এবনে গোলাম সামাদ
সাধারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইতে এখনো বলা হয়, রাষ্ট্রব্যবস্থার বিভাগ বা অঙ্গ হলো তিনটি। এগুলো হলো : আইন পরিষদ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। কিন্তু এখন অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের লেখক মনে করেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আসলে রাষ্ট্রের বিভাগ বা অঙ্গসংগঠন হলো পাঁচটি। এগুলো হলো : নির্বাচকমণ্ডলী, আইন পরিষদ, শাসন পরিচালনা বিভাগের প্রধান বা মন্ত্রিসভা, রাষ্ট্রের বাঁধাধরা কাজ করার জন্য নিয়োজিত কর্মচারী বা কর্মপরিষদ এবং বিচার বিভাগ। এগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ও সহযোগিতা না থাকলে রাষ্ট্রব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্র সার্বভৌম। কিন্তু গণতন্ত্রে এই সার্বভৌমত্ব আসে নির্বাচকমণ্ডলীর সম্মতি থেকে। গণতন্ত্রে বিচারকমণ্ডলী বিচার করেন আইন অনুসারে। কিন্তু তাদের বিচার ক্ষমতা সীমাহীন হতে পারে না। কেননা তারা এমন রায় দিতে পারেন না যে, দেশে গণবিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। জনমনে সৃষ্টি হতে পারে দারুণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া। গণতন্ত্রে আইনানুগ সার্বভৌমত্বের পাশাপাশি তাই থাকতে হয় লোকায়ত্ত সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি। রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে এসব স্থূল কথা আমার মনে আসছিল একটা বিশেষ কারণে।
সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত হয়েছে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি। গ্রিক দেবী থেমিস ছিলেন আইন ও সুবিচারের দেবী। আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে এই গ্রিক দেবীর ধারণার সুদূর যোগাযোগ নেই। তথাপি কেন এই দেবী মূর্তিকে সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে স্থান দেয়া হলো তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। এ ছাড়া বাংলাদেশ হলো একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। মুসলমানরা পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করে না। তাই মূর্তি স্থাপনে তারা হয়ে উঠেছেন ভয়ঙ্করভাবে ক্ষুব্ধ। তারা চাচ্ছেন মূর্তিটিকে সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গন থেকে সরিয়ে নেয়া হোক। আমার মনে হয় গড়িমসি না করে মূর্তিটিকে সরিয়ে নেয়া হবে প্রজ্ঞার পরিচায়ক। কেননা এতে এ দেশের জনমতকে শ্রদ্ধা দেখানো হবে। স্বীকৃতি দেয়া হবে লোকায়ত্ত সার্বভৌমত্বকে। না হলে নির্বাচকমণ্ডলী ও বিচার বিভাগকে মুখোমুখি করা হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলীকে অবজ্ঞা করে বিচার বিভাগকে সমুন্নত করে রাখা কখনোই সম্ভব হবে না। কেননা, গণতন্ত্রে জনগণের সম্মতিই হলো সব রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতার শেষ উৎস।
বিচার বিভাগকে হতে হবে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। অন্য দিক থেকে বিচার করলে বলতে হবে, সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে থেমিসের মূর্তি স্থাপন আদালতে সিদ্ধান্ত অনুসারে হয়নি, হয়েছে বিচারপতিদের ইচ্ছানুসারে। বিচারপতিদের ইচ্ছার বিরোধিতা করা মানে আদালত অবমাননা করা হয় না। তাই মূর্তিটিকে সরিয়ে ফেললে উঠতে পারে না আদালত অবমাননার প্রশ্ন। কেননা, মূর্তিটি স্থাপন করা হয়নি কোনো বিচারিক রায় অনুসারে।
