মীযানুল করীম
গত বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ দেশে দু’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। একটি হচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন, অপরটি সুনামগঞ্জে সংসদের একটি আসনের উপনির্বাচন। তবে দেশের সবার নজর ছিল কুসিক নির্বাচনের দিকে। নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর এটাই তাদের অধীনে প্রথম সিটি নির্বাচন। সংসদীয় উপনির্বাচনটিতে ক্ষমতাসীন দলেরই দুই প্রার্থী (একজন ‘স্বতন্ত্র’ নামে) লড়েছেন এবং বিরোধী দল অংশ নেয়নি। ফলাফল কী হবে, তা আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু কুমিল্লায় বিরোধী দলের লোকই গতবার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং এবারো তিনিই জিতেছেন। এ সরকারের দোর্দণ্ড প্রতাপের আমলে এবং ক্ষমতাসীন দলের মরিয়া প্রয়াসের প্রেক্ষাপটে কুসিক নির্বাচনের ফল কী দাঁড়ায়, তা নিয়ে ছিল আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার দোলাচল।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত শঙ্কার চেয়ে অনেক কম অঘটনের মধ্য দিয়ে কুসিক নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। বিএনপি প্রার্থী ও কুসিকের বিগত (সেই সাথে প্রথম) মেয়র মনিরুল হক সাক্কু প্রায় ১১ হাজার ভোটের ব্যবধানে পুনর্নির্বাচিত হলেন। মিডিয়ার খবর মোতাবেক, মনিরুল হক পেয়েছেন ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৮৫৩ ভোট। সীমা ও সাক্কু আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, ফলাফল যা-ই হোক, মেনে নেবেন।
এ নির্বাচনের ফলাফলের পাশাপাশি প্রভাবশালী আওয়ামী নেতা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমেরও একই ধরনের বক্তব্য এসেছে। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনে জনগণের রায় মেনে নেবো।’ ক্ষমতাসীন মহল বাস্তবে এটা প্রমাণ করলে আর কেউ হেরে গিয়ে স্থূল কিংবা সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ করবেন না বলে আশা করা যায়।
কুমিল্লার নির্বাচনে দুই বড় দল বর্তমান নিয়ম অনুসারে, নিজ নিজ নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। প্রচারণায় বিধি লঙ্ঘনের নজির বেশি ছিল না। অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটাভুটির সময়ে প্রায় ৬৪ শতাংশ ভোটার ব্যালটের মাধ্যমে রায় দিয়েছেন। নারী ভোটার বেশি ছিলেন। ৯০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন। তবুও আওয়ামী লীগের নারী প্রার্থী জিততে পারেননি। বিজয়ী প্রার্থী মনির কুমিল্লা বিএনপির এককালীন নেতা ও সাবেক মন্ত্রী, মরহুম অব: কর্নেল আকবর হোসেনের মামাতো ভাই। আর সীমা হলেন কুমিল্লা আওয়ামী লীগের একজন জাঁদরেল নেতা আফজল খানের মেয়ে। সীমা এর আগে কুসিক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র ছিলেন। নির্বাচিত হয়েছিলেন সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানও। উল্লেখ্য, কুমিল্লায় আফজল খানের সাথে সদরের স্বদলীয় এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের দ্বন্দ্ব সুবিদিত।
এ নির্বাচনে বিজয়ের ব্যাপারে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ তুলনামূলকভাবে বেশি আশাবাদী ছিল। কী কী কারণে এমন প্রত্যাশা, তা-ও সবার সামনে স্পষ্ট। তবুও বিপর্যস্ত বিএনপি তার সন্ত্রস্ত নেতাকর্মীদের নিয়ে বিজয়ী হলো; এর তাৎপর্য কী? এই ফলাফল কার প্রতি আস্থা আর কাদেরই বা প্রত্যাখ্যান, জনগণের এই মনোভাবের কারণ নীতিনির্ধারকেরা যদি অনুধাবনে ব্যর্থ হন, তাহলে ভোটারের হতাশা ও প্রত্যাশা- কোনোটাই গুরুত্ব পাবে না।
