১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। ঘটনাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দু’জনেই টাঙ্গাইলের। সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন ঢাবিতে ভাংচুর চালানোর অপরাধে।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিযোগে শামসুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। অধিকাংশ ইতিহাস লেখক বলেছেন, ১৯৫৩ সালে কারামুক্তির পর ঘরোয়া ষড়যন্ত্রের পরিণতিতে আওয়ামী লীগ তাঁকে বহিষ্কার করে; যার ফলশ্রুতিতে তিনি চিরকালের জন্য মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ষড়যন্ত্রটি কী ছিলো তা বেশিরভাগ লেখক এড়িয়ে যান। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতাদের মধ্যে কেউ ছিলো ইসলামপন্থী, কেউ ছিলো বামপন্থী আবার কেউ ছিলো সেক্যুলার। আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি মুসলিম দল থেকে সেক্যুলার দলে পরিণত করার ক্ষেত্রে একজন বাধা ছিলেন শামসুল হক।
শামসুল হক কারাগারে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব প্রচার করতে থাকেন শামসুল হক পাগল হয়ে গেছেন। তিনি মানসিক বিকারগ্রস্থ। এক্ষেত্রে শেখ মুজিবের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সাধারণ সম্পাদকের পদ দখল করা। এটা ছিলো একটা মোক্ষম ফাঁদ। সকলে গিয়ে শামসুল হকের সাথে দেখা করেন এবং তার মানসিক স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞাসা করেন। এক পর্যায়ে এই বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলেই তিনি কারাগারে ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন।
ভাসানীও এই ঘটনার ফায়দা নিতে থাকেন। তিনি মৌখিকভাবে শামসুক হককে বহিষ্কার করেন। তাহলে দলকে সেক্যুলার/বামপন্থী করার পথে বাধা আর থাকবে না। কারণ শামসুল হক অনেকটা ইসলামপন্থী ছিলেন। কারামুক্তির পর তার স্ত্রী আফিয়া সবার অব্যাহত প্ররোচনায় তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাতে চাইলে শামসুল হক অত্যন্ত মনঃক্ষুন্ন হন। তাদের দাম্পত্য সম্পর্কে চিড় ধরে। ঘরে-বাইরে কাউকে বিশ্বাস না করে সব ছেড়েছুড়ে শামসুল হক নিরুদ্দেশ হন। এক পর্যায়ে সত্যিই তার মানসিক বিকার লক্ষ্য করা যায়। এই ব্যাপারে অনেক লেখক সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এই বিষয়ে সাংবাদিক গোলাম মহিউদ্দিন তার মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইতিহাস বইতে বলেছেন,
কারামুক্ত শেখ মুজিব তখন কারাবাসী মওলানা ভাসানীর নিকট হতে নাকি অনুমোদন অর্জন করে আওয়ামী লীগের কর্ণধার হয়ে (সেক্রেটারীর পদে) বসেছেন। তখনকার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (টাঙ্গাইলবাসী) শামসুল হক নাকি তার মস্তিষ্ক বিকৃতির তথাকথিত রোগটির কারণে দায়িত্ব পালনে সক্ষম ছিলেন না। তাই তখন শেখ মুজিবকেই নাকি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিলো।
শেখ মুজিবের সেই কর্মতৎপর দিনগুলোতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক নাকি অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় নিখোঁজ হন। জনাব শামসুল হকের স্ত্রী অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুন এরপর হতে দেশে বিদেশে তার স্বামীর (শামসুল হকের) অন্তর্ধানের পিছনে শেখ মুজিবেরও কালো হাত রয়েছে বলে সারা জীবনকাল ধরে অভিযোগ করেছেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কাজে আমরা যখন দেশে-বিদেশে সক্রিয় ছিলাম তখন ভারতের নয়া দিল্লীস্থ গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন হোস্টেলে আমাদের অস্থায়ী আবাসস্থলে মার্কিন মুল্লুকের বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ভারতীয় বাঙালী হিন্দু অধ্যাপক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারের কাজে সস্ত্রীক এসে আমাদের সঙ্গে ক’দিন ছিলেন। ভয়েস অব আমেরিকা খ্যাত বাঙালী সাংবাদিক-ব্রডকাস্টার প্রসুন মিত্রও আমাদের সঙ্গে সেখানে ছিলেন। সর্বপ্রথমের ‘জয়বাংলা’ (নওগাঁ) পত্রিকার প্রকাশক (আসলে ব্যাংকার) রহমতুল্লাহও তার কয়েক সপ্তাহের দিল্লীবাসকালে সেখানে আমাদের সঙ্গে ছিলেন।
উপরোক্ত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী অধ্যাপক বাবু প্রায়ই নিখোঁজ শামসুল হকের স্ত্রী অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুনের কথা আমাদের সামনে তুলতেন। উক্ত মিসেস আফিয়া খাতুনও তখনকার দিনে মার্কিন মুল্লুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে অধ্যাপনার কাজে ছিলেন। সেখানেও তিনি তার স্বামী শামসুল হকের অন্তর্ধানের পেছনে শেখ মুজিবের কালো হাত থাকবার কথা উপরোক্তদের সবার নিকটেই বিশেষ জোরের সঙ্গেই বলে বেড়াতেন, হার্ভার্ড অধ্যাপকদের মুখে আমরা সবাই তা শুনতাম। এতে সেসব দেশে তাদের মুজিবকে হিরো বানাবার প্রয়াস নাকি বার বার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, অধ্যাপক বাবু দু:খ করে বলতেন।
