আব্বা ইন্তেকাল করেছেন ১ বছর হয়ে গেলো। আব্বাকে নিয়ে আগেও লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু গুছিয়ে লিখতে পারিনা বলে হয়ে উঠেনি। সব সময়ই অন্তর থেকে তাগিদ অনুভব করি পরিবারের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আব্বাকে তুলে ধরার। হয়তো কিছুটা হলেও আব্বাকে জানতে পারবে। তাই লেখালেখির অযোগ্যতা সত্ত্বেও এবার লিখতে বসলাম। যেহেতু ছেলে হিসেবে লিখছি, তাই একান্তই পারিবারিক দৃষ্টিকোণ থেকে আব্বাকে কেমন দেখেছি সেটাই তুলে ধরছি। আব্বা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, তিনি তেমন বিশাল কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা একাডেমিক স্কলার ছিলেন না। কিন্তু ইসলামকে যতটুকু জেনেছেন বুঝেছেন তার পুরোটাই ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বাস্তবায়নের ঐকান্তিক চেষ্টা করেছেন। আব্বার একমাত্র কামনা ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি। দুনিয়াবী জীবনে একেবারেই নির্লোভ আর সাদামাটা মানুষ ছিলেন তিনি।
আমার জন্মের পরপরই আব্বার সাংগঠনিক দায়িত্বের কারণে আমাদের পরিবার ঢাকায় চলে আসে। এর আগে আব্বা ফেনী, নোয়াখালী এবং সর্বশেষ চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কর্মজীবনে আব্বা ফেনীর শর্শদি স্কুল, ফেনী সেন্ট্রাল স্কুলের শিক্ষকতা করেন। কিছুদিন দৈনিক সংগ্রামের জেলা সংবাদদাতা হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীতে সংগঠনের নির্দেশনা অনুসারে চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে পূর্ণকালীন সময় সংগঠনে দেওয়া শুরু করেন। ফেনী মহকুমার আমীর ও তারপর চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বশীল হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নিয়োজিত হয়ে ঢাকায় চলে আসেন।
সাংগঠনিক শত ব্যস্ততার পরেও আব্বা পরিবারকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার চেষ্টা করতেন। আব্বা এমন এক সময়ে সংগঠনে যুক্ত হয়েছিলেন যখন পূর্ব পাকিস্তানে রুকনের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে কঠোর ত্যাগ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশব্যাপী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন তৎকালীন নেতারা। বাসের ভিতরে জায়গা না পেলে ছাদে করে হলেও নির্ধারিত সফরে যেতেন আব্বা।
আব্বা ফজরের নামাজ পড়ে আমাদের সবাইকে নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আমরা ভাইবোনরা প্রাথমিকভাবে আব্বার কাছেই আরবি শিখি। পরবর্তীতে মক্তবে যাই। তিলাওয়াতের পরে আব্বা হাঁটতে বের হতেন। আমিও সাথে যেতাম। ফেরার পথে বাজার করে আনতেন। আব্বা খুব সময় সচেতন ছিলেন। সংগঠনের অনেক সহকর্মীই বলতেন আব্বাকে সময় দিয়ে হারানো খুব কঠিন। কাউকে কোনো সময় দিলে নিজে ঠিক সময়ে উপস্থিত হতেন। সাংগঠনিক প্রোগ্রামগুলোও আব্বা ঘড়ির কাটা ধরে নির্ধারিত সময়ে শুরু করতেন। কোথাও বক্তব্য দিতে হলে নির্ধারিত সময়েই শেষ করে দিতেন।