এখন নিশ্চয়ই পরাজিত আওয়ামী লীগ কুসিক নির্বাচনে হার এবং জয়ী বিএনপি তার জিতের কারণ নিয়ে আলোচনা করবে। তবে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সাধারণত দলের কোন্দল ও গ্রুপিং, প্রার্থী মনোনয়নে গলদ, নিজেদের মাঝে সমন্বয়হীনতা প্রভৃতি কারণের ওপর নির্বাচনী পরাজয়ের দায় চাপায়। এভাবে আসলে প্রতিপক্ষের জনপ্রিয়তা এবং নিজেদের জনসমর্থন হ্রাসের মতো প্রধান বিষয়কে গৌণ করার প্রয়াস চলে। কুমিল্লার পরাজয়ের ক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর কী, তা নির্মোহভাবে ও বাস্তবতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা উচিত। বেশ ক’টি কেন্দ্রে নৌকা মার্কায় জাল ভোটের তাণ্ডব এবং এই অন্যায়ে পুলিশের বাধা না দেয়ার পরও ১১ হাজার ভোটে ‘সরকারি দল’ কেন হেরে গেল, তা উপলব্ধি করা দরকার।
বিজয়ী বিএনপি কুমিল্লায় জয় লাভ করে আত্মতৃপ্তি পেতে পারে। তাই বলে সামনের নির্বাচনগুলোতেও জেতা কঠিন হবে না মনে করে ঢিলেমি দিলে, অর্থাৎ দল ঢিমেতালে চললে বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। দলটির সমর্থক অসংখ্য, সে তুলনায় কর্মী কম আর সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক ও নিয়ন্ত্রণ বরাবরই অপ্রতুল। এবার কুমিল্লায় বিএনপির বিজয়ের মূল কারণ ভোটারের আস্থা। অপর দিকে, এ সরকারের সময়ে বিরোধী দলের জয় পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ নতুন নির্বাচন কমিশন যত ভালো কথা বলুক, পুলিশ-আমলাসমেত প্রশাসন দলীয়করণের শিকার। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য ইসি তাদের সহযোগিতা কতটা পাবে, তা অনিশ্চিত। কুমিল্লায় সৌভাগ্য, যে কারণেই হোক নির্বাচনী সন্ত্রাস ব্যাপকভাবে হয়নি। কিন্তু আশঙ্কামাফিক তা করা হলে ইসির কি সাধ্য ছিল মোকাবেলার?
যে পত্রিকাটিকে তথ্যমন্ত্রী সংসদে একাধিকবার দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ সেই বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার খবর। কুসিক নির্বাচনের লিড নিউজের মধ্যে ‘প্রকাশ্যে সিল ও প্রিজাইডিং অফিসারের কান্না’ উপশিরোনাম। এর পর উল্লেখ করা হয়, চৌয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা ও নেউরা এমআই উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিল মারতে দেখা যায়। নৌকার ব্যাজ পরা পাঁচ থেকে সাতজনকে প্রতিটি বুথে সিল মারতে দেখা গেছে। কাছাকাছি থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া সিটি কলেজ, মডার্ন স্কুল, শাকতলা, ধোনাইতরি, বিষ্ণুপুরসহ ১০টি কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাই ও সিল মারার ঘটনা ঘটেছে। চৌয়ারা কেন্দ্রে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী শহীদুল ইসলাম ও আবদুর রাজ্জাক পুলিশের কাছে এসব বিষয় নিয়ে অভিযোগ জানান। তবে পুলিশকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। পরে তারা ‘আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে’ কেন্দ্র থেকে চলে যান। নেউরা কেন্দ্রে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নৌকায় গণহারে সিল মারতে দেখা যায়। গণমাধ্যমকর্মীরা যাওয়ার পর তাড়াহুড়া করে ব্যালট সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। এ সময় কিছু ব্যালট এদিক-ওদিক পড়ে যায়।’