সব দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসন বিভাগ হলো সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ। শাসন বিভাগকেই নিতে হয় সব ব্যাপারে গুরুতর সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। শাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তাই মূর্তিটিকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু তিনি যেন এ ব্যাপারে কিছু ইতস্তত করছেন, যা জনমনে সৃষ্টি করছে ক্ষুব্ধতা। বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম হলো ইসলাম। বাংলাদেশ একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। এখানে তাই সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন সংবিধানসম্মত হচ্ছে বলে বিবেচিত হতে পারে না। ইসলাম মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী। অনেকে বলছেন, সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে কোনো মূর্তি স্থাপন করা হয়নি। হয়েছে ভাস্কর্য স্থাপন। কিন্তু গ্রিক দেবী থেমিস কোনো ধর্মনিরপেক্ষ ভাস্কর্যের নিদর্শন হতে পারে না। কেননা, এটি হলো দেবী মূর্তি। বিরোধটা দেখা দিতে পারছে সেখানে। থেমিসের মূর্তি বিশুদ্ধ ভাস্কর্যের নিদর্শন নয়। কখনো ছিল না। এটা হলো একটি পৌত্তলিক সংস্কৃতির নিদর্শন। ভাস্কর্যের নামে পৌত্তলিক সংস্কৃতিচর্চা একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে স্বীকৃতি পেতে পারে না। বাংলাদেশেও তাই হতে দেখা যাচ্ছে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।
মানুষ কার মূর্তি গড়বে আর কার মূর্তি ভাঙবে, তা বলা যায় না। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় হয়েছিল বলসেভিক বিপ্লব। এরপর রাশিয়া এবং তার নিয়ন্ত্রিত অঙ্গরাষ্ট্রগুলোয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লেনিনের বহু প্রস্তর মূর্তি। কিন্তু এখন তাদের সবই ভেঙে ফেলা হয়েছে। অবশান ঘটেছে লেনিন-পূজার। রাশিয়ায় ভাস্কর্যের নামে লেনিনের মূর্তিকে সংরক্ষিত করা হয়নি। যদিও লেনিনের অনেক মূর্তিতে ছিল বেশ কিছুটা নান্দনিক আবেদন। কিন্তু সেই আবেদনকে দেয়া হয়নি এবং হচ্ছে না মর্যাদা। কেননা, ব্যক্তিপূজা সৃষ্টি করে মতান্ধতা। মতান্ধতা হয়ে ওঠে গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তার প্রতিবন্ধক।
ইসলামে ব্যক্তিপূজা কোনো দিনই সমর্থিত হয়নি। আল কুরআনে বলা হয়েছে, নবীজী আর পাঁচজন মানুষের মতো একজন মানুষ। নবী-পূজা ইসলামে স্বীকৃত নয়। কথিত আছে, কাবাগৃহে হজরত ঈসার একটি ছবি ছিল দেয়ালে অঙ্কিত। কাবাগৃহের সব মূর্তি ও দেয়ালে অঙ্কিত চিত্রাবলি নষ্ট করে ফেলা হয়। হজরত ঈসার ছবিকেও সংরক্ষিত করা হয় না। আল কুরআনে বলা হয়েছে, সোলেমান নবীর বিরাট রাজপ্রাসাদের খিলানে জ্বিনরা মূর্তি স্থাপন করেছিল সৌন্দর্য বিধানের জন্য (সূরা ৩৪: ১২-১৩)। সৌন্দর্য বিধানের জন্য তাই ইমারতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূর্তি স্থাপন করা চলতে পারে। কিন্তু তা স্থাপিত হতে হবে কেবলই নান্দনিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য; পূজার জন্য নয়। তার সঙ্গে থাকতে পারবে না কোনো পূজার মনোভাব।
ভাস্কর্য আর মূর্তি সমার্থক নয়। ভাস্কর্যের লক্ষ্য কেবলই নন্দন পরিবেশ সৃষ্টি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে যে মূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছে তার লক্ষ্য কেবলই নান্দনিকতা বৃদ্ধি নয়, তা হলো আইন ও সুবিচারের প্রতীক। ইসলামে প্রতীকচর্চা নিষিদ্ধ। প্রতীক ও ভাস্কর্য সমার্থক নয়। ইসলামি শিল্পচর্চার লক্ষ্য হয়েছে কেবলই সৌন্দর্যচর্চা। আর এক কথায় ইসলামে শিল্পবস্তু নির্মাণের লক্ষ্য হয়েছে মানবজীবনে চারুতার মাত্রা বৃদ্ধি। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম আল গাজ্জালি তাঁর ‘এহ্্ইয়া-উল-উলুমুদ্দীন’ বইতে বলেছেন, সব কিছু মানুষের ভালো লাগে না। মানুষ সুগন্ধ পছন্দ করে, পচা গন্ধ নয়। মানুষের ভালো লাগার আছে দৈহিক ভিত্তি। মানুষের এই সহজাত ভালো লাগার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গড়তে হবে শিল্পবস্তু; মানুষের জীবনে চারুতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। ইসলামি শিল্পকলার লক্ষ্য মানবজীবনে চারুতার সম্প্রসারণ। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে প্রতিষ্ঠিত মূর্তিটিকে চারুতার বিচারে অনুপম ধরা যাচ্ছে না। এটি একটি অতি নি¤œমানের শিল্পকর্ম। যেটা সুপ্রিম কোর্টের চত্বরে স্থান পাওয়া উচিত নয়।
