এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ইফেক্টিভ ও জনপ্রিয়, বেশি ব্যবহৃত, কম দামী কিন্তু সর্বাধিক উৎপাদিত এসল্ট রাইফেল হচ্ছে- একে ৪৭। রাশিয়ার সাথে চীনের যখন ভীষণ দোস্তি, সেই সময় রাশিয়ার কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে চীন এই রাইফেলের আরেকটি উন্নত ভার্সন তৈরী করে একে-৫৬। চীনের সাথে আবার ছিল পাকিস্তানের খাতির। সেই সূত্র ধরে গাজীপুরের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে ১৯৬৯ সালে চীনের থেকে লাইসেন্স নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে (তৎকালীন পাকিস্তানে) উৎপাদন শুরু হয় ‘চাইনিজ রাইফেল’ নামে পরিচিত এই অস্ত্র। সেনাবাহিনী সেই সময় থেকেই এই অস্ত্র ব্যবহার করতো।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ভারতের জন্মের পর থেকেই তারা রাশিয়া থেকে মিগ বিমান কিনেছে এবং যৌথভাবে ভারতে উৎপাদন করে ‘উড়ন্ত কফিন’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তারা রাশিয়া থেকে ট্যাংক কিনেছে, সাবমেরিন কিনেছে কিন্তু এসল্ট রাইফেল হিসেবে বরাবরই ভারতের সেনাবাহিনীর প্রিয় ছিল বৃটিশ লি-এনফিল্ড কোম্পানীর তৈরী থ্রি-নট-থ্রি (মার্ক থ্রি) এবং মার্ক ফোর রাইফেল। এই রাইফেল লাইসেন্স নিয়ে ভারত নিজেও তৈরী করতো। ১৯৬২ সালে চীনের সাথে এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে পরপর দুইবার একে-৫৬ রাইফেলের কাছে ভারতীয় রাইফেল খেলনা প্রমানিত হবার পর তারা ঐ লি-এনফিল্ড কোম্পানীরই আরেকটা সেমি অটোমেটিক অস্ত্র তৈরী এবং ব্যবহার করা শুরু করে। সেই অস্ত্রটির নাম এল১এ১ সেলফ লোডিং রাইফেল বা এসএলআর।
এই অস্ত্রটি প্রথম যুদ্ধের ময়দানে পরীক্ষা দিতে নামে ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু চাইনিজ রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিলেও সমস্যা ছিল গুলির সরবরাহ না পাওয়া। ভারতে এই গুলি পাওয়া যেতো না। আবার পুলিশ এবং বিডিআর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল বৃটিশ আমলের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে, যেগুলোর গুলি ভারতের কাছে ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ সময় ভারতে তৈরী সেলফ লোডিং রাইফেলও সরবরাহ করা হয়েছিল। এই রাইফেলগুলোর দুইটা সমস্যা ছিল- প্রথমতঃ অল্প কয়েক রাউন্ড গুলি করার পরই এগুলোর ব্যারেল আগুনের মত গরম হয়ে যেতো; দ্বিতীয়তঃ সেমি অটো মোডে প্রায়শই এই রাইফেলে গুলির খোসা আটকে গিয়ে সমস্যা তৈরী করতো। বলা বাহুল্য, যুদ্ধের মাঠে ব্যারেল ঠাণ্ডা হবার জন্য কিংবা আটকে যাওয়া গুলির খোসা খোলার মত সময় নষ্ট করার সময় পাওয়া যায় না বলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এই অস্ত্রটা মোটেই জনপ্রিয়তা পায়নি। মুক্তিযোদ্ধারা বরং ব্রিটিশ আমলের তৈরী থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলই বেশি পছন্দ করতো।
যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে গাজীপুরের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির মালিকানা এবং চাইনিজ একে-৫৬ রাইফেল তৈরীর প্রযুক্তি হাতে পেলেও ভারতের কাছ থেকে বেশ কিছু এসএলআর কিনতে হলো। সেগুলো এরশাদ আমলের শেষ দিকেও পুলিশকে ব্যবহার করতে দেখেছি। নিজ দেশেই বিশ্বমানের রাইফেল তৈরী হবার পরও কী কারণে সে সময় ভারত থেকে ঐসব এসএলআর কেনা হয়েছিল, সেটা বোঝার মত বুদ্ধি আমার কখনোই ছিল না।
ভারত সাধারণত কখনোই তাদের কোন ভুল স্বীকার করে না। কিন্তু খোদ ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকার স্বাধীনতাকামী জনগোস্টীর হাতে থাকা একে-৪৭ রাইফেলের কাছে বারবার নিজেদের এল১এ১ এসএলআরকে পরাজিত হতে দেখতে লাগলো, এমন কী আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসীরাও যখন একে-৪৭ ব্যবহার করে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে লাগলো, তখন তারা এই রদ্দিমাল বাদ দিয়ে রাশিয়ার লাইসেন্স না নিয়ে এবং কপিরাইট ভঙ্গ করে তাদের নিজেদের প্রযুক্তিতে একে-৪৭ এর ভারতীয় মডেল একে-৭ তৈরী করা শুরু করলো। ২০০৪ সালে একে-৪৭ এর জনক রাশিয়ান জেনারেল কলাশনিকভ যখন ভারত সফর করছিলেন, তখন তিনি বিনা অনুমতিতে তার কপিরাইট করা অস্ত্র উৎপাদনের কারণে প্রকাশ্যেই ভারতের মিডিয়ায় তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
যাই হোক, হালকা অস্ত্র উৎপাদনে এই হচ্ছে ভারতের অবস্থান। ১৯৯৩ সালের পর থেকে তারা যে অস্ত্র তৈরী শুরু করেছে সেই অস্ত্রের উন্নত ভার্সন বাংলাদেশে তৈরী হয় ১৯৬৯ সাল থেকে।
ভারতের তৈরী কোন হালকা অস্ত্র কোথাও রফতানী হয় না। তারপরও বাংলাদেশ কোন কারণে ভারত থেকে ঋণ নিয়ে তাদের ঐসব সাব-স্ট্যান্ডার্ড অস্ত্র কিনবে সেটা আমার মাথায় ঢোকেনি।
অবশ্য আমার মাথায় অনেক কিছুই ঢোকে না। আমার এক বন্ধু ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতি করতো, এখন আওয়ামী লীগ করে। বছর পাঁচ/ছয় আগে তাকে দেখলাম সুন্দরী স্ত্রীকে উপেক্ষা করে এক বৃহন্নলার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ফেসবুকে কবিতা লিখতে। আওয়ামী লীগ করলে বোধ হয় এমনই হতে হয়। ঘরে সুন্দরী স্ত্রী রেখে বৃহন্নলার প্রেম চেয়ে কান্নাকাটি করতে হয়; নিজের দেশে উৎপাদিত রফতানীযোগ্য আন্তর্জাতিক মানের হালকা অস্ত্র রেখে ভারতের সাব-স্ট্যান্ডার্ড হালকা অস্ত্র কেনার জন্য ভারতের কাছ থেকেই সুদে টাকা ধার করতে হয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
Discussion about this post