১৯৬৫ সালে তাকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছে বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। তার মৃত্যু কীভাবে ও কোথায় হয়েছে এই ব্যাপারে কেউ জানে না। সম্প্রতি কেউ কেউ বলছেন তার মৃত্যু ও কবর নাকি টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে রয়েছে।
ভাসানী আওয়ামী লীগকে ধীরে ধীরে বামপন্থার দিকে নিয়ে যেতে চাইছিলো। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ডানপন্থীদের সাথে প্রায়ই তার মতবিরোধ দেখা দিতো। এই মতবিরোধ শক্তিশালী হয় ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে। কাগমারি সম্মেলনের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ভাসানী বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কথা বলতে থাকেন দলের ডানপন্থী ও উদারপন্থীরা। অনেকটা কোণঠাসা ভাসানী ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন সোহরাওয়ার্দীর চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান।
একই বছর ২৫ জুলাই ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এরপর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এজন্য তাকে তার বিরোধীরা উপহাস করে লাল মাওলানা বলতো। ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করার পর ১৩-১৪ জুন লীগের বিশেষ সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিব।
এরপর ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব আইয়ুবের ষড়যন্ত্রে পড়ে ৬ দফা উত্থাপন করেন। তার এই ৬ দফার বিষয়টি কেউ জানতো না। সে আওয়ামী লীগের কারো সাথেই আলোচনা না করে ৬ দফা উত্থাপন করে। মূলত সে লাহোরে যায় আইয়ুবের তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর একটি মিটিং-এ যোগ দিতে। কিন্তু সেখানে তাসখন্দ চুক্তি নিয়ে কথা না বলে মুজিব ৬ দফা উত্থাপন করে মূলত ঐ মিটিংটা ভেস্তে দিতে চেয়েছিলো।
আওয়ামী লীগের অধিকাংশই ৬ দফা মানে নি। দফাগুলোর সাথে তাদের বিরোধ অতটা না হলেও তাদের মূল বিরোধ মুজিবকে নিয়ে। মুজিবের কারো সাথে পরামর্শ না করে এধরণের ঘোষণা কেউ মেনে নিতে পারে নি। ১৯৬৬ সালের ১৮-১৯ মার্চ ঢাকায় পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক শুরু হয়। এতে অন্যান্য মেম্বার সহ লীগ সভাপতি আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের প্রবল আপত্তির মুখে মুজিব ছয় দফা পাশ করাতে ব্যর্থ হয়। এর মাধ্যমে ছয় দফার সাথে আওয়ামী লীগের লীগের আর কোন সম্পর্ক থাকে না। হতাশ মুজিব তার শেষ অস্ত্র হিসেবে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেন।
এই প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী ও তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সেসময় দুঃখভরা মন নিয়ে শেখ মুজিব আমাদের (ছাত্রলীগ) ডাকলেন। বললেন, আমি তো বিপদে পড়ে গেছি। আমারে তোরা কি সাহায্য করবি না? ছয় দফা বলার পর থেকেই বিভিন্ন দিক থেকে আমার অপর এটাক আসছে। আমার তো এখন ঘরে বাইরে শত্রু। আমরা তখন বললাম নিশ্চয়ই আপনার পাশে থাকবো।
অবশেষে ফ্যাসিবাদী মুজিব ছাত্রলীগের গুন্ডাদের সহযোগিতায় সভাপতি তর্কবাগীশকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ছাত্রলীগের গুন্ডারা চ্যালাকাঠ নিয়ে আওয়ামী লীগের অফিস থেকে সভাপতি তর্কবাগীশ ও তার অনুসারীদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। এরপর শেখ মুজিব নিজে নিজেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘোষণা করেন।
এরপর শেখ মুজিব নিজের দক্ষতায় ছয় দফাকে আওয়ামীলীগের মধ্যে জনপ্রিয় করতে সক্ষম হন। একইসাথে নিজের ব্র্যান্ডিংটাও ভালোভাবে করতে পারেন। এভাবে তিনি আওয়ামীলীগের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন। জোর করে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ দখল করার পর শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় আর কখনোই কাউন্সিল হয়নি।
আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের সমার্থক। এখানে মুজিব যা বলবে তা-ই আইন। শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নেয়ার পরেও একই ঘটনা ঘটতে থাকে। আওয়ামী লীগ পরিণত হয় শেখ মুজিবের জমিদারি। এখানে তার বংশের লোকই শেষ কথা। দলীয় প্রধান হাসিনার কথাই আইন।
ছবি: বাম থেকে শেখ মুজিব, শামসুল হক, আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ।
Discussion about this post