বর্তমান ফিলিস্তিন সংকটে ‘আল কাসসাম’ নামটা বেশ আলোচিত হচ্ছে। দখলদার ইসরাঈলের বিরুদ্ধে হামাস লড়াই করে যাচ্ছে। হামাস হলো ফিলিস্তিনের ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সংগঠন। যার পূর্ণরূপ হচ্ছে – ‘হারাকাতু মুকাওয়ামাতিল ইসলামিয়্যাহ’ বা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন। ১৯৮৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন শায়খ আহমদ ইয়াসিন রহ.।
হামাসের সামরিক শাখার নাম আল কাসসাম ব্রিগেড। যার নামে এই নামকরণ তাঁর পূর্ণ নাম হলো ইজ্জউদ্দিন আবদুল কাদির ইবনে মুস্তাফা ইবনে ইউসুফ ইবনে মুহাম্মদ আল-কাসসাম। সংক্ষেপে ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম। হামাসের বহুল আলোচিত রকেটের নামও আল কাসসাম রকেট।
আল কাসসাম প্রকৃত ফিলিস্তিনি নন। তিনি সিরিয়ার মানুষ। তবে ইসরাঈল রাষ্ট্র গঠনের প্রাক্কালে ইহুদীবাদ ও ব্রিটিশদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেন। অবশেষে তিনি শাহদাতবরণ করেন এবং তাঁর প্রচেষ্টা দৃশ্যত ব্যর্থ হয়। কিন্তু প্রকৃতভাবে তিনি ব্যর্থ হন নি। দলমত নির্বিশেষে ফিলিস্তিনের সকল মুসলিম তাঁকে বীর হিসেবে স্মরণ করেন। ফিলিস্তিনীদের মরণপণ সংগ্রামের তিনিই প্রেরণাদাতা।
আল্লাহ যেমন বলেছেন শহীদেরা মরেন না, ঠিক তেমনি আল কাসসাম রহ.-কে বিবেচনা করলে আপনি সেই কথাই প্রমাণ পাবেন। আল কাসসাম রহ. প্রায় ৮৫ পূর্বে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। অথচ তিনি এখনো ফিলিস্তিনী মুসলিমদের জিহাদে উজ্জীবিত করে চলেছেন।
জন্ম ও শিক্ষা দীক্ষা
শহীদ আল-কাসসাম রহ. ১৮৮২ সালে সিরিয়ার উত্তর পশ্চিমে জাবলাহ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার জন্মের সময় এটি ছিল উসমানিয় শাসনের অধীনে। তাঁর বাবা আবদুল কাদির ছিলেন উসমানীয় যুগে শরিয়া আদালতের একজন কর্মকর্তা এবং কাদেরিয়া তরিকার একজন স্থানীয় নেতা। তার দাদা কাদেরিয়া তরিকার একজন প্রধান শাইখ ছিলেন। পারিবারিকভাবে আল কাসসাম কাদেরিয়া তরিকার সুফি হিসেবে গড়ে উঠেন। এরপর তিনি জাবলাহ থেকে ইরাক চলে এসেছিলেন। সেখানে তিনি ইরাকের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করেন।
এরপর ১৯০২ সালে আল-কাসসাম আল-আজহার মসজিদে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে কায়রোতে যান। সেখানে তিনি দেখা পান ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন বিখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত ও আধুনিক ইসলামী সংগঠনের রূপকার জামাল আল দ্বীন আফগানীর প্রধান অনুসারী মুহাম্মদ আবদুহুর সাথে। আল আজহার ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালে আল-কাসসাম রহ. সুফিবাদের সাথে জিহাদী চেতনায় উজ্জীবিত হন।
পেশা ও আন্দোলন
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আলেম হিসেবে জন্মস্থান জাবলাহ ফিরে আসেন এবং একটি কাদেরিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি কাদেরিয়া তরিকা এবং কুরআনের আইনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা শিক্ষা দিতেন। শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি ইবরাহিম ইবনে আদহাম মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জাবলাহতে ফিরে এসে আল-কাসসাম রহ. জামালুদ্দিন আফগানী ধারণা অনুসারে নৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ইসলামি পুনর্জাগরণ কর্মসূচি শুরু করেন। মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও ফরজিয়াত পালনের ব্যাপারে তিনি তাকিদ করেন। নিয়মিত নামাজ ও রোজা পালন এবং জুয়া ও মদ্যপান বন্ধ করাও তার কার্যক্রমের অংশ ছিল। আল-কাসসামের কার্যক্রম জাবলাহতে প্রভাব ফেলে এবং স্থানীয় জনগণ তার সংস্কার গ্রহণ করে। তখন আরবদের মধ্যে গড়ে ওঠা আরব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং উসমানীয় সরকারের প্রতি অনুগত থাকেন। আরব জাতীয়তাবাদ ও ব্রিটিশদের মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তিনি সোচ্চার থাকেন।
১৯১১ সালে ইতালি উসমানিয়দের কাছ থেকে লিবিয়া দখল করলে তিনি এর প্রতিরোধে ভূমিকা রাখেন। তিনি সিরিয়ায় লিবিয়ার যোদ্ধাদের জন্য অর্থ কালেকশন করেন। সামরিক প্রশিক্ষণ আছে এমন স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করে তিনি লিবিয়ায় প্রেরণ করেন।