আব্বার অভ্যাস ছিলো ঘরে ঢুকেই বড় করে সালাম দেয়া। অফিস থেকে কখনো দুপুরে বাসায় এসে ভাত খেতেন। তারপর ঘড়ি ধরা ৩০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার অফিসে চলে যেতেন। রাতে ফিরে সবাইকে নিয়ে একসাথে খেতেন। আমাদের পড়া লেখার খোঁজ খবর নেয়া, হাতের লেখা লিখতে দেয়ার কাজগুলোও আব্বাই করতেন। আব্বার হাতের লেখা বেশ সুন্দর ছিলো, আমাদের হাতের লেখা সুন্দরের ব্যাপারেও উৎসাহিত করতেন। বছরের শুরুতে বেশ আয়োজন করেই আমাদের নতুন বই, খাতার মলাট লাগিয়ে দিতেন। দেশ বিদেশের ডাকটিকেট, ভিউ কার্ড এনে দিতেন জমানোর জন্য।
আমাদের ঘরে নিয়মিতই পারিবারিক বৈঠক হতো। বৈঠকগুলোতে আব্বা সবার প্রথমে বলতেন, আমার কোন দোষ আছে কিনা তোমরা মুহাসাবা করো, এরপর যার মাঝে কোনো দোষ ত্রুটি দেখতেন তার সংশোধনের জন্য তিনি সে বিষয়ে উল্লেখ করে পরামর্শ দিতেন। আমাদেরকে রাগ দমনের জন্য বলতেন। বাড়ির কাজের লোকদের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে খবর নিতেন। বৈঠকে মরহুম প্রফেসর নাজির চাচা, মরহুম সর্দার আব্দুস সালাম চাচা, প্রফেসর মুজিবর রহমান চাচাদেরকে নিয়ে আসতেন অনেক সময়। তারা আমাদের নসিহত করতেন, দারস পেশ করতেন। আমাদেরকে দিয়েও দারস দেয়াতেন। রাতে অফিস থেকে ফিরে খেতে বসার সময় কাজের লোকের খাবারের খোঁজ নিতেন। কাজের লোকদের দোষ ধরতেন না। তাদেরকে বকা দেয়া খুব অপছন্দ করতেন।
আব্বা আমাদের সাথে হাসি তামাশাও করতেন। আমি খুব একটা গ্রামে না যাওয়ায় গাছপালা ভালো চিনতাম না। আব্বা মজা করে বলতেন, নোমান কে ধান গাছের রচনা লিখতে দিলে লিখবে ধান গাছে বড় বড় তক্তা হয়। তা দিয়ে আমরা খাট বানিয়ে শুয়ে থাকি। আব্বা খুব সুন্দর করে কবি নজরুল এর এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল গানটা গাইতেন। নিজে শুক্রবারে আমাকে সাইমুমে দিয়ে আসতেন। বলতেন যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত না থেকে আশেপাশের মানুষদের সাথে পরিচিত হই। আত্মকেন্দ্রিকতা খুব অপছন্দ করতেন। বলতেন, যে মানুষ মৃত্যুর পর একা একা নিজের কবরে যেতে পারেনা; অন্তত ৪ জনের কাঁধে ভর করতে হয়, সে নিজেকে নিয়ে কীভাবে ব্যস্ত থাকতে পারে।
ছোট বেলা থেকেই আব্বা আম্মার উৎসাহে আমরা ভাই বোনেরা আলহামদুলিল্লাহ বাড়ির সব কাজেই অংশ গ্রহণ করতাম। ঘর গুছানো থেকে শুরু করে বাথরুম পরিস্কার – সব কাজেই। নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করানো পছন্দ করতেন না আব্বা। একেবারে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার এই অভ্যাস জারি ছিলো।
ঘরের বাচ্চাদের জন্য আব্বা নিয়মিতই ছোটো ছোটো গিফট আনতেন। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলেও পুরস্কারের ব্যবস্থা করতেন। বাসায় টিভি ছিলোনা। আব্বা টিভি ভিসিআর ভাড়া করে আমাদের কে ওমর মুখতার, দ্য ম্যাসেজ, দ্য মেসেঞ্জারের মত ঐতিহাসিক ইসলামী মুভিগুলো দেখাতেন। আমরা একটু বড় হওয়ার পরে সংগঠনের ভাইদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তাদের কাছ থেকে নিয়মিত আমাদের খবর নিতেন।
সাহস বাড়ানোর জন্য মিছিল মিটিং এ যেতে উৎসাহিত করতেন। ২৮ অক্টোবর (২০০৬) আমি বের হচ্ছি হচ্ছি করে দেরী করে ফেলেছিলাম পল্টন যেতে। বিকালের দিকে আমরা মগবাজার অফিস সংলগ্ন এলাকায় ছিলাম। পল্টন যাইনি শুনে আব্বা খুব আফসোস করেছিলেন। সংগঠন করা নিয়ে আব্বা সব সময় আমাদেরকে বলতেন, তোমাদের বাবা জামায়াত করে বলে তোমাদেরকেও জামায়াত করতে হবে তা নয়। নিজের আখেরাতের কথা চিন্তা করে নিজেই উদ্যোগী হও। আর যদি এই জামায়াত ভালো না লাগে তবে এর চেয়ে ভালো জামায়াতের সাথে কাজ করো কিন্তু বিচ্ছিন্ন থেকোনা।
