অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক:
জামায়াতে ইসলামি এদেশে তৃতীয় বৃহত্তর রাজনৈতিক দল। গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য জামায়াত আন্দোলন করছে। জামায়াত তার রাজনৈতিক কার্যক্রমে কখনো চরমপন্থা অবলম্বন করেনি। শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার দীর্ঘ ১২ বছর যাবৎ প্রকাশ্যে মিছিল সমাবেশ করার অনুমতি দিচ্ছে না। যেটা সংবিধানের চরম লঙ্ঘন। এক কথায় বললে সরকার জামায়াতের সকল প্রকার গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার হরণ করেছে।
গত ১০ জুন ঢাকায় জামায়াতে ইসলামি একটি সমাবেশ করেছে। সমাবেশটি যেমন ছিল শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল তেমনি ছিল লোকে লোকারন্য। কিন্তু জামায়াতের এই সফল সমাবেশ দেখে এক শ্রেণির লোকের গায়ে জ্বালা শুরু হয়ে গেছে। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করছে যে জামায়াত সরকারের সাথে গোপনে আঁতাত করেছে। বিশেষ করে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে জামায়াত যে বিএনপির সাথে মিলে আওয়ামী দু:শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে, সেই বিএনপির নেতারাও প্রকাশ্যে বলছেন যে জামায়াত সরকারের সাথে গোপনে আঁতাত করেছে।
বিএনপি নেতা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও রুমিন ফারহানা প্রকাশ্যেই বলছেন যে সরকারের সাথে জামায়াত আঁতাত করেছে। কিন্তু ইতিহাস কি বলছে? সরকারের সাথে কারা আঁতাত করে চলছে? পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়-বিগত ১৫ বছরে বিএনপি নেতারাই গ্রেফতার এড়াতে সরকারের সাথে আঁতাত করে চলেছে। এমনকি আওয়ামী লীগের সাথে মিলে তারা জামায়াতে ইসলামিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ারও চেষ্টা করেছে।
ইতিহাস বলছে ২০০৬ সালে জামায়াতকে নির্মূলের জন্য আওয়ামী লীগের সাথে আতাত করে বিএনপি নেতারা। এখন প্রশ্ন হতে পারে-বিএনপি ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগের সাথে আতাত করবে কেন? জবাবটা খুবই পরিস্কার। ৫ বছর বিএনপির সাথে ক্ষমতার অংশিদার ছিল জামায়াত। জামায়াতের দুইজন মন্ত্রী ও ১৭ জন এমপির সততা, আন্তরিকতায় শুধু দেশের মানুষ মুগ্ধ হয়নি, আন্তর্জাতিক মহলও বিস্মিত হয়েছিল। সাধারণ জণগন মনে করেছিল-একমাত্র জামায়াতের মাধ্যমেই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। জামায়াতের জনপ্রিয়তা দেখে বিএনপির কয়েকজন নেতা ভরকে গিয়েছিল। এই গ্রুপে ছিল বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুর মান্নান ভুইয়া, অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, খন্দকার মোশাররফ, স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরও অনেক বিএনপি নেতারা।
তারা কিভাবে জামায়াত নির্মূলের চক্রান্ত করেছিল:
২০০৬ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ও বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুইয়া চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সংসদ ভবনে সংলাপ করেছিল। তারা প্রতিদিন সংলাপ শেষে গণমাধ্যমকে বলতেন-আলোচনা ফলপ্রসু হয়েছে। আগামীকাল আরও আলোচনা হবে। কিন্তু কোনো সমাধান ছাড়াই তারা সংলাপের সমাপ্তি ঘটান। এরপরই রাজধানীর পল্টনে ঘটে ২৮ অক্টোবরের নির্মম হত্যাকান্ড।
এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে সংলাপের সাথে ২৮ অক্টোবরের ঘটনার সম্পর্ক কি? এর জবাবও পরিস্কার। দুই মহাসচিবের সংলাপে দেশের সংকট নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বাম আদর্শ ধারণকারী মান্নান ভুইয়া বিএনপির মহাসচিব হলেও তিনি আওয়ামী লীগের অনুগত লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন চরম জামায়াত বিদ্বেষী। আব্দুল জলিল আর মান্নান ভুইয়ার সংলাপের আলোচনার মূল বিষয় ছিল কিভাবে জামায়াতকে শেষ করা যায়। চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন না করে তারা জামায়াত নির্মূলে একমত হয়েছিলেন। আর এটার প্রতিফলন ঘটেছিল ২৮ অক্টোবরে।