সিরিয়ায় ফরাসি-বিরোধী প্রতিরোধ
১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আল-কাসসাম রহ. উসমানীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। ১ম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে লড়েন। ফ্রান্স দামেস্ক দখল করে নেয়। যুদ্ধে উসমানীয় সেনাবাহিনী হেরে যায়। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি জাবলাহতে ফিরে আসেন ও জাবলাহ রক্ষার চেষ্টা চালান। উসমানীয় শাসক পরাজয় মেনে নিয়েছে। তাই তারা আল-কাসসাম রহ.-কে সহায়তা করতে পারেনি। তিনি একটি নিজস্ব বাহিনী গঠন করেন।
১৯১৯ সালে ফরাসিরা উত্তর সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে। তাদের সহায়তায় প্রথম ফয়সাল স্বাধীন আরব রাষ্ট্র হিসেবে রাজতান্ত্রিক সিরিয়া প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসময় আল-কাসসামের বাহিনী রাজতন্ত্রের যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাদেরকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়। তবে ফরাসি সৈন্যরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সংহত করার পর আল-কাসসাম বাহিনীর সাথে তীব্র যুদ্ধ হয়। বছরখানেক ধরে তিনি ফরাসিদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ফরাসিদের অব্যাহত বিজয়ে আল-কাসসাম বাহিনী রসদ সংকটে পড়ে যায়। কোণঠাসা হয়ে আল কাসসাম রহ. সিরিয়া ত্যাগ করেন ও ফিলিস্তিনে চলে যান।
ফিলিস্তিনে আল কাসসাম রহ.
সিরিয়াতে বিপর্যন্ত হওয়ার পর আল কাসসাম রহ. প্রথমে লেবাননের বৈরুতে যান পরে সেখান থেকে ফিলিস্তিনের হাইফাতে যান। তার পরিবারও তার সাথে ফিলিস্তিনে এক্ত্র হয়। তিনি ফিলিস্তিনে বসবাস শুরু করেন করেন এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা শুরু করেন। এসময় ফিলিস্তিন ব্রিটেনের অধীনে ছিল। তিনি ফিলিস্তিনি মুসলিমদের মধ্যে বিদআতি ও শিরকি কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করেন। খিজিরের মাজারে সন্তান চাওয়া, নৃত্য ইত্যাদি কুসংস্কার থেকে তাদের সতর্ক করেন। তিনি তাদের সঠিক ইসলামের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেন। তার আকর্ষণীয় বক্তব্যে মানুষ ভুল পথ পরিত্যগ করে।
পাশাপাশি আল-কাসসাম রহ. গরিব মানুষদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।। তিনি শ্রমিকদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন এবং ইমাম হিসেবে প্রথমে জেরিনি মসজিদ ও পরে ইসতিকলাল মসজিদে তাদের শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাদের তিনি রাস্তা, পতিতালয় ও হাশিশের আড্ডায় খোঁজ করতেন। এই গরিব কৃষকরা তাদের জমি ইহুদিদের কাছে বিক্রয় করতো। ইহুদিরা তাদের মাদকে অভ্যস্ত করতো, এবং একসময় মাদকের টাকা যোগাতে তারা জমি বিক্রয় করতো। এভাবে মুসলিম গরিব কৃষকরা উদ্বাস্তু হতে থাকলো।
এভাবে উদ্বাস্তু হয়ে হাইফা আসা ভূমিহীন কৃষকদের মধ্য থেকে অধিকাংশ তাঁর অনুসারী হয়। উত্তর ফিলিস্তিনের দরিদ্র মুসলিমদের মধ্যে আল-কাসসাম দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯২৯ সালে আল-কাসসাম সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল কর্তৃক হাইফার শরিয়া আদালতে বিয়ে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিযুক্ত হন। এই দায়িত্বের কারণে তাকে উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে সফরে যেতে হত। তিনি সেখানকার বাসিন্দাদেরকে কৃষি সমবায় গড়তে উৎসাহিত করেন। তার সফরের সময় তিনি গ্রামবাসীদেরকে তার তেজস্বী বক্তব্যের মাধ্যমে ব্রিটিশ ও ইহুদিদের প্রতিরোধ করতে উৎসাহিত করতেন।
সশস্ত্র সংগ্রাম