পত্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধিদের পাঠানো এই রিপোর্টের পরের প্যারাটিতে জানানো হয়, ‘‘৭ নম্বর ওয়ার্ডের গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রটি হঠাৎ করেই দখল হয়ে যায়। অভিযোগ করা হয়, ‘ওপর থেকে আসা নির্দেশ’ তামিল করতে কেন্দ্রটি হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শূন্য হয়ে পড়ে। আর এ সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকে জোর করে ব্যালট পেপার কেড়ে নিয়ে সিল মারতে থাকেন। এ সময় কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং অফিসার মো: দিদারুল ইসলাম জাল ভোট না দেয়ার জন্য তাদের অনুরোধ করেন। ব্যর্থ হলে তাকে নীরবে কাঁদতে দেখা গেছে। শাকতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রকাশ্যে সিল মারার সময় নাসির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে হাতেনাতে ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে মোবাইল কোর্ট তাকে ছয় মাসের জেল দেন।’’
একই পত্রিকায় এর পর জানানো হয়েছে সিটি কলেজ কেন্দ্রে ব্যালট ছিনিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে ককটেল বিস্ফোরণের খবর। বল্লভপুরেও একটি কেন্দ্রের কাছে বেশ কয়েকটি ককটেল পাওয়া গেছে। সিটি কলেজে ব্যালট পেপার নিয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে এক লোক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। প্রিজাইডিং অফিসার তাকে কানে ধরে ওঠবস করার শাস্তি দিয়েছেন।
কুসিক নির্বাচনে এত যে অঘটন ঘটে গেল প্রকাশ্যে, অতীতের ধারাবাহিকতায় এটা সিইসির দৃষ্টিতে ‘বিচ্ছিন্ন’ ব্যাপার। তাই তার নিজের দাবিকৃত সাফল্যের হার শতকরা ১০০ ভাগ থেকে একটুও কমেনি। অপর দিকে পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘ব্রতী’ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ‘উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও সহিংসতা ও কেন্দ্র দখল বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া নির্বাচনে ভোট কেনাবেচার অভিযোগ এসেছে।’
কুমিল্লার নির্বাচনে এমন দৃশ্য দেখে প্রশ্ন না জেগে পারে না: যদি ক্ষমতার মদদপুষ্ট ব্যক্তিরা ব্যাপকহারে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, ব্যালটে সিল মারা, বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টদের গায়ের জোরে বের করে দেয়া প্রভৃতি অন্যায়-অপকর্ম করতে চাইত, তা প্রতিহত করার সামর্থ্য ও দৃঢ়তা কি প্রশাসনের ছিল? এর জবাব যে নেতিবাচক, তা স্পষ্ট। পুলিশকে গত কয়েক বছরে দলীয়করণের কারণে তাদের যোগ্যতা, নিরপেক্ষতা ও দায়িত্ববোধ কতটা নেমে গেছে, কুসিক নির্বাচনের আলোচ্য ঘটনাগুলোই তার প্রমাণ। নির্বাচনকালে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সব বাহিনী এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকাই আইনগত বাধ্যবাধকতা। অর্থাৎ তখন নির্বাচন কমিশনই পুলিশের ‘ওপরওয়ালা’। কিন্তু পত্রিকার খবরে দেখা যাচ্ছে, গোবিন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে এমন ‘ওপরওয়ালা’র আদেশে পুলিশ দায়িত্ব পালন না করে হঠাৎ সরে পড়েছিল, যাদের মতলব ছিল কেন্দ্র দখল করা। পুলিশের আকস্মিক অন্তর্ধানে সেটা ঘটেও গেছে। ইসি কি এসব ‘ওপরওয়ালা’র ব্যাপারে অনুসন্ধান করে দেখা উচিত নয়? নাকি ‘ওপরের দিকে তাকিয়ে’ এই পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে?
