবুবাকার মূলত মুসলিম লীগ- এই ধারার প্রডাক্ট বা ফসল। যে অর্থে আমেরিকায় ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয় সে অর্থে মুসলিম লীগ আর আলকায়েদা দুটোই ইসলামি হলেও একই ফেনোমেনা নয়। যেমন আবুবাকার তার গল্পে কোথাও সশস্ত্র পন্থার পক্ষে বলেনি। তা সত্ত্বেও তাকে কি আমরা ইসলামি মূল্যবোধের পক্ষেও কথা বলতে দেব না? তাহলে, এই আমেরিকা নিয়ে আমরা কী করব?
শেষ পয়েন্ট : বলতে গেলে এই চলতি শতকে আবুবাকার আর উপন্যাস লেখেননি। গত শতক ছিল মূলত জাতীয়তাবাদী ইসলামের। আর ইরানি বিপ্লবের অভিজ্ঞতা বাদ রাখলে গত শতকে পোস্ট-কলোনি ইসলাম মূলত জাতীয়তাবাদী ইসলামই; এবং তা ‘প্রডাক্ট অব মডার্নিটি’ অর্থে। অন্যথায় তা আমেরিকার স্ট্রাটেজিক বন্ধু। এর বিপরীতে, একালের আলকায়েদার কোনো অফ প্রডাক্ট অথবা বাই প্রডাক্ট হিসেবেও জাতিবাদী ইসলাম ওটা নয়।
তাহলে আবুবাকারকেও আমেরিকা সহ্য করতে পাচ্ছে না কেন? উদ্বিগ্ন হচ্ছে কেন? আসলে এই সমস্যাটা আমেরিকার, আমাদের না। ফলে বলতেই হয়, এসব উদ্বেগ ভুল জায়গায় ‘নক’ করছে। একটা রোমান্টিক উপন্যাসও সহ্য করতে না পেরে আমেরিকা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে কেন? তাহলে কি আমাদেরই আমেরিকান জনপরিমণ্ডলের দিকে তাকাতে হবে?
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
Discussion about this post