কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতার কাছে ‘অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়া’ মতিয়ার রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার নয় মাস পরে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তিনি কীভাবে নিয়োগ পেলেন এবং কর্তপক্ষ বিষয়টি সর্ম্পকে জানে কিনা, এ নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে নানা তথ্য।
২০১৬ সালের ২১ জুনের সিন্ডিকেট সভায় মতিয়ার রহমানের নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।একই সভায় তার সঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয় আরও ৭ জন শিক্ষককে।নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে মোট নম্বর এবং বিভাগের অবস্থানে মতিয়ার রহমান সবচেয়ে পিছিয়ে থেকেও নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মতিয়ারকে বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টাও নির্বাচিত করা হয়। পরিসংখ্যান বিভাগের এক শিক্ষকের দাবি, গত ২০ বছরে মতিয়ারের মত এত কম নম্বর নিয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে কেউ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাননি।
প্রভাষক হিসেবে যোগ দেওয়ার আট মাসের মাথায় চলতি বছরের ৩০ মার্চের সিন্ডিকেট সভায় তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মতিয়ার রহমানের ‘অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়া’ একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। যেখানে দেখা যায় তিনি অস্ত্র হাতে অন্য একজনের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এ ঘটনা একাধিক জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হলে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
এ বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের পক্ষ থেকে শিক্ষক মতিয়ারের বক্তব্য জানতে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ থাকার পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে মতিয়ার রহমানের নিয়োগ পাওয়ার এতোদিন পরে খবর প্রকাশিত হওয়ায় আলোচনা সমালোচনা চলছে শিক্ষা অঙ্গনসহ সর্বত্র। শিক্ষক মতিয়ারের অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিয়োগ বোর্ডের কোন সদস্যই জানতেন না বলে চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে দাবি করেছেন তারা।
চ্যানেল আই অনলাইনের অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিসংখ্যান বিভাগের প্রভাষক পদে ওই নিয়োগের সিলেকশন বোর্ডে ছিলেন পাঁচজন। উপ-উপাচার্য(শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত ওই বোর্ডে ছিলেন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ, পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক এমএ জলিল, বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ড. মো: লুৎফর রহমান এবং সিন্ডিকেট মেম্বারদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল। এই পাঁচ সদস্যের প্রত্যেকের সঙ্গে চ্যানেল আই অনলাইন আলাদাভাবে কথা বললে তাদের কেউই মতিয়ার রহমানের ‘অস্ত্র প্রশিক্ষন নেওয়ার ব্যাপারে’ কোন কিছু জানেন না বলে জোর দাবি করেছেন।
উপ-উপাচার্য(শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিন আহমদে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘তার (মতিয়ার) ব্যাপারে যে অভিযোগ, সে সম্পর্কে আমাদের নিয়োগ বোর্ডের কেউ কিছুই জানতেন না। যদি এমন কোন ঘটনা ঘটে থাকে এবং তা যদি আমরা জানতে পারতাম, তাহলে তাকে কি আমরা নিয়োগ দিতাম? কী মনে হয়?’
তিনি বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে, সত্যতা থাকলে ব্যবস্থা নেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’
তবে নিয়োগ পাওয়ার পরও যদি কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আসে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে সত্যতা পেলে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এএসম এম মাকসদ কামাল। যিনি ওই নিয়োগ বোর্ডেরও অন্যতম সদস্য ছিলেন।
অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসদ কামাল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘তার ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন অভিযোগ ছিল না। নিয়োগের সময় কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে, অন্য নিয়োগ প্রার্থীরা উড়োচিঠির মাধ্যমে হলেও আমাদের নজরে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু মতিয়ার রহমানের ব্যাপারে আমাদের কাছে তেমন কোন অভিযোগ আসেনি।’
ছয় পদের বিজ্ঞাপনে নিয়োগ দেওয়া হয় আট জনকে
চ্যানেল আই অনলাইনের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ওই নিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিল ঘেটে দেখা যায়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে মতিয়ার রহমানসহ মোট আট জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই দফায় প্রকাশিত সে বিজ্ঞাপনে মোট খালি পদের সংখ্যা ছিল ৬টি। প্রথম বিজ্ঞাপনে চারটি প্রভাষক পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় যেখানে দুই জন পরিসংখ্যান বিভাগের এবং দুই জন গণিত বিভাগ থেকে নিয়োগের কথা উল্লেখ করা হয়। এ নিয়োগ প্রকাশের পর গণিত বিভাগ থেকে নিয়োগের ব্যাপারে পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে আপত্তি ওঠায় পুনরায় আরও দুই পদের জন্য বিজ্ঞাপণ দেওয়া হয়। দুই বিজ্ঞাপণ অনুসারে মোট খালি পদ ছয়টি থাকলেও নিয়োগ পান আটজন যাদের সবাই পরিসংখ্যান বিভাগের। গণিত বিভাগের প্রার্থীদের সাক্ষাতকার নেওয়া হলেও তাদের কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
নিয়োগ বোর্ডের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ১৯ মে, যে সভায় প্রার্থীদের চূড়ান্ত করা হয়নি। এরপর ওই বছর ৮ জুন সিলেকশন বোর্ডের দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়, সভার পর মতিয়ারসহ মোট সাত জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে বোর্ড। ওই সাতজনের মধ্যে ছিলেন না সিজিপিএ-৩.৯৩ পেয়ে স্নাতকে প্রথম এবং সিজিপিএ-৩.৯৭ পেয়ে স্নাতকোত্তরে দ্বিতীয় হওয়া শাহনাজ নীলিমা।যার ফলাফল সুপারিশপ্রাপ্ত সাত জনের চেয়েই ভালো। পরবর্তীতে ২১ জুন রাতে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভার আগে ওইদিন বিকেলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভা থেকে নীলিমা শাহনাজকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
নিয়োগপ্রাপ্ত আটজন হচ্ছেন, মোঃ মতিয়ার রহমান, মোঃ মোরশেদুর রহমান, শাহনাজ নীলিমা, কামরুন্নাহার কেয়া, কাঞ্জন কুমার সেন, মিরাজুল ইসলাম, নাসরিন সুলতানা এবং মুহম্মদ মাহমুদুল হাসান। এদের মধ্যে শেষোক্ত চারজন ২০১৩ সালের অনার্স এবং ২০১৪ সালের মাস্টার্স ব্যাচের। কামরুন্নাহার কেয়া এবং কাঞ্জন কুমার দে ২০১২ সালের মাস্টার্স এবং ২০১৩ সালের মাস্টার্স ব্যাচের। মোরশেদুর রহমান ২০১১ সালের মাস্টার্স এবং ২০১২ সালের মাস্টার্স ব্যাচের। মতিয়ার ২০০৪ সালে অনার্স এবং ২০০৫ সালে মাস্টার্স পাশ করেন।
ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতাই মতিয়ারের নিয়োগের কারণ?