দু-একটি নয়, কুসিকে দশটি কেন্দ্রে ব্যালট ছিনতাই ও সিল দেয়ার ঘটনায় পুলিশ নির্বিকার থাকার খবর উঠেছে পত্রিকায়। বিএনপির দুই প্রার্থী প্রশাসনের ক্ষমতাধর মানুষের কাছে এই সন্ত্রাস-অনিয়মের বিচার না পেয়ে ‘আল্লাহর কাছে বিচার’ চেয়েছেন। কারণ, তিনিই তো সব ক্ষমতার উৎস। আওয়ামী লীগের প্রতিটি পোস্টারেও লেখা থাকে ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান।’ দলটির নেতাকর্মীরা নিজেদের যে নেতার সৈনিক বলে অহরহ দাবি করে থাকেন, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বক্তৃতায় বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর মাইর, দুনিয়ার বাইর।’
গোবিন্দপুর কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা ব্যালট ছিনিয়ে সিল মারার সময় প্রিজাইডিং অফিসার তা না করতে অনুরোধ জানিয়ে ব্যর্থ হন। তখন তাকে বিবেকের তাগিদে কাঁদতে দেখা গেছে। আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্র যেকোনো সময় অসহায় হয়ে পড়তে পারে। সেই অসহায়ত্বের প্রতীক এই কর্মকর্তার নীরব ক্রন্দন। ওই কেন্দ্রে ‘ওপরওয়ালা’র ডাকে পুলিশ সটকে পড়ে ব্যালট ছিনতাই ও সিল মারার সুযোগ করে দিয়েছে। অথচ পুলিশ ইচ্ছা করলে এমন অনভিপ্রেত পরিস্থিতি ঠেকাতে পারে। এরই দৃষ্টান্ত কুসিক নির্বাচনে আরেক কেন্দ্রে সবাই দেখেছেন। শাকতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সিল মারার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একজনকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। মোবাইল কোর্ট তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
কুসিক নির্বাচন অনেকটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় বিজয়ী বিএনপির চেয়েও যেন সিইসি কে এম নুরুল হুদা বেশি খুশি। অবশ্য তার বা ইসির আনন্দিত হওয়ারই কথা। কারণ, গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এই নির্বাচনেও সন্ত্রাস-সহিংসতার আশঙ্কা ছিল। সিইসি এটাকে তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। নতুন ইসির জন্য সত্যিই কুসিক নির্বাচন ছিল এসিড টেস্ট। ক্ষমতাসীন দলের সুমতি হোক বা যে কারণেই হোক প্রথমত, নির্বাচনে তেমন সন্ত্রাস-অনিয়ম হয়নি। দ্বিতীয়ত, প্রধান বিরোধীদলীয় প্রার্থী আবার জিতেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে হারিয়ে। এ অবস্থায় সিইসি ‘শতভাগ’ সাফল্য দাবি করে স্বস্তির সাথে বলেছেন, ‘কুসিক নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি।’ অবশ্য পত্রিকার রিপোর্টমাফিক এ নির্বাচন শতভাগ নিরপেক্ষ থাকতে পারেনি সন্ত্রাস ও অনিয়ম থেকে।
সিইসি নুরুল হুদা সানন্দে বলেছেন, কুসিক নির্বাচনের মাধ্যমে জন-আস্থা অর্জনে শতভাগ সফল হয়েছি। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘ব্রতী’ মনে করে, কুমিল্লার সিটি করপোরেশন নির্বাচন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্রতী বলেছে, নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম এই সিটি নির্বাচন সর্বাঙ্গসুন্দর হয়নি। সিইসি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার কথা জানালেও ব্রতী নিজেদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বলেছে, ব্যালট ছিনতাই ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বেশ কিছু বুথে বিএনপির পোলিং এজেন্ট দেখা যায়নি। কেন্দ্রের বাইরে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পোস্টার দেখা গেছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনকালের পরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট জয় লাভ করেছিল। তখন কোনো কোনো পত্রিকার শিরোনামে নির্বাচনের এই ফলাফল জনগণের ভোটবিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। এবার কুসিক নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আবার মেয়র হওয়ার পর ‘প্রথম আলো’র শিরোনাম ‘কুমিল্লায় নীরব ভোটবিপ্লব।’ উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, এটি বিএনপি সমর্থক পত্রিকা নয়, বরং আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগের সাথেই তাদের সাদৃশ্য রয়েছে।
