সোহরাব হাসান
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিশেষ কর্মকর্তার’ পদ তৈরি করে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই উপাচার্য মীজানুর রহমান ছাত্রলীগের যে ১২ জন নেতাকে নিয়োগ দিয়েছেন, তা বাংলাদেশে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে মডেল বা আদর্শ হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিশেষ কর্মকর্তা পদে ‘বিশেষ’ যোগ্যতা নিয়ে কর্মকর্তারা নিয়োগ পাবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন হলো, নিয়োগের এই অভিনব তত্ত্ব যিনি আবিষ্কার করেছেন, তিনিও বিশেষ যোগ্যতায় নিয়োগ পেয়েছেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে তিনি উপাচার্য পদে আসার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষ ও মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়েছিলেন বিশেষ যোগ্যতা ছাড়াই। এখন যে তিনি বিশেষ যোগ্যতায় চাকরি দিয়েছেন, সেটি যে তাঁর নিজের ইচ্ছেয় নয়, তা-ও স্বীকার করেছেন। বলেছেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাকরি দিতে তিনি বাধ্য। এরপর সম্ভবত বলবেন, বিশেষ যোগ্যতাধারীদের পাস করিয়ে দিতেও তিনি বাধ্য। তাহলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে এত শিক্ষকেরই দরকার পড়ে না।
এর আগে তাঁর পূর্বসূরি মেসবাহউদ্দিন আহমেদ নিয়োগ দিয়েছিলেন ২২ জনকে। সেদিক থেকে মীজানুর রহমান সাহেব একটু পিছিয়ে আছেন। তিনি মেজবাহউদ্দিন আহমদের সমসংখ্যক ছাত্রলীগ কর্মীকে নিয়োগ দিতে না পারলেও সেটি পুষিয়ে দিয়েছেন এ কথা বলে যে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র বা চাকরিপ্রার্থী বলতে কিছু নেই। এখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই চাকরি পাবেন। এটাই তাঁদের বিশেষ যোগ্যতা।’
আমরা জানি না, দেশে এখন এই বিশেষ যোগ্যতার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিবিধিতে সংযুক্ত করা হয়েছে কি না। করা না হলে উপাচার্য মহোদয় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য তা বাধ্যতামূলক করতে পারেন। তাতে সুবিধা হবে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী নন, এমন কেউ চাকরির আবেদনই করবেন না। চাকরিদাতাদেরও অযথা বহুসংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর দরখাস্ত যাচাই-বাছাই করতে হবে না। বিশেষ যোগ্যতা আছে, এমন প্রার্থীদের মধ্যে নিয়োগ দেওয়া সহজ হবে। এখনো দেশে অনেক মানুষ আছেন, যারা মনে করেন, ছাত্রলীগ না করেও হয়তো পড়াশোনার যোগ্যতা দিয়ে চাকরি পাওয়া সম্ভব। উপাচার্য মহোদয়ের এই বার্তার পর তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে হলে বিশেষ যোগ্যতাই একমাত্র যোগ্যতা। সাম্প্রতিককালে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির থেকে শত শত নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তার পেছনেও বিশেষ যোগ্যতা অর্জনের তাগিদ আছে কি না, উপাচার্য মহোদয় জানালে বাধিত হব।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে সৃষ্ট পদটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদন করেনি। অননুমোদিত কোনো পদে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বেতন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যাওয়ার কথা নয়। হয়তো বিশেষ যোগ্যতায় তা-ও পেয়ে যাবেন।
আওয়ামী লীগ একটানা আট বছর ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও অভিযোগ আসে প্রশাসনে অনেক ‘দুষ্টচক্র’ রয়ে গেছে। এ কারণে সরকারের নীতি ও কর্মসূচিগুলো যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। মীজানুর রহমান সাহেবের পথ অনুসরণ করলে সেই সমস্যা থাকবে না। বিশেষ যোগ্যতায় বিশেষভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারবেন। আশা করি, সারা দেশে এখন থেকে নিয়োগের ক্ষেত্রে মীজানুর রহমান মডেল অনুসৃত হবে। তখন ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতি কেউ রুখতে পারবে না।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, গত ১৯ মার্চ উপাচার্যের আগের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক মাস আগে ফেব্রুয়ারিতে অস্থায়ীভাবে ও চুক্তিভিত্তিক এই ১২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ওপর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে। ২০ মার্চ মীজানুর রহমান দ্বিতীয় মেয়াদে আরও চার বছরের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব পান। এর আগে ২০১২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রলীগের ৩১ জন নেতা-কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন।
মীজানুর রহমান বেশ জোরের সঙ্গে বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাকরি দিতে আমি বাধ্য। নিয়োগপ্রাপ্ত ওই ১২ জন কঠোর পরিশ্রমী নেতা-কর্মী ছিলেন। এর মধ্যে দুজন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা। এটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় পরিচয়।’
বিশেষ কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য আনোয়ার হোসাইন ও মিজানুর রহমান; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি দানেশ মিয়া, আরেফিন কাওসার, প্রশান্ত মৃধা, আবদুল্লাহ আল মামুন, এ কে এম কামরুজ্জামান, জিয়াউর রহমান ও আবদুস সালাম; আপ্যায়ন সম্পাদক নুরুল হুদা, শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক আশিকুজ্জামান, কর্মী বিশ্বজিৎ মল্লিক। তাঁরা রেজিস্ট্রার দপ্তরের অধীনে বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। তাঁদের নিয়োগপত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপত্র কথাটি উল্লেখ রয়েছে। তবে কত দিনের জন্য নিয়োগ তা বলা হয়নি।
২০১৩ সালের মার্চে উপাচার্য নিযুক্ত হন মীজানুর রহমান। এর ছয় মাসের মাথায় সেকশন অফিসার গ্রেড-২ পদে চারজন ও স্টোর অফিসার পদে একজনকে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। আবেদন করেছিলেন ছাত্রলীগের ৫০ নেতা-কর্মীসহ ৪৭০ জন। কিন্তু ছাত্রলীগের নয়জনসহ ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্য দুজন ছিলেন উপাচার্যের ‘পছন্দের কোটার’। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসারের (গ্রেড-১) মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীই দুই-তৃতীয়াংশ।
উপাচার্য মহোদয় আরও চার বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন। আশা করি, দ্বিতীয় মেয়াদে এটি শতভাগ পূরণ করতে পারবেন।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post