আতর পছন্দ করতেন খুব। কেউ কোনো আতর উপহার দিলে বাসায় এসে খুব উৎসাহের সাথে আমাদেরকেও লাগিয়ে দিতেন। নিজের পছন্দের আতর থেকে ছোট শিশিতে ঢেলে অন্যদেরকে উপহার দিতেন। হজ্জ্ব বা উমরাহ করে ফিরে আসার সময় অন্যদের জন্য উপহার হিসেবে বেশি করে আতর আনতেন।
আব্বা ইসলামী বই পড়তে এবং বিলি করতে খুব পছন্দ করতেন। অলস অবসর কাটাতেন না। তাফসীর অথবা ইসলামী বই পুস্তক পড়তেন। তাফহীমুল কুরআন বেশি পড়তেন। আব্বা নিজে জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। বলতেন জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য কুরআনী জিন্দেগী বুঝতে তাফসীর হিসেব তাফহীম অনন্য। এছাড়া আব্বা অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থও পড়তেন। নোট করতেন। আমাদের সাথে তাফসীর নিয়ে আলোচনা করতেন। পর্দা মেনে চলার ব্যাপারে আব্বা সর্বদা তদারকি করতেন। কাজিন, চাচী, মামী, ভাবীদের সাথে পর্দা বজায় রেখে চলার ব্যাপারে আমাদের সব সময় সজাগ থাকতে বলতেন।
শারীরিকভাবে এক্টিভ থাকার ব্যাপারে আব্বা খুব সচেতন ছিলেন। নিজে প্রতিদিন নিয়ম করে ১ ঘন্টা হাঁটতেন। বাসার সবাইকে উৎসাহিত করতেন। আম্মার ডায়াবেটিক ধরা পড়ার পর ফজরের পর আম্মাকে হাঁটতে নিয়ে যেতেন। আমাদেরকে বিকালের অবসর সময়টুকুতে বাহিরে গিয়ে খেলাধুলা করার জন্য বলতেন। তবে টিভিতে দিনব্যাপী ক্রিকেট খেলা দেখা ছিল আব্বার অপছন্দ। ভ্রমণ পছন্দ করতেন খুব। কোথাও সফরে গেলে সেখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে আসতেন। আমাদেরকে নিয়ে বেশ কয়েকবার বৃক্ষমেলা, পাখিমেলায় গিয়েছিলেন। নিজে ব্যস্ততার জন্য যেতে না পারলে আমাদেরকে বলতেন যেয়ে ঘুরে আসতে।
আম্মার জন্যে আব্বাকে সব সময়ে খুব কেয়ারিং দেখেছি। আম্মার সাথে আমাদের ভাই বোনদের আচার-ব্যবহারের উপরে আব্বা নজর রাখতেন। পারিবারিক বৈঠকে কারো আচরণে ত্রুটি পেলে বলতেন। আম্মার খাওয়া দাওয়া, চিকিৎসা সব বিষয়ই আব্বা লক্ষ্য রাখতেন। সফরে থাকলে ফোন দিয়ে আম্মার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা খোঁজ খবর নিতেন। আব্বা আম্মা দু’জনেই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। জীবনের অন্তিম সময়েও হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমার বোনকে আম্মার চিকিৎসার অগ্রগতি, খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করতে পারছে কিনা তা জিজ্ঞেস করেছিলেন।
আব্বার পারিবারিক চরিত্রের একটা বড় আকর্ষণীয় দিক ছিলো কাছের, দূরের সকল আত্মীয় স্বজনদের সাথে আন্তরিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক রেখে চলা। আত্মীয় স্বজনের হক আদায়ে আব্বার চেয়ে সচেষ্ট কাউকে আমি দেখিনি। আমের মৌসুমে আত্মীয় স্বজনদের বাসায় আম পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতেন। কোথাও সফরে গেলে ওই এলাকার বিখ্যাত খাবারের আইটেম নিয়ে আসতেন এবং আত্মীয়দের বাসায় কখনো নিজেই নিয়ে যেতেন আর কখনো কাউকে দিয়ে পৌঁছাতেন। আব্বা শুধু তার নিজ পরিবারের জন্যই