যাকে বলা হয় ইসলামি শিল্পকলা, তার চরম প্রকাশ ঘটেছে স্থাপত্যে। সুপ্রিম কোর্টের ইমারত নির্মিত হয়েছে ইসলামি স্থাপত্যের ঐতিহ্য অনুসরণে। এর সম্মুখে ফোয়ারা স্থাপন করা যেতে পারে কিন্তু থেমিসের মূর্তি নয়। থেমিসে মূর্তিটি সুপ্রিম কোর্টের স্থাপত্যের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিসম্পন্ন নয়। এ জন্য এটি অপসারণ বাঞ্ছনীয়; কেবলই ধর্মীয় আদর্শগত কারণে নয়।
আমাদের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বলছেন, বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ যথাযথভাবে কাজ করতে দিচ্ছে না (যুগান্তর: ২৬ এপ্রিল ২০১৭)। কিন্তু তিনি তার বক্তব্যের পেছনে কোথাও দিচ্ছেন না সুনির্দিষ্ট নজির। শাসন বিভাগ ও আইনসভার ক্রিয়াকলাপ থেকে বিচার বিভাগকে কিছু পরিমাণে স্বতন্ত্র করে দেয়া উচিত, যাতে করে বিচার বিভাগ নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে পারে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে সেটা করাও হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতার স্বাতন্ত্র্য বিধান শুধু যে অবাঞ্ছনীয় তাই নয়, বাস্তবে এটা কার্যকর করা অসম্ভব। ফরাসি রাজনৈতিক তাত্ত্বিক মঁতেস্কিয় যেভাবে ক্ষমতার স্বাতন্ত্র্যীকরণ করতে বলেছেন, এ পর্যন্ত তা কোনো দেশেই সম্ভব হয়নি। হওয়ারও নয়। কেননা, তাহলে আইন বিভাগ একটি রাষ্ট্রের মধ্যে হয়ে উঠতে চাইবে আর একটি রাষ্ট্র। ফলে হতে থাকবে ক্ষমতার অপব্যবহার। সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম বিচারপতি আমিনুল হক বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি সরানো হবে কি হবে না, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি (প্রথম আলো: ২৬ এপ্রিল ২০১৭)। কিন্তু প্রধান বিচারপতি কি দেশে মূর্তি নিয়ে একটা হাঙ্গামা বাধলে সেটাকে সামাল দিতে পারবেন, শাসন বিভাগের সহায়তা ছাড়া? তার হাতে বল প্রয়োগের কোনো ক্ষমতা নেই। আইনের পেছনে বল প্রয়োগের ক্ষমতা না থাকলে আইন কার্যকর হয় না।
আন্তর্জাতিক আইন এখনো আইন বলে বিবেচিত হয় না, কেননা এই আইন বলবৎ করার জন্য কোনো বিশেষ শক্তি এখন সৃষ্টি হয়নি। আমার মনে হয় সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে মূর্তিটি না সরালে দেশে একটি গুরুতর হাঙ্গামা হওয়া অসম্ভব নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কেবল মুসলমানরাই নয়, খ্রিষ্টানরাও মূর্তি (ওফড়ষ) ভেঙেছেন। ৭২৬ থেকে ৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যাদের বলা হয় গ্রিক খ্রিষ্টান, তারা করেছিলেন মূর্তি ভাঙার আন্দোলন। এদের বলা হয় আইকোনোক্লাস্ট (ওপড়হড়পষধংঃং)। এরা গির্জায় ঢুকে ঢুকে যিশুখ্রিষ্ট ও মাতা মেরীর মূর্তি ভেঙেছিলেন। কারণ এরা মনে করেন, মূর্তিপূজা মূল খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী। বাংলাদেশের মুসলমানরাও একইভাবে হয়ে উঠতে পারেন পৌত্তলিক সংস্কৃতির বিরোধী। হিন্দুরা নানা দেব-দেবীর মূর্তি গড়ে পূজা করে। কিন্তু তাদের ধর্মেও ভগবানের কোনো মূর্তি গড়ে পূজা করা হয় না। ভগবানকে ভাবা হয় নিরাকার শক্তি, যা হলো সব শক্তির অন্তিম ভিত্তি। নৃতাত্ত্বিকেরা অনেকে মনে করেন, এটা হলো হিন্দু ধর্মের ওপর ইসলামের প্রভাবের ফল। আমরা ধর্মতত্ত্বের জটিল বিতর্কের মধ্যে যেতে চাই না। কিন্তু মনে করি সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে মূর্তি না সরালে দেশে একটা বড় রকমের হাঙ্গামা হতে পারে। তাই গড়িমসি না করে মূর্তিটা সরিয়ে ফেলা উচিত। আর যেহেতু মূর্তিটি স্থাপিত হয়েছে বিচারপতিদের ইচ্ছায়, আদালতের নির্দেশে নয়, তাই প্রধানমন্ত্রী শাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে নিজেই নির্দেশ দিতে পারেন মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার। কারণ, দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব তার।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
Discussion about this post