প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘তিস্তায় জল নেই’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১১ সালেও বাংলাদেশ তিস্তা থেকে ৩ থেকে ৫ হাজার কিউসেক পানি পেত। তার আগে আরও বেশি ছিল। প্রশ্ন হলো, ২০১১ সালের পর হঠাৎ করেই কি তিস্তা শুকিয়ে গেছে?
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কয়েকজন পেশাজীবী ও পানি বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, তিস্তায় পানি ঠিকই আছে। কিন্তু সেই পানির ছিটেফোঁটাও বাংলাদেশকে দেওয়া হচ্ছে না, ন্যায্য হিস্যা তো নয়ই। গজলডোবা নামক স্থানে বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে তিস্তার সব পানিই ব্যবহার করছে ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু যেটুকু পানি তিস্তায় থাকুক না কেন, তার হিস্যা বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের হিস্যা তো শূন্য হতে পারে না। যেহেতু নদীটি আছে, পানিও আছে, তাই বাংলাদেশেরও কিছু না কিছু প্রাপ্যও আছে। তাঁর প্রশ্ন, বাংলাদেশ একটুও পানি পাচ্ছে না কেন?
ওই পানি বিশেষজ্ঞের মতে, আসলে বাংলাদেশকে পানি দেওয়া হচ্ছে না। উপরন্তু, চুক্তি সইয়ের বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অজুহাতে অন্যায্যভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, সম্ভবত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবছেন বাংলাদেশকে তিস্তার পানির হিস্যা দিলে তিনি জনপ্রিয়তা হারাবেন। তাই চাইছেন কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে বাদ দিয়েই চুক্তি করুক এবং তাদের ওপর দায় চাপুক। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আরও কতিপয় বিষয়ে দর-কষাকষি করার ক্ষেত্রে তিনি তিস্তার ইস্যুটি ব্যবহার করতে চাইছেন।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তিস্তার বিকল্প হিসেবে যে নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয় খতিয়ে দেখার কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তার মধ্যে ধানসিঁড়ি ও মানসিঁড়ি আঞ্চলিক নদী। অন্যগুলো এমন নতুন কোনো নদী নয়, যা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলোচনা হয়নি বা হচ্ছে না। মমতার উল্লিখিত ওই নদীগুলো বাংলাদেশে ধরলা, দুধকুমার ও জলঢাকা নদ-নদী নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টনের আলোচনায় ধরলা ও দুধকুমার রয়েছে।
অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ধরলা ও দুধকুমার ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দুটি অভিন্ন নদ-নদী হিসেবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এবারের আলোচনায়ও স্থান পেয়েছে। তা ছাড়া অভিন্ন নদ-নদীগুলোর কোনোটিই অন্য আরেকটির বিকল্প হতে পারে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সবগুলো অভিন্ন নদ-নদীর পানির অংশীদার। কাজেই তিস্তার অন্য কোনো বিকল্প দেখানোর সুযোগ নেই। সর্বোপরি তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কারিগরি আলাপ-আলোচনা সব শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন শুধু দুই দেশের সরকারের শীর্ষ রাজনৈতিক পর্যায়ে সই হওয়ার আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা।
এই পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিকল্প প্রস্তাব প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এটা আসল বিষয় থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর একটি নিষ্ফল চেষ্টা। তিস্তার সঙ্গে কোনো আঞ্চলিক নদীকে তার বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করাটা অপ্রত্যাশিত। এটা প্রতিবেশীসুলভ আচরণ নয় বলে মত দেন তিনি।
তিস্তায় পানি নেই কথাটি মোটেই সত্য নয় বলে উল্লেখ করে গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ কিছুটা হলেও তিস্তার পানি পেত। ওই বাঁধ দিয়ে সেটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন তিস্তার সম্পূর্ণ পানিই ভারত ব্যবহার করছে। আন্তদেশীয় নদীর ক্ষেত্রে এটা আইনসম্মত নয়। তিনি বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রায় ২০ বছর ধরে। এর মধ্যে চুক্তি তো হলোই না, পানির প্রবাহও কমাতে কমাতে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হলো। এটা বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই হতাশার বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই হতবাক
তিস্তার পানি বণ্টন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মমতার দেওয়া প্রস্তাবে সে দেশের অনেকেই হতবাক হয়েছেন। কারণ মমতা যেসব নদীর কথা বলেছেন, সেগুলো সবই অভিন্ন নদী। এগুলোর পানি তো বাংলাদেশ পাচ্ছেই।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা, কংগ্রেসের বিধায়ক আবদুল মান্নান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক কোনো চুক্তি করতে গেলে যে মানসিকতার প্রয়োজন তা মমতার নেই। তাঁর জন্য আজ বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি উৎসাহিত হচ্ছে। ভারতবিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে। এসব বিষয় বোঝার ক্ষমতা মমতার নেই। তিনি বলেন, সীমান্ত চুক্তি, ছিটমহল বিনিময় প্রভৃতিতেও মমতা প্রথমে বাধা দিয়েছিলেন।
বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের সাবেক সভাপতি রাহুল সিনহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দ্রুতই তিস্তা চুক্তি সই করব। মোদিজি যে কথা বলেছেন, সেভাবেই তিস্তা সমস্যার সমাধান হবে।’
উল্লেখ্য, তিস্তার উৎপত্তি সিকিমে। সেখান থেকে দার্জিলিং জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সেবক নামক স্থানের কাছে সমতলে পড়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বয়ে বাংলাদেশের রংপুর জেলায় ঢুকেছে।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post