নয়, অন্য অনেক পরিবারের জন্যই তিনি ছিলেন বিশাল এক ছাতার মতো। দেশে বা দেশের বাহিরে কোথাও সফর থাকলে সেখানে অবস্থিত আত্মীয় অথবা পরিচিতদের ঠিকানা সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন। ব্যস্ততার জন্য দেখা করা সম্ভব না হলে অন্তত ফোনে যোগাযোগ করতেন। সবসময় দাওয়াত রক্ষা করতেন। আত্মীয়দের মাঝে দাওয়াতী কাজ করতেন। আমাদেরকেও বলতেন, পারিবারিক প্রোগ্রাম গুলোতে শুধু গল্পে মশগুল না থেকে যতটুকু সম্ভব দাওয়াতী কাজ করতে।
পোশাক-আশাকে বাহুল্য আব্বা অপছন্দ করতেন। পোশাকের সংখ্যা কম হলেও বেশ পরিপাটি থাকার অভ্যাস ছিল আব্বার। ঘরে মেহমান আসলে ভালো পোশাকটা পরতেন, আয়না দেখে দাঁড়ি, টুপি ঠিক করে তবেই তার সামনে যেতেন। এমনকি অন্তিম সময়ে যখন মঞ্জু ভাই হাসপাতালে দেখা করতে গিয়ে সালাম দিলেন, তখন ইশারায় টুপির খোঁজ করেন। নিজের জামা কাপড়ের ছোটোখাটো ত্রুটি নিজেই সেলাই করে নিতেন। আব্বা ঈদে অনেক জামা কাপড় উপহার পেতেন। নিজের সারা বছর চলার উপযোগী মধ্যম মানের ২/৩ টা রেখে দামি গুলো উপহার হিসেবে কাউকে দিয়ে দিতেন।
খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে খুব সৌখিন ছিলেন না, তবে সামুদ্রিক বড় মাছ খুব পছন্দ করতেন। ডায়াবেটিক রোগী হওয়ার কারণে খাওয়া দাওয়ায় নিয়ম মেনে চলতেন। জোর করেও আব্বাকে নিয়মের বাহিরে কেউ কিছু খাওয়াতে পারতোনা। ইলিশ মাছ খুব পছন্দ ছিল আব্বার। খাবার টেবিলে ইলিশ দেখলেই আফসোস করতেন এর দাম নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রের নাগালের বাহিরে হওয়ায়। বলতেন, সরকার যদি রফতানি কমিয়ে হলেও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ইলিশের ব্যবস্থা করতো, কতই না ভালো হতো। আব্বার খুব ইচ্ছা ছিল স্বল্প আয়ের কিছু আত্মীয়-পরিচিতদের বাসায় ইলিশ মাছ পাঠাবেন তিনি। এই ইচ্ছা ব্যক্ত করার অল্প কিছুদিন পরই আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়েন।
রমযানে আব্বা চেষ্টা করতেন প্রতিদিন অন্তত একজনকে নিজের সাথে করে এনে বাসায় ইফতার করাতে। বিল্ডিং এর দারোয়ানদের প্রতিদিন ইফতার পাঠাতে বলতেন। বাহিরে কোনো প্রোগ্রামে ইফতারের প্যাকেট পেলে বাসায় এসে সেটা দারোয়ানকে দিতেন। শেষ ১০ দিন ইতিকাফে বসতেন। ঐ দিনগুলোতে আব্বা বাড়তি ইফতার পাঠাতে বলতেন যেনো মসজিদে অন্যদেরকেও ইফতার করানো যায়। চাঁদ রাতে ইতিকাফ থেকে ফিরে বিল্ডিং এর সব ফ্ল্যাটে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। আব্বা নিজে নিজের মত করে ঈদ কার্ড ডিজাইন করিয়ে প্রেস থেকে ছাপিয়ে নিয়েছিলেন যা গতানুগতিক ঈদ কার্ড ছিলোনা। কুরআনের একটা আয়াত, সাথে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে কিছু লেখা আর সাথে আত্মসমালোচনার জন্য বেশ কিছু প্রশ্ন। এভাবে ঈদ কার্ড দিয়ে দাওয়াতী কাজের চেষ্টা। এই কার্ড গুলো প্রতিবেশীদেরকে দিতেন। ঈদের ৩ দিনের বেশির ভাগ সময়ই আব্বার ব্যয় হতো আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে।
