গোলাম মাওলা রনি
ইদানীং বাংলাদেশে মাদরাসাশিক্ষা নিয়ে মহলবিশেষের বিরূপ মন্তব্য একধরনের ফেৎনা হিসেবে হাজির হয়েছে। যারা বিরূপ মন্তব্য করেন, তারা হয়তো কোনো দিন মাদরাসার আদিঅন্ত নিয়ে চিন্তাভাবনা করেননি অথবা সব কিছু জানা সত্ত্বেও কেবল মাদরাসার বিদ্যার্থীদের হেয়প্রতিপন্ন এবং অপমান করার মানসে ক্রমাগত মিথ্যাচারের বুলি আউড়িয়ে যাচ্ছেন। আজকের নিবন্ধে আমি কারো প্রতি বিষোদগার না করে কেবল মাদরাসার অতীত ইতিহাস, জন্মবৃত্তান্ত এবং ঐতিহ্য বর্ণনা করার চেষ্টা করব ইনশআল্লাহ।
হয়তো জানেন, পৃথিবীর আদি ও অকৃত্রিম ভাষাটির নাম সেমেটিক ভাষা। হজরত নূহ আ: জমানার প্রলয়ঙ্করী বন্যার পর পৃথিবীতে নতুন করে মানববসতি স্থাপিত হয় জাজিরাতুল আরব, উত্তর আফ্রিকা, পারস্য এবং মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূমিতে। নতুন জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সব দিক থেকেই হজরত নূহ আ:-এর ছেলে সাম ইবনে নূহের বংশধরেরা শ্রেষ্ঠতর স্থান দখল করে নেয় এবং অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর ওপর রাজত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করে সেমেটিক গোষ্ঠী নামে। মূলত সাম থেকেই সেমেটিক শব্দটি এসেছে। এই সেমেটিক জাতির হাতেই পৃথিবীর প্রথম সভ্যতাগুলোর সৃষ্টি হয়। আসিরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, মিসরীয় সভ্যতা এবং সর্বশেষ আর্য সভ্যতার বিকাশ সেমেটিক জাতিগোষ্ঠী দিয়েই হয়েছিল।
হজরত আদম আ: থেকে হজরত নূহ আ: পর্যন্ত জমানার ভাষা ও বর্ণমালা সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। তবে সাম ইবনে নূহ আ:-এর বংশধর সেমেটিকদের ভাষাকে পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক এবং আধুনিক ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন মহাকালের সব জ্ঞানীগুণী ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা। সেমেটিক ভাষা থেকেই প্রাচীন দুনিয়ার তাবৎ ভাষার জন্ম হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে হিব্রু, অ্যারামিক, আমহারিফ, তিরিঙ্গা, মাতিসি, আরবি প্রভৃতি ভাষা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবী শাসন করেছিল। সেমেটিক ভাষা থেকে উদ্ভূত ভাষাগুলোর মধ্যে একমাত্র আরবি ভাষাই পাঁচ হাজার বছর ধরে পৃথিবীর একমাত্র আদি ও অকৃত্রিম ভাষা হিসেবে আজ অবধি চালু আছে। আরবি ভাষা থেকে অন্তত ১৫টি ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, বাংলা, আলবেনীয়, বসনিয়ান, তুর্কি, কুর্দি, কাজাখ, মালয়, পশতু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, ইন্দোনেশীয় এবং মালদ্বীপি ভাষার আদি উৎস হলো আরবি।
মাদরাসা শব্দটি সেমেটিক শব্দ দারুস (দাল, র, সিন) যার অর্থ অধ্যয়ন এবং সাফআন, যার অর্থ এমন একটি স্থান যেখানে কিছু একটা করা হয়। সুতরাং মাদরাসার আদি অর্থ হলো সেখানে জ্ঞান আহরণ এবং অধ্যয়ন করা। খ্রিষ্টের জন্মের কয়েক হাজার বছর আগে মানব জাতির প্রথম সভ্যতার সূচনালগ্নে সেমেটিক জাতিগোষ্ঠী নিজেদের শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য শত শত মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন যেখানে ধর্মতত্ত্ব, যুদ্ধবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যামিতি, জোতির্বিদ্যা থেকে শুরু করে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় সব কিছুই শিক্ষা দেয়া হতো। সেইসব মাদরাসা থেকে শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়াররা আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে মিসরের পিরামিড, ব্যাবিলনে ঝুলন্ত বাগান এবং মমি তৈরির কৌশল আবিষ্কার করেছিল যার রহস্য আধুনিক সভ্যতা আজ অবধি উদঘাটন করতে পারেনি। এই মাদরাসা শিক্ষিতরাই আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, পালমিরা, পার্শিনোলিশ সভ্যতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রাচীন বিশ্বে সুয়েজ খাল নির্মাণ করেছিল।