মতিয়ার রহমান ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন তার সময়কার একজন ছাত্রলীগ নেতা যিনি বর্তমান কমিটির আগের কমিটিতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। পিস্তল হাতে মতিয়ারের যে ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সে ছবিতে তার সঙ্গে আরও ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও বর্তমান বিসিএস ক্যাডার (অর্থনীতি) আজিজুল হক মামুন। যিনি এক সময় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। প্রশিক্ষণদাতা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজিবুল ইসলাম সজিব।
পরিসংখ্যান বিভাগের একাধিক শিক্ষকের দাবি ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার কারণেই মতিয়ারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বশীল সূত্রে চ্যানেল আই অনলাইন জানতে পেরেছে যে মতিয়ার রহমানের নিয়োগের প্রস্তাবক ছিলেন বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক এমএ জলিল এবং তা সমর্থন করেন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ।
২০১৪ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল প্রাঙ্গনে ছাত্রলীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় অধ্যাপক আবদুল আজিজ বলেছিলেন, ‘সব ছাত্রলীগ নেতাকে চাকরি দিতে হবে, রেজাল্টের প্রয়োজন নাই।’ সরকার সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের তখনকার আহ্বায়ক ড. আজিজের এ কথার সঙ্গে ডিন হিসেবে তুলনামূলক খারাপ ফলধারী মতিয়ারের নিয়োগে সমর্থনের যোগসূত্র খুঁজছেন অনেকে।
অধ্যাপক আবদুল আজিজ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এখানে কোন সমর্থনের বিষয় নেই। নিয়োগ বোর্ডের সব সদস্যের সম্মতিতেই তাকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়।
নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে মতিয়ারের নম্বরই সর্বনিম্ন
নিয়োগপ্রাপ্ত আট জনের মধ্যে একমাত্র মতিয়ারই ডিভিশন সিস্টেমের ফলাফল প্রাপ্ত শিক্ষার্থী। বাকি সবাই গ্রেডিং সিস্টেমের, যারা ফল পেয়েছেন সিজিপিএ হিসেবে। ২০০৩-৪ শিক্ষাবর্ষে অনার্স এবং ২০০৪-৫ শিক্ষাবর্ষে মাস্টার্স পরীক্ষায় মতিয়ার যথাক্রমে সপ্তম এবং চতুর্থ স্থান দখল করেন। অনার্সে তার নম্বরের গড় ছিল ৬২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং মাস্টার্সে ছিল ৬৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বর্তমান গ্রেডিং পদ্ধতির স্কেল অনুযায়ী সে নম্বরে তার সিজিপিএ হওয়ার কথা বি+ (৩.২৫)।
বাকী সাত জনের মধ্যে সর্বনিম্ন ফলাফল অর্জনকারী মাহমুদুল হাসান। ২০১৩ সালের স্নাতক পরীক্ষায় যার প্রাপ্ত সিজিপিএ ৩.৬৭। মোট নম্বরের গড়ে তা ৭০ শতাংশের ওপরে যা মতিয়ারের গড় নম্বরের তুলনায় বেশি। মাহমুদুল হাসান আবার মাস্টার্সে দ্বিতীয় হন এবং সিজিপিএ ৩.৯৭ অর্জন করেন। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ৮০ শতাংশ নম্বর।
এ ব্যাপারে পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অবশ্য একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, গড় নম্বর দিয়ে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। কারণ ডিভিশন পদ্ধতির ফলে যারা ৬০ শতাংশ নম্বর পেত তারাই এখন ৮০ শতাংশ নম্বর পান। আমরা সেভাবেই নম্বর দিয়ে থাকি।’
তাছাড়া শিক্ষক হিসেবে তার অভিজ্ঞতাও তাকে নিয়োগ দেওয়ার অন্যতম কারণ বলে জানান বিভাগের চেয়ারম্যান।
মতিয়ার এর আগে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।
সূত্র: চ্যানেল আই অনলাইন
Discussion about this post