রমযান ছাড়া অন্য সময়েও আব্বা মেহমানদারি করতে পছন্দ করতেন। প্রায়ই অফিস থেকে ফেরার পথে দুপুরে অফিস স্টাফদের অথবা আব্বার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন এমন কাউকে বাসায় নিয়ে আসতেন। খাবারের বেলায় ঠিক যতটুকু নিজের পক্ষে শেষ করা সম্ভব হবে তত টুকুই নিজের প্লেটে নিতেন। জোর করে কখনোই কেউ তাকে বেশি খাওয়াতে পারেনি, নিজেও অন্যকে খাওয়া নিয়ে জোরাজোরি করতেন না। আর মানুষকে বাসায় দাওয়াত দিতে ও অতিথি আপ্যায়ন করতে খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু আপ্যায়নের ক্ষেত্রে বহুপদের আইটেম পরিবেশন করে টেবিল ভরানোর আতিশয্য ও প্রদর্শন পছন্দ করতেন না।
আব্বা আমাদেরকে বেশি করে দান সাদাকা করতে বলতেন। আমার চাকুরীর ইনক্রিমেন্ট এর খবর শোনালেই ধরাবাঁধা প্রথম উপদেশ ছিল এখন যেন দান সাদাকা আরো বাড়িয়ে দেই। বলতেন বেতন পেয়েই আয়ের থেকে একটা নির্ধারিত অংশ দানের জন্য আলাদা করে ফেলতে। মানুষের দুর্দশায় আব্বা খুব পেরেশান বোধ করতেন। কারো চাকুরী, কারো চিকিৎসা সহায়তা – নিয়মিত ফলোআপ করে করে ব্যবস্থা করতেন। কারো দুঃখ দুর্দশার খবর শুনলে কোনো না কোনো ভাবে সহায়তা করতে না পারলে আব্বার পেরেশানি কমতোনা।
আব্বার জেল জীবনে তার সেলে ইমামতি করতেন এক বন্দী। সেই ইমামের মেডিকেল পড়ুয়া ভাগ্নীর একটি কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, মেয়েটার মা তাকে কিডনি দান করলেও অর্থাভাবে মেডিকেলে পড়া আর চিকিৎসা ব্যয় চালানো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তার। আব্বা জেল থেকে বের হয়ে বেশ কিছু জায়গা থেকে তার চিকিৎসা সাহায্য আর মেডিকেলে পড়ার খরচও কমিয়ে আনার জন্য সক্রিয় চেষ্টা করেন এবং আলহামদুলিল্লাহ সফলও হন। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে আব্বার জীবনে। আব্বা খুব আন্তরিকভাবে মানুষের বিপদে আপদে কার্যকর সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন আজীবন।
বিয়ে শাদী দেয়ার ব্যাপারে আব্বা খুব জোরালো ভাবে চেষ্টা করতেন। উভয়পক্ষকেই দ্বীনি ভাবধারা বোঝাবার চেষ্টা করতেন। আব্বা আমাদের ভাই বোনদের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও আলহামদুলিল্লাহ বৈষয়িক বাড়ি গাড়ি থাকার চেয়ে দ্বীনি অবস্থাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
আব্বা ছিলেন ফুল টাইম দায়ী ইলাল্লাহ। সার্বক্ষণিক দাওয়াতী কাজের চেষ্টা থাকতো আব্বার। বিল্ডিং এর দারোয়ান থেকে শুরু করে সরকারি, বেসরকারি, সামরিক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা যেখানেই যাদের সাথে পরিচয় হতো সেখানেই আব্বার দাওয়াতী কাজের মিশন শুরু হতো। আগে থেকেই বাছাই করা বই, পত্রিকা থেকে ভালো কিছু লেখা সংগ্রহ করে ফটোকপি করে নিজের সাথে রাখতেন। কাউকে পড়তে দিয়ে সেটা আবার ডায়েরিতে নোটও করে রাখতেন। পরবর্তী সাক্ষাতে অথবা ফোনে পড়ার আপডেট জানতে চাইতেন।
ভারপ্রাপ্ত আমীর হওয়ার পর থেকেই আব্বা যেখানেই যেতেন ডিবি’র এর লোকেরা তার পিছু নিতো। আব্বা তাদের সাথে কথা বলতেন, খোঁজ খবর নিতেন। তাদেরকেও বই দিতেন। জীবনের শেষ দিকে এসে প্রায় ৯ মাস কারাবন্দী ছিলেন। কারাগারের খাদেম, রক্ষী থেকে শুরু করে বন্দী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জেল সুপার সবার কাছেই বই পৌঁছাতেন। সাবেক মন্ত্রী পিন্টু সাহেব, জাতীয় পার্টির এমপি, আওয়ামী লীগের মহিলা এমপির ছেলে, আপন জুয়েলার্সের মালিক সে সময়ে বন্দী ছিলেন। তাদেরকেও আব্বা বই দিয়েছেন।
