কোন দলের নিবন্ধনের সাথে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের শুধুমাত্র নির্বাচনে অংশগ্রহণ কেন্দ্রীক সংশ্লিষ্টতা ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো সম্পর্ক নাই। নিবন্ধন না থাকলেও এ দেশের যে কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠি সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতি, সভা-সমাবেশ ও মিছিল মিটিং করতে পারবে ( জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। [ সংবিধানের ৩৭ নং ধারা ] )
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল নিয়ে যত কাহিনী:
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশের ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল। আগে এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন সম্পর্কিত একটি রুলের রায়ে এই সংগঠনের নিবন্ধন অবৈধ এবং একে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নতুন সরকার জামায়াতকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৭৫ সালে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর এবং কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৭৭ সালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
এভাবে জামায়াতের উপর নানা রকমের নিষেধ, বাধা, বিপত্তি এসে উপস্থিত হয়েছে দিনের পর দিন। আবার সে আদেশ প্রত্যাহার করাও হয়েছে। ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেয়া হয়। পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। রিটে জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও নির্বাচন কমিশনসহ চারজনকে বিবাদী (রেসপনডেন্ট) করা হয়। তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আরজি জানান।
এ রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো: আবদুল হাইয়ের হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। ছয় সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়। রুলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ (বি) (১) (বি) (২) ও ৯০ (সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়।
জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুইবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুইবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।
২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আবেদনকারীরা এ রুল শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠনের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেন। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ মার্চ আবেদনটি বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠানো হয়। ১০ মার্চ সাংবিধানিক ও আইনের প্রশ্ন জড়িত থাকায় বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে আবেদনটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানোর আদেশ দেন দ্বৈত বেঞ্চ। ওইদিন প্রধান বিচারপতি তিন বিচারপতির সমন্বয়ে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে দেন।
জামায়াতকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।
রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। একইসাথে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করারো অনুমোদন দিয়ে দেন। তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে। ওই আপিল শুনানিতে উদ্যোগ নেন রিটকারী পক্ষ। সে অনুসারে আপিলটি চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি মঙ্গলবার কার্যতালিকায় ওঠে।
এরপর ৩১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চ দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে দেয়া নিবন্ধন অবৈধ বলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সার সংক্ষেপ প্রস্তুত করতে পক্ষদ্বয়কে চূড়ান্তভাবে দুই মাস সময় দেন। ২০১৭ সালের মার্চে জামায়াতের জন্য বরাদ্দ দাঁড়িপাল্লা প্রতীক তালিকা থেকে বাদ দিয়ে গেজেট জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার হাইকোর্ট রায়ের বিরুদ্ধে ‘লিভ টু আপিলের’ ওপর শুনানির জন্য চলতি বছরের ৬ নভেম্বর দিন ধার্য করে আপিল বিভাগ, এরপর পর্যায়ক্রমে ১২ এবং ১৯ নভেম্বর দিন ধার্য করে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
সবশেষে আজ (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল (লিভ টু আপিল) খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এর ফলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকল। জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা ও আদালত অবমাননার অভিযোগের আবেদনের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর ও আইনজীবী আহসানুল করিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এ এম) আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ (এসকে) মোর্শেদ ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মেহেদী হাসান চৌধুরী।
আইনজীবী তানিয়া আমীর বলেছিলেন, আমরা দুটি আবেদন করেছি। একটি হচ্ছে হাইকোর্টের রায় বলবৎ থাকার পরও ১০ বছর পরে জামায়াতে ইসলামী কর্মসূচি পালন করেছে। আরেকটা আদালত অবমাননা। কারণ তারা রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে নিবন্ধন ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করেছেন যেখানে আদালত অবমাননার বিষয় রয়েছে। অথচ হাইকোর্টের রায়ে তাদের নিবন্ধন অবৈধ। চেম্বার কোর্ট আবেদন দুটি গ্রহণ করে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
তাহলে কি জামায়াত রাজনীতি করতে পারবে না?
নিবন্ধন না থাকলেও সংবিধান অনুযায়ী জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে কোনো বাধা নেই। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন প্রয়োজন নির্বাচন করার জন্য, রাজনীতি করার জন্য নয়। দেশে অনেক অনিবন্ধিত দল নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। সুতরাং জামায়াত ইসলামী মিটিং, মিছিল, সভা-সমাবেশ করতে পারবে। শুধুমাত্র দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না। তবে জামায়াত ইসলামীর যে কোনো নেতা বা কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবে।
যে কারনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের ব্যাপারে আবেদন করা হয়েছিল:
জামায়াত তার গঠনতন্ত্রে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে ঘোষণা করেছে। একটি মুসলিম দেশের ইসলামের অনুসারী একটি দল হিসেবে এটি তার ঈমান, আকীদার অংশ। যারা আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মনে করেন না তারা ঈমানদার মুসলমান হতে পারেন না। তিনি সকল মানুষের রব বা প্রভু, সারা জাহানের মালিক ও স্রষ্টা। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা যায় না, তিনি লা-শরীক আল্লাহ। আল্লাহ যেমন আমাদর ব্যক্তিগত জীবনের প্রভু, স্রষ্টা, নিয়ন্ত্রক, সর্বাধিনায়ক এবং সকল ক্ষমতার মালিক তেমনি সামাজিক ও রাষ্ট্রজীবনেরও। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে আমরা ১৫৩ থেকে ১৭০ বার আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করি। এই অবস্থায় জামায়াত তার গঠনতন্ত্রে সকল শক্তির উৎস এবং সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ এই কথা ঘোষণা করে সকল মুসলমানের ঈমান, আকীদার প্রতিধ্বনি ঘটিয়েছে বলেই আমরা মনে করি।
বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষমতার উৎস এবং সার্বভৌমত্বের মালিক জনগণকে বলা হয়েছে। জামায়াত বলেছে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কাঠামোর অধীনেই জনগণের সার্বভৌমত্ব। জামায়াতের এই বিশ্বাসকে ধর্মনিরপেক্ষ ও এদেশের নাস্তিক শক্তি পছন্দ করে না এবং তারা জামায়াতকে সাম্প্রদায়িক দল বলে মনে করে। তাদের এই বিশ্বাস সঠিক নয়। আদালতের রায়ে এই বিষয়টি কিভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা আমি জানি না।
মূলত এই বিষয়টিকেই সংশোধন করতে বলা হয়েছিল জামায়াতকে। জামায়াত ইসলামী সেটি না করার কারনেই এতসব আয়োজন করা হয়েছে জামায়াতের বিরুদ্ধে। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় শুধুমাত্র জামায়াত ইসলামীই একমাত্র আল্লাহর উপর ইমান আনার কথা বলছে! বাকি রাজনৈতিক দলগুলো বা তাদের নেতা কর্মীরা কি এক আল্লাহ, তার একাত্ববাদ, তার তাওহীদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন না? তাদের মুসলমানিত্ব ও ঈমান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
Discussion about this post