২৮ অক্টোবরে বিএনপি সমাবেশ করেছিল নয়াপল্টনে আর জামায়াত করেছিল পল্টনে। ক্ষমতা তখনও বিএনপির হাতে। কিন্তু ওই দিন সকালে শেখ হাসিনার গুন্ডারা ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদেরকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে লাশের উপর নৃত্য করলেও সেখানে কোনো পুলিশ আসেনি। এমনকি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে ফোন করলেও তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অপরদিকে, নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে তিন স্তরের পুলিশি নিরাপত্তা ছিল। এসব থেকে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে-২৮ অক্টোবরের ঘটনা ছিল বিএনপি-আওয়ামী লীগের যৌথপরিকল্পনার ফসল। জামায়াত উত্থ্যান ঠেকাতেই মূলত বিএনপির কিছু নেতা আওয়ামী লীগকে দিয়ে এই নির্মম হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল।
তারপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সাল থেকে বিএনপি জামায়াত আবার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১১ সালে কয়েকটি সমাবেশ হলেও ১২ সাল থেকে বিএনপি আর কোনো কর্মসূচি সফল করতে পারেনি। খালেদা জিয়ার ডাকা একাধিক হরতাল সফল হয়নি বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মাঠে না নামার কারণে। ২০১৩ সালে তো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও কর্মসূচি অংশ নেননি।
ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হতো-স্থায়ী কমিটির নেতাদেরকে খালেদা জিয়া ধমকাইছেন। এমনকি খালেদা জিয়া কোনো কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিলে সেটাও বিএনপির নেতারা সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাকে জানিয়ে দিতেন। এগুলো গোপন বিষয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এসব সংবাদ এসেছে। আর কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় মির্জা ফখরুলকে তারেক রহমান অনেক ধমক দিয়েছে। যেগুলোর অডিও সামাজিক মাধ্যমেও এসেছে। এমনকি ছাত্রদল ও বিএনপি নেতাদের উপর আস্থা হারিয়ে হরতাল সফল করার জন্য খালেদা জিয়া ছাত্রশিবিরের নেতাদের সাথে বৈঠক করেছে এমন সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে।
২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসি ঘোষণা দিয়েছিল খালেদা জিয়া। সেদিন দেখা গেছে, জামায়াত-শিবির মাঠে নামলেও বিএনপি নেতারা কেউ ঘর থেকে বের হননি। আজকে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন-জামায়াত সরকারের সাথে আতাত করেছে। অথচ মার্চ ফর ডেমোক্রেসির দিন এই আলালও ফোন বন্ধ করে আত্মপোগনে ছিলেন। রুহুল কবির রিজভী বার বার কারাবরণ করলেও আলালরা নিরাপদেই পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন। এসব কি আতাত নয়?
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বাতিলের দাবিতে সারাদেশে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই মনে করেছিল-সরকার আর টিকতে পারবে না। কিন্তু হঠাৎ করেই বিএনপি নেতারা মাঠ ছেড়ে দিলেন। জামায়াত-শিবির আন্দোলন চালিয়ে গেলেও বিএনপি নেতারা মাঠে নামেননি। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া আন্দোলন বন্ধ করতে বাধ্য হন। তখন এমন সংবাদও চাউর হয়েছিল-বিএনপির কিছু নেতা সরকার থেকে টাকা খেয়ে খালেদা জিয়াকে আন্দোলন বন্ধ করতে বাধ্য করেছেন।
এরপর, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়া অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ওই সময় খালেদা জিয়া নিজেও তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ছিলেন। এই অবরোধ কর্মসুচি টানা তিন মাস চলছিল। তখনও সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেবে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মাঝ পথে হঠাৎ করেই বিএনপি নেতারা ঝিমিয়ে পড়লেন। মিছিল মিটিংয়েও তারা আসা বন্ধ করে দিলেন। আগের বছরের মতো এবারও অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হন খালেদা জিয়া।
লক্ষণীয় বিষয় হল-সবগুলো আন্দোলনই যখন তীব্র আকার ধারণ করে ও সরকার বেকায়দায় পড়ে যায় ঠিক তখনই বিএনপি নেতারা মাঠ ছেড়ে দেন। তারা বার বার এসব করেছেন কেন? বিএনপির এসব নেতা যে সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে, এগুলো কি প্রমাণ নয়? এরপরও তারা বলছে জামায়াত সরকারের সাথে আতাত করছে।
তারপর, ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়াকে বাধ্য করেছেন। মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির সিনিয়র নেতারা সরকার থেকে টাকা খেয়ে এসব করেছেন। এরবড় প্রমাণ হল-এত বড় ভোটডাকাতির পরও তারা কোনো প্রতিবাদ করেনি। আওয়ামী দালাল ডা. কামাল আর জাফরুল্লাহ যা বলেছেন, ফখরুলরা তাই করেছেন। তৃণমুলের নেতাকর্মীরা আন্দোলনের কথা বললেও ফখরুলরা সাই দেননি। কেন? আওয়ামী লীগের সাথে তাদের কিসের এত পীরিত?
Discussion about this post