আমরা আব্বার সাথে সাক্ষাতে গেলে আমাদের বিভিন্ন বইয়ের লিস্ট দিতেন দিয়ে আসার জন্য। কারাগার থেকে আদালতে আসা যাওয়ার পথে গাড়িতে যারা সাথে থাকতেন তাদের সাথে আলাপ করতেন। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো তাদের কাছে সহজ ভাষায় তুলে ধরতেন। মুসলিম হিসেবে আমাদের করণীয় কি তা বোঝাতেন। খুব কম লোকই পাওয়া যাবে যার সাথে আব্বার জীবনে একবার হলেও দেখা হয়েছে কিন্তু আব্বা তাকে কোনো বই উপহার দেন নি অথবা তার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছান নি। বিয়ের প্রোগ্রামগুলোতেও বই উপহার দিতেন।
আব্বা একবার চট্টগ্রাম রেলওয়ের এক উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে নিজের কার্ড পাঠিয়ে সময় চাইলেন। তিনিও সময় দিলেন। আব্বা তাকে কিছু বই উপহার দিলেন। ইসলামের মৌলিক কাজগুলো তিনি পালন করেন কিনা জানতে চেয়ে এসবের গুরুত্ব তুলে ধরলেন। এরপর আব্বা বিদায় নিতে চাইলে সেই কর্মকর্তা খুব অবাক হয়েছিলেন, একটা রাজনৈতিক দলের নেতা কোনো তদবিরের জন্য না গিয়ে শুধুমাত্র দাওয়াতী কাজের জন্য গিয়েছিলেন বলে।
গ্রেফতার হওয়ার পরে বেশ কয়েক দিন টানা রিমান্ডে রাখা হয়েছিলো আব্বাকে। রিমান্ড শেষে আদালতে আনা হলে, যখন জানতে চাওয়া হলো যে আপনাকে রিমান্ডে কী জিজ্ঞাসা করেছে, তখন আব্বা হেসে বললেন, তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, আমিও তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। পুলিশ অফিসারদেরকে বলেছি আপনারাতো মুসলমান। আপনারা নামাজ পড়েন? কুরআন পড়তে জানেন? আপনার স্ত্রী পর্দা করে? সন্তানেরা কুরআন পড়তে জানে? তারা অবাক হয়ে বলেছে, স্যার! এভাবে আমাদেরকে কেউ কোনোদিন বলেনি।
আব্বা চিকিৎসার জন্যও যখন হাসপাতালে ভর্তি হতেন, ওয়ার্ড বয়, নার্স, ডাক্তার সবার খোঁজ খবর নিতেন। বই উপহার দিতেন। আব্বার সহকর্মীসহ যারাই আব্বার সংস্পর্শে এসেছিলেন প্রত্যেকেই সাক্ষ্য দিবেন আব্বার কথায় আর কাজে অমিল থাকতোনা। নিজ চরিত্র দিয়ে ইসলামকে উপস্থাপনের চেষ্টা করতেন। অমুসলিম দেশে গেলেও চলতি পথে বাস বা ট্রেনে অমুসলিমদের সাথে কথা বলতেন। ধর্ম ও জীবন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাইতেন। ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতেন। আব্বা তার বইটাতে এ সম্পর্কে লিখেছিলেন।
সহজ-সরল, অনাড়ম্বর আব্বা জীবনের লক্ষ্য অর্জনে ছিলেন অবিচল। কাঠের শক্ত চেয়ারে বসে কাজ করে গেছেন দিনের পর দিন। সংগঠনের অফিস বা বাসা কোথাও আরামদায়ক চেয়ার বা এসি লাগানোর ব্যাপারে আব্বাকে অনেক চেষ্টা করেও রাজি করানো যায়নি। রুম থেকে বের হওয়ার সময় খেয়াল করে ফ্যান, লাইটের সুইচ বন্ধ করা, যথাযথ প্রয়োজন ছাড়া সাংগঠনিক কোনো খরচ না বাড়ানো, সাংগঠনিক কোনো জিনিস ব্যক্তিগত কাজে না লাগানো – এ সবই যেনো ছিলো আব্বার ফিতরাতের অংশ।
গ্রামের পুকুর হোক কিংবা বাসার পানির কল, ওযু/গোসলে সব সময় পানির পরিমিত ব্যবহার করতেন। বাসা থেকে কেন্দ্রীয় অফিস প্রায় ২৫ মিনিটের পথ ছিল। পায়ে হেঁটে নয়তো অফিসের সিএনজিতে করেই বেশির ভাগ সময় আসা যাওয়া করতেন। গাড়ীতে আসা যাওয়ার জন্য বললে বলতেন, এতটুকু রাস্তা, শুধু আমার পদ-পদবীর ভার দেখানোর জন্য গাড়ির খরচ বাড়িয়ে লাভ কি। বাসায় দামি পর্দা / আসবাবপত্র না কেনার ব্যাপারে আজীবন এক নীতিতেই ছিলেন।