সেমেটিক শব্দ থেকে উৎপত্তি হলেও মাদরাসা শব্দটি মূলত আরবি যার অর্থ শিক্ষালয়। ইসলামের আবির্ভাবের আগেও জাজিরাতুল আরবে বহু মাদরাসা ছিল, যেখানে সমসাময়িক দুনিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই শিক্ষাদান করা হতো। ইসলামের আবির্ভাবের শুরু থেকেই অর্থাৎ রাসূল সা:-এর ওপর ওহি নাজিল হওয়ার পর থেকেই রাসূল সা: নিজে মুসলমানদের জন্য মাদরাসা স্থাপন করেন। হুজুর সা: প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাটি হজরত জায়েদ বিন আকরামের সম্পত্তির ওপর গড়ে উঠেছিল, যার অবস্থান ছিল সাফা পাহাড়ের পাশে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক এটির নাম দিয়েছেন সাফা মাদরাসা। মদিনায় হিজরতের পর মাদরাসটি আগের নামেই নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা হয় মসজিদে নববীর পূর্ব পাশে। রাসূলে আকরাম সা: সাহাবি ওবাদা ইবনে সামিত রা:কে মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
জেনে অবাক হবেন, হুজুর সা: প্রতিষ্ঠিত সাফা মাদরাসায় কুরআন, হাদিস অধ্যয়নের পাশাপাশি আবৃত্তি, আরবীয় গোত্রগুলোর ইতিহাস, প্রাথমিক চিকিৎসার কৌশলটি শিক্ষা দেয়া হতো। এ ছাড়া ঘোড়ায় চড়া, যুদ্ধ কৌশল, হস্তলিখন, ক্যালিগ্রাফি, মল্লযুদ্ধ, কুস্তি, মার্শাল আর্ট প্রভৃতি শিক্ষা দেয়া হতো। নবুয়তের প্রথম দিন থেকে উমাইয়া খিলাফতের প্রথম যমানা পর্যন্ত সাফা মাদরাসা চালু ছিল।
দুনিয়াব্যাপী প্রায় এক হাজার বছরের সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে আরবভূমি, উত্তর আফ্রিকা, আনাতোলিয়া, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপে শিক্ষার নামে যা কিছু হয়েছে তা মাদরাসা থেকেই হয়েছে। এই এক হাজার বছরে পৃথিবীর শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, বিজ্ঞান, স্থাপত্যবিদ্যা, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি অঙ্কশাস্ত্র, ইতিহাস, দর্শনশাস্ত্র এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে তা মাদরাসা ছাত্রদের দিয়েই হয়েছে। স্বল্পবিদ্যার অহঙ্কারী মানুষজন যা-ই বলুন না কেন, তাদের মানসপিতা বলে স্বীকৃত পশ্চিমা অধার্মিক বা বিধর্মী পণ্ডিতেরা কিন্তু অতীতের মহান সব মাদরাসা ছাত্রদেরই তাদের জ্ঞানপিতা বলে সম্মান ও সমীহ করেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে মুসলিম জমানার মাদরাসা সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলে নিই।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম হলো কায়রোয়ান বিশ্ববিদ্যালয় এবং আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠান দু’টি মূলত মাদরাসা ছিল। কায়রোয়ান মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মারাক্কোর ফেজ নগরীতে। ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ফাতিমা আল ফিহরি নামে জনৈক ধনাঢ্য মহিলা তা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বর্তমানে চালু একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যা বর্তমানে বিদ্যমান বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত। এটি শুরু থেকে একটি সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। বর্তমানে যারা মাদরাসার কথা বললে নাক সিঁটকান তারা একবার ভাবুন তো ৮৫৯ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকা, কানাডার অবস্থান কেমন ছিল! ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ওইসব এলাকার বেশির ভাগ মানুষ অসভ্য, বর্বর, বন্য, হিংস্র এবং বিবস্ত্র জীবন যাপন করত। ঠিক সেই সময়টিতেই একটি মাদরাসায় ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে লেখাপড়া করছে এবং তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন মহিলা।
কায়রোয়ান মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ১১৬ বছর পরে অর্থাৎ ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন মিসরে আল আজহার মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় তখনো পশ্চিমা দুনিয়ার অবস্থা আগের মতোই ছিল। সেলজুক সাম্রাজ্যের মহান উজির নিজামুল মুলক প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা-ই নিজামিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৬৫ সালে, যা মধ্যযুগে সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে মশহুর বিশ্ববিদ্যালয় বলে শত শত বছর ধরে স্বীকৃত ছিল। ১০৯১ সালে মহামতি নিজামুল মুলক তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩ বছর বয়সী সর্বকালের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ একজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দান করেন, যার নাম হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবু হামিদ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ আল গাজ্জালী ওরফে ইমাম গাজ্জালী।
স্পেন, ইটালির কিয়দাংশ, ফ্রান্সের কিয়দাংশ এবং সাইপ্রাসে উমাইয়াদের শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত শত শত মাদরাসা ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থার জনক হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। এ ছাড়া ওসমানীয় শাসনাধীন অঞ্চলগুলো ইতালি, সার্বিয়া, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, আলবেনিয়া প্রভৃতি পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাগুলো ইউরোপীয় জাতিকে শিক্ষাদীক্ষায় আধুনিকতার পথে নিয়ে আসে। মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ, বুখারা, ফারগানা, আজারবাইজান, তাজিকিস্তান, কিরঘিস্তান, চেচনিয়াসহ আফগানিস্তানের শত সহস্র মাদরাসা পুরো মধ্যযুগের আলোকবর্তিকা হিসেবে পৃথিবীবাসীকে আধুনিক সভ্যতার দিকে টেনে নিয়ে এসেছে। ভারতবর্ষে সুলতানী আমলে প্রতিষ্ঠিত শত শত মাদরাসার মধ্যে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী প্রতিষ্ঠিত কুতুব কমপ্লেক্স মাদরাসার স্মৃতি আজও অমর হয়ে আছে।
হাজার বছরের ইতিহাসে মাদরাসাগুলো থেকে যে মহামানব সৃষ্টি হয়েছেন, তাদের সমপর্যায়ের একজন ব্যক্তিত্বও পৃথিবীর অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সৃষ্টি হয়নি। অন্য দিকে মাদরাসাশিক্ষিত মহামানবদের বহুমুখী প্রতিভার সাথেও কারো তুলনা হতে পারে না শুধু এরিস্টটল, প্লেটো এবং লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছাড়া। শত শত মাদরাসাশিক্ষিত মুসলিম মনীষী ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, গণিত বিশারদ, রসায়নবিদ, আইনজ্ঞ, কুরআনে হাফেজ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী। ওমর খৈয়াম, হাফিজ, শেখ সাদী, ইবনে সিনা, আলরাজি, ইবনে ফারাবি, মাওলানা রুমী, ইবনে জারীর, ইমাম শাফী, ইমাম আহম্মদ ইবনে হাম্বল, ইমাম গাজ্জালী, ইবনে আরাবি, নাসির উদ্দিন আল তুসী, ইবনে খালদুন, জামি, মুহাম্মাদ ইকবাল, আল কিন্দি, মূসা আল খাওয়ারিজিমি, জাবির ইবনে হাইয়ান প্রমুখ মাদরাসাশিক্ষিত ব্যক্তিত্বের পাশে বসানোর মতো বহুমুখী এবং অমর প্রতিভা আজও জমিনে পয়দা হয়নি।