পত্রিকাটির একজন সিনিয়র সাংবাদিক সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে লিখেছেন, ‘ভোটকেন্দ্রের বাইরের সড়কে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। তুলনায় বিএনপি সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। কিন্তু কেন্দ্রের ভেতরে যে বিভিন্ন বয়স ও পেশার ভোটাররা জড়ো হয়েছিলেন, তারা আগেই ঠিক করে এসেছিলেন, কাকে ভোট দেবেন। ফলে ভোট গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রের বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকেরা জানতেই পারেননি, নির্বাচনী ফলাফল কী হতে যাচ্ছে। অনেক কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্টও ছিলেন না। বিএনপির অনেক সমর্থক গায়ে নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছেন।’
বিরোধী দলের লোকজনের স্বল্প উপস্থিতির কারণ যে প্রতিকূল পরিবেশ, তা সহজেই বোধগম্য। আর পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছলে ধানের শীষে সিল মারার জন্যও নৌকার ব্যাজ লাগাতে হয়, তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
কুসিক নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে অবশ্য হতাশার চেয়ে আশাবাদী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়। এর প্রথম কারণ, কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা সত্ত্বেও নির্বাচনপরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। সন্ত্রাস-সহিংসতা, ভোট ডাকাতি, জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি অনেক কম পরিলক্ষিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন আগের চেয়ে বেশি অংশগ্রহণমূলক (ওহপষঁংরাব) হয়েছে অন্তত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে।
বাংলাদেশের অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, পাতানো সংসদের সাজানো বিরোধী দলকে নয়, সংসদের বাইরে অব্যাহত হেনস্তার শিকার যে বিরোধী দল, তাদেরকেই জনগণ প্রকৃত বিরোধী দল বলে বিশ্বাস করে। এদের নেতৃত্বে আছে বিএনপি। দলটি কুসিক নির্বাচনে অংশ নেয়া জাতির জন্য শুভসংবাদ বৈকি। তা ছাড়া সাম্প্রতিককালের উপজেলা নির্বাচন ও সংসদীয় নির্বাচনের মতো ভোটারখরা ছিল না কুসিকে। এতে ভোটারদের উপস্থিতি রেকর্ড না গড়লেও পরিস্থিতির বিবেচনায় ছিল সন্তোষজনক। তৃতীয়ত, ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী রায় মেনে নেয়ার আগাম ঘোষণা সত্যিই প্রশংসনীয়। এ ঘোষণা নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিস্থিতি বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে। আর এটা তো গণতন্ত্রেরই বৈশিষ্ট্য।
এখন গুরুদায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। শুধু ভালো ভালো কথা কিংবা নিছক তর্জন-গর্জন নয়। মূল লক্ষ্য অর্জনে কমিশনকে একই সাথে সততা, যোগ্যতা, দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। জনগণ আশা করে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন আগের কমিশনের মতো তাদের হতাশ ও ক্ষুব্ধ করবে না।
শেষ কথা, কুমিল্লার সিটি নির্বাচনের রায় সবাই মেনে নিয়েছেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যাতে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব অবাধে পালন করে জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন, তার পথ সুগম করতে হবে। এটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো তথা সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তবে সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়া শুধু দল বা ব্যক্তিবিশেষের হয়রানি নয়, এটা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং জনগণের আস্থার অবমাননা।
গত কয়েক বছরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নগরীর মেয়রদের ‘সাত ঘাটের পানি আর চৌদ্দ শিকের ভাত’ খেতে হয়েছে নোংরা রাজনীতির বলি হয়ে। কারো কারো দুর্গতির আজো অবসান হয়নি। জনগণের আশা, এবার সুমতি হবে ক্ষমতাবানদের এবং দলমত নির্বিশেষে সব জনপ্রতিনিধিই এলাকার উন্নয়ন ও অঙ্গীকার পূরণসহ জনগণের স্বার্থ রক্ষার কাজ করে যাওয়ার পরিবেশ পাবেন।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post