মৃত্যুর বছর খানেক আগে বড় ভাইয়া আব্বার জন্য চশমার সুন্দর একটা ফ্রেম কিনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আব্বার কাছে তা ছিল একদম অপ্রয়োজনীয়, কোনোভাবেই আর রাজি করানো যায়নি। দুনিয়াবী জীবনে নিজে যেমন উচ্চাকাঙ্খী ছিলেন না, আমাদেরকেও তেমনি চোখ নিচু রেখে জীবন পার করার উপদেশ দিতেন সবসময়। আমীর নির্বাচিত হওয়ার পর আব্বার বক্তব্যেও সেই একই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ছিলো –
“অতীতে আমার জীবনে বড় কোন পার্থিব চাওয়া-পাওয়া ছিলনা। এখনও নেই। মহান রব যদি আমাকে তার দ্বীনি আন্দোলনের জন্য কবুল করে থাকেন, তবে সেটাই হবে আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া”।
অন্তিম মুহূর্তে আইসিইউতে আমার বোনের সাথে শেষ সাক্ষাতে পরিবারের প্রতি একই ওসীয়াত করে গেছেন আব্বা, “সবাইকে বলবে, জীবনে কে কত বড় কিছু অর্জন করলো সেগুলো আসলে কিছুনা, ঈমানের সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারাটাই হলো আসল কথা।”
আব্বার আমানতদারিতা ছিলো অসাধারণ। হোক সেটা আর্থিক বা কারো ব্যক্তিগত বা সাংগঠনিক বিষয়। অসংখ্য লোকের এবং সংগঠনের আমানত থাকতো আব্বার কাছে। আলাদা ডায়েরি মেইনটেইন করতেন সেগুলোর হিসাব রাখতে।
২০১১ এর ১৯ সেপ্টেম্বরে পুলিশি হয়রানি এড়াতে আব্বা বাসা ত্যাগ করেন। ক্রমাগত পুলিশী চাপে আমাদেরকেও সেই ভাড়া বাসা ছাড়তে হয়। বাড়িওয়ালা আমাদেরকে খুব ভালো জানতেন, কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের মর্ম বুঝতেননা। ভাবতেন আব্বা বুঝি জীবিকার তাগিদে রাজনীতি করেন। তাই আমরা বাসা ছাড়ার সময় তিনি খুব দুঃখ করে বলছিলেন,আপনারা জীবন চালানোর জন্য অনেক কঠিন পথ বেছে নিয়েছেন।
২০১১ থেকে ২০১৮ প্রায় ৭ বছর আব্বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। সংগঠনের এক কঠিন সময়ে পেয়েছিলেন আমীরের দায়িত্ব। আলহামদুলিল্লাহ, তার মধ্যে কখনো হতাশা কাজ করতে দেখিনি। ধীর-স্থিরতা আর প্রাজ্ঞতা ছিল আব্বার মাঝে। কখনো ভেঙে পড়তেন না। আব্বার জেল জীবনেই আমার ছোট বোনের ক্যান্সার ধরা পড়ে। আব্বার বার্ধক্য ও জেলের একাকীত্ব বিবেচনায় খবরটা তাকে জানানোর ব্যাপারে আমরা দ্বিধায় ছিলাম। শেষে আব্বাকে জানানো হলে তিনি সবরের উপদেশ দিলেন। বেশি বেশি দুআ করতে বললেন। আমরা নিজেরা কোনো কিছু নিয়ে অস্থিরতা অনুভব করলে আব্বার সাথেই শেয়ার করতাম। আব্বার উপদেশগুলো শুনে অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করতাম।
২০১২ থেকে শুরু করে ২০১৬ পর্যন্ত সরকারি নির্যাতন, নেতৃবৃন্দের ফাঁসি, কর্মীদের জেল জুলুম নিয়ে আমরা অস্থির হয়ে পড়লে আব্বাই সান্তনা দিতেন। বলতেন, বদরের ময়দানে যেই আল্লাহ সাহায্য করেছিলেন সেই আল্লাহ তো এখনো আছেন, তাইনা? শুধু আমাদেরকেই তাঁর সাহায্যপ্রাপ্তির যোগ্য হতে হবে। আব্বা সকল দুঃখ-কষ্ট আল্লাহর কাছেই সোপর্দ করতেন। খুব কম রাতেই ৩:৩০ এর পর তাকে বিছানায় দেখেছি। আব্বার গোটা জীবনটা নিয়ে যখন ভাবি তখন মল্লিক চাচার লেখা এই গানটাই মনে আসে,
“হঠাৎ করে জীবন দেয়া
খুবই সহজ তুমি জানো কি?