এখন প্রশ্ন হলো মাদরাসাগুলো থেকে যেভাবে মহামানব তৈরি হয়ে আসেন সেভাবে আধুনিক শিক্ষালয় থেকে বের হয় না কেন? এর একমাত্র কারণ হলোÑ সেই শুরু থেকে আজ অবধি শত প্রতিকূলতা, অপূর্ণতা এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মাদরাসাগুলো কতগুলো মৌলিক চরিত্র বজায় রেখেছে, যা অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চেষ্টা করেও পারেনি। প্রথমত, মাদরাসায় গুরুমুখী বিদ্যাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। অর্থাৎ সেখানে ওস্তাদই সর্বেসর্বা। এই গুরুমুখিতার একটি ধারাবাহিক চেইন অব কমান্ড অনাদিকাল থেকে চমৎকারভাবে চালু রয়েছে। যেমন ইমাম জাফর সাদেকের মাদরাসার ছাত্র ছিলেন ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, আতা ইবনে ওয়াসিল, ইমাম মূসা আল কাজিম প্রমুখ। পরে ইমাম মালেক যে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে ছাত্র হিসেবে ছিলেন ইমাম শাফী। আবার ইমাম শাফী প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার ছাত্র ছিলেন ইমাম আহম্মদ ইবনে হাম্বল।
মাদরাসার ছাত্ররা তাদের কর্মজীবনে যতই প্রতিষ্ঠা লাভ করুন না কেন তারা কোনো দিন তাদের ওস্তাদের অবদানকে অমর্যাদা করার কথা কল্পনাও করেন না। অধিকন্তু তারা তাদের ওস্তাদের ওস্তাদ, কিংবা তার ওস্তাদ এবং ঊর্ধ্বক্রমে অন্যান্য ওস্তাদের অবদানকে রুহানিভাবে মনমস্তিষ্কে ধারণ করেন। তারা স্বভাবত বিনয়ী, কৃতজ্ঞ এবং মানুষ হিসেবে সৎপ্রকৃতির হয়ে থাকেন। তাদের গুণাবলি অর্জনের পেছনে দুটো জিনিস নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। প্রথমটি হলো পবিত্র থাকা যা তারা ওজু, গোসল, মিছওয়াক, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান এবং সুগন্ধী ব্যবহারের ফলে অর্জন করে থাকেন। দ্বিতীয়টি হলো প্রখর স্মরণশক্তি যা তারা পেয়ে থাকেন ইবাদত বন্দেগি, আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর প্রতি নিবিষ্ট, একাগ্র এবং অনুগত থাকার মাধ্যমে। অনেকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন স্মরণশক্তির সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা এবং কৃতজ্ঞতার কী সম্পর্ক! আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে- যারা নিয়মিত দাঁত মাজে, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে তাদের স্মরণশক্তি তুলনামূলক বেশি থাকে। অন্য দিকে বিজ্ঞানের আরেকটি সূত্র হলো প্রবল স্মরণশক্তিসম্পন্ন মানুষ কোনো দিন অকৃতজ্ঞ হতে পারে না বা হয় না।
নাক সিঁটকানো লোকজন এ পর্যায়ে বলতে পারেন- বর্তমানের মাদরাসাশিক্ষায় তো আধুনিক কিছুই শিক্ষা দেয়া হয় না। শুধু কুরআন, হাদিস, তাফসির কিংবা দু-চারটি আরবি, ফারসি কিংবা উর্দু কিতাব পড়লেই কি জীবন চলে! এই বিষয়ে আমার বক্তব্য যদি কাউকে হতাশ করে তবে আমি অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। গতানুগতিক শিক্ষার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমার নিজের জীবন থেকেই দেয়া সম্ভব। আমি জন্ম নিয়েছিলাম ষাটের দশকে বাংলার একটি মধ্যবিত্ত সচ্ছল অথচ খুবই ঐতিহ্যবাহী একটি পরিবারে। ছাত্রজীবনে আমি অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর উৎকৃষ্ট ছাত্র ছিলাম এবং দেশ-বিদেশের সবচেয়ে নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে উত্তম বলে পরিচিত বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছি। এখন আমাকে যদি বলা হয় গোটা পাঁচেক কবিতা, একটি প্রবন্ধ কিংবা অঙ্ক ও জ্যামিতির কয়েকটি সূত্র মুখস্থ বলার জন্য, তাহলে মুহূর্তের মধ্যে আমার মাথার তালু গরম হয়ে যাবে নিজের অপারগতার কারণে। কাজেই যারা উন্নত পরিবেশের বড়াই করেন, তাদের শিক্ষাদীক্ষা আমার চেয়ে কতটা উন্নত তা আমি জানি না।
এবার আপনি যদি আমাকে বাদ দিয়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে আগত, অপুষ্টিতে জর্জরিত এবং কম মেধাবী বলে গালি খাওয়া একজন কুরআনের হাফেজ, একজন মুহাদ্দিস বা একজন মুফতিকে ১০০ পৃষ্ঠার কুরআন শরিফ, ১০০টি হাদিস বা ১০০টি ফতোয়া মুখস্থ বলতে বলেন তবে আমার অহঙ্কারী শিক্ষা এবং মাদরাসা শিক্ষার একটি তুলনামূলক চিত্র পেয়ে যাবেন। যারা আবার বলবেন আরবি পড়ে কী লাভ, কিংবা কুরআন-হাদিস পড়ে কি বুদ্ধিজীবী হওয়া যায়, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি- ময়মনসিংহ অঞ্চলের আঞ্চলিক সাহিত্য ময়মনসিংহ গীতিকা বা প্রাচীন বাংলার দুর্বোধ্য সাহিত্যকর্ম চর্যাপদের চার-পাঁচটি কবিতা পড়ে এবং গবেষণা করে যদি ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হয়ে মহাপণ্ডিত স্বীকৃতি পাওয়া যায় তবে আরশের মালিক আল্লাহর কিতাব পাঠকের কী মর্যাদা হতে পারে তা চিন্তা করার ক্ষমতা না থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য আফসোস ছাড়া আমার পক্ষ থেকে আর কোনো উপহার নেই।
কুরআন ও হাদিসের লাখো কোটি রুহানি ফয়েজ ও বরকতের কথা নয়- কিংবা রাষ্ট্র, সমাজ এবং মানবগোষ্ঠীর বাস্তবভিত্তিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত শত সহস্র ফজিলতের কথা নয়- বরং কুরআন ও হাদিসের ভিন্নতর দু’টি চৌম্বক শক্তির বর্ণনা করে আজকের নিবন্ধ শেষ করব। গত পাঁচ হাজার বছরের আরবি ভাষার ইতিহাসে প্রমিত আরবি ভাষার কথোপকথন, লিখন, আরবি ব্যাকরণ এবং ভাষাটির মানদণ্ডের মাপকাঠি হলো আল কুরআন। গত চৌদ্দ শত বছর ধরে আরবি ভাষার মাননিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র এবং একচ্ছত্র কর্তৃপক্ষের নাম আল কুরআন। পৃথিবীর অন্য কোনো গ্রন্থ পৃথিবীর কোনো ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে কিংবা করেছে বলে ইতিহাসে দ্বিতীয় কোনো নজির নেই।
এবার হাদিস প্রসঙ্গে চুম্বকশক্তি সম্পর্কে বলা যাক। একটি জাতিরাষ্ট্রের সবচেয়ে পবিত্র এবং স্পর্শকাতর গ্রন্থের নাম সংবিধান, যার ভিত্তিতে সেই দেশের অপরাপর আইন কার্যকর অথবা রহিত হয়ে যায়। একটি সংবিধানের মূল শক্তি হলো জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার লিখিত প্রতিচ্ছবি। এই জনগণের সংখ্যা সর্বনি¤œ ১০ হাজার থেকে ১০০ কোটিও হতে পারে। জনতার আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে কেউ সংবিধানের বিরুদ্ধে কথা বলে না। হাদিস প্রসঙ্গে দু’টি কথা সার্বজনীনভাবে বলা যায়, প্রথমত বর্তমান বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলমানের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, নির্ভরতা এবং জীবন-জীবিকার দলিলের নাম হাদিস। দ্বিতীয়ত, হাদিসকে কেন্দ্র করে তাবৎ দুনিয়ায় যে শরিয়াহ আইনের ভিত্তি গড়ে উঠেছে তার সমপর্যায়ের দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি কোনো আইনেই গড়ে ওঠেনি।
নয়াদিগন্ত থেকে
Discussion about this post