১৯৩০ সাল থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আল কাসসাম রহ. সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এর জন্য একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। সাধারণ ফিলিস্তিনি নেতারা জায়নবাদি বসতিস্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু আল-কাসসাম রহ. উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াইকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি নেতা ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের সমর্থক হলেও আল-কাসসাম ফিলিস্তিনের সংঘাতকে ধর্মীয় সংগ্রাম হিসেবে দেখতেন। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন এবং জায়নবাদিদের আধিপত্য উৎখাতের জন্য আল-কাসসাম রহ. নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক জিহাদের পক্ষে ছিলেন।
যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের সময় আল-কাসসাম উন্নত চরিত্রের উপর জোর দিতেন। তাদেরকে অসহায়, অসুস্থদের সেবা, পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এবং নিয়মিত নামাজ পড়তে বলা হত। শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সাহসী যোদ্ধা হতে এসকল গুণের প্রয়োজন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। পরিবার থেকে দূরে থাকা এবং ইসলামে অনৈতিক বলে বিবেচিত কাজে জড়িত থাকার বিরুদ্ধে তিনি কাজ করেছেন। তিনি বিয়েকে তরুণদের নৈতিক অধঃপতন বন্ধের উপায় হিসেবে দেখতেন। অনেক সহায়হীন সমর্থকদের বিয়েতে তিনি খরচ জুগিয়েছেন। জিহাদের প্রতি আত্মোৎসর্গের প্রতীক হিসেবে তিনি পুরুষদের দাড়ি রাখা ও সবসময় সঙ্গে কুরআন রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন।
তিনি ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। তার বাধার ফলে ইহুদিরা বসতি স্থাপনে ব্যর্থ হয়। কিছু স্থান থেকে তারা পালিয়ে যায়। ফলে অবধারিতভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে তার সংঘর্ষ শুরু হয়।
১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আল কাসসাম রহ.-সহ তাঁর কিছু সহকর্মীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। ফলে আল-কাসসাম ও তাঁর বারোজন অনুসারী আত্মগোপনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা জেনিন ও নাবলুসের মধ্যের পাহাড় দিয়ে হাইফা ত্যাগ করেন। শাইখ জাইদের গ্রামে একটি গুহায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আল-কাসসামকে ঘিরে ফেলে। ২০ নভেম্বর এখানে সংঘটিত দীর্ঘ লড়াইয়ে আল-কাসসাম ও তার তিন অনুসারী নিহত হন এবং পাঁচজন বন্দী হন।
জেরিনি মসজিদে আল-কাসসামের জানাজায় প্রচুর মানুষ সমবেত হয়, এদের অধিকাংশ ছিল কৃষক ও শ্রমজীবী। আল-কাসসামের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় হাইফাসহ বেশ কিছু ফিলিস্তিনি ও সিরিয়ান শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। আল-কাসসাম রহ.-কে সাবেক ফিলিস্তিনি গ্রাম বালাদ আল-শাইখে দাফন করা হয়। যা এখন ইসরাঈলের শহর নেশ নামে পরিচিত।
আল কাসসাম রহ.-এর সংগ্রাম এখনো চলমান
আল-কাসসামের আন্দোলনের সদস্যরা “কাসসামিয়ুন” নামে পরিচিত ছিল। তার মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে তার দলের এক কর্মী ফারহান আল-সাদির নেতৃত্বে দুইজন ইহুদি সন্ত্রাসীকে হত্যা করেন। এটি আরব বিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কাসসামিয়ুনদের নেতৃত্বে কৃষক ও শহুরে গেরিলারা দেশজুড়ে বিদ্রোহ শুরু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আল-কাসসামের কারণে ফিলিস্তিনীরা সশস্ত্র জিহাদের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়। ১৯৬০ এর দশকে সৃষ্ট ফিলিস্তিনি ফিদাইন যোদ্ধারা আল-কাসসাম রহ.-কে নিজেদের প্রেরণার উৎস হিসেবে দেখত। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র আন্দোলন ফাতাহের প্রতিষ্ঠাতারা প্রথমে নিজেদের দলকে “কাসাসামিয়ুন” বলে ডাকতেন। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইনের পরিচিত সদস্য লাইলা খালিদ তার সংগঠন সম্পর্কে বলেছেন যে আল-কাসসামের সমাপ্তির স্থান থেকে তার সংগঠন শুরু হয়েছে এবং আল-কাসসামের প্রজন্ম যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন তা সমাপ্ত করতে সংকল্পবদ্ধ। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড নিজেদের প্রস্তুতকৃত ও ব্যবহৃত স্বল্পপাল্লার রকেটের নামও কাসসাম রকেট রেখেছে।
মোটকথা ফিলিস্তিনের সকল যোদ্ধাদের কাছেই আল কাসসাম রহ. হলেন প্রতিরোধ আন্দোলনের নায়ক।
Discussion about this post