কিন্তু তিলে তিলে অসহ জ্বালা সয়ে
খোদারও পথে জীবন দেয়া
নয়তো সহজ তুমি মানো কি?”
আব্বা শুধু নিজ পরিবার-পরিজন নিয়েই ভাবতেন না। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের কথাও ভাবতেন। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতেন। মীর কাশেম চাচার শাহাদাতের (ইনশাআল্লাহ) পর আব্বা তার কথা খুব স্মরণ করতেন। সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টায় চাচার দূরদর্শিতার প্রশংসা করতেন। পার্বত্য এলাকাগুলোতে চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দিতে চাচার বিশাল অবদান।
সংগঠনের শহীদ (ইনশাআল্লাহ) পরিবার, দুস্থ অফিস স্টাফদের নিয়মিত খোঁজ নিতেন আব্বা। স্থানীয় দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে তাঁদের কখন কী প্রয়োজন তদারকি করতেন। তাদের সন্তানদের লেখাপড়া, চাকুরী, ব্যবসার খোঁজ নিতেন নিয়মিতভাবে। আমীর -এর দায়িত্ত্ব ছাড়ার কিছুদিন আগে ঢাকায় অবস্থিত শহীদ (ইনশাআল্লাহ) নেতৃবৃন্দের বাসায় গিয়ে সবার সাথে দেখা করে আসেন।
আত্মীয়দের কাছে শুনেছি গ্রামের মানুষকে সাহায্য করার জন্য আব্বা যুবক বয়সে তরুণদের নিয়ে সামাজিক সংগঠন করেছিলেন। তাদের সুখে দুঃখে পাশে থাকবে – এমন কিছু লোক তৈরির জন্য আব্বা সচেষ্ট ছিলেন। আব্বার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে সমাজের এমন উচ্চবিত্তদেরকে সঠিকভাবে যাকাত আদায়ে নিয়মিত তাগিদ দিতেন। সেই যাকাত যেনো দারিদ্র্য দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখে সে ব্যাপারে উদ্যোগী ছিলেন। গ্রামের সাধারণ জনগণ আব্বাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। অনেক হিন্দু পরিবার তাদের মাঝের বিরোধ আব্বাকে দিয়ে মীমাংসা করিয়ে নিতো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৭১ এ গ্রামে হিন্দুদের কিছু জমি-জমা বেদখল হয়েছিলো। সেগুলো যেন মালিকরা সুষ্ঠুভাবে ফেরত পায়, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আব্বা সেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বেদখলকারীরা তখন আমার দাদুর কাছে এসে নালিশ করেছিলো যে, আপনার ছেলে সম্ভবত হিন্দু হয়ে গেছে। আমীরের দায়িত্ব পাওয়ার পর পরই সরকার থেকে গ্রামের হিন্দুদের উপর বেশ চাপ প্রয়োগ করা হয়, আব্বার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য আদায়ের জন্য তাদের কয়েক জনকে ঢাকায় এনে ভয়ভীতি দেখানো হয় । কিন্তু তাদরকে রাজি করাতে পারেনি। বরং আব্বার মৃত্যুর পর আমাদের বাড়িতে এসে তারা চোখের পানি ফেলেছিলো। আব্বার মৃত্যুর খবরে করোনা, লক ডাউন উপেক্ষা করে ঢাকা, চট্রগ্রামসহ আশেপাশের এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ আব্বার জানাজায় অংশ নেন।
আব্বার সর্বশেষ মুহূর্ত নিয়ে ইবনে সিনার আইসিইউ-তে দায়িত্ব পালনরত এক ডাক্তারের অভিব্যক্তি তুলে ধরছি –
——————–
“সাকিনাত”
(মুমিনের অন্তরে আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ প্রশান্তি)
আমীরে জামায়াতকে ১০ তারিখ সকালে প্রথম COVID- ICU তে দেখলাম। সৌম্য,শান্ত চির প্রশান্ত মুখ। High flow nasal canula তে FiO2: 90-95% নিয়েও দিব্বি হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন। কোনো সমস্যা বা অসুবিধা নেই, বললেন আমাকে। আমি তখনও জানিনা তিনিই সেই মকবুল আহমেদ।
সতীর্থদের কাছে তার পরিচয় নিশ্চিত হলাম। আরও জানলাম, তিনি এখানে জীবন-মৃত্যর মাঝে বসেও অন্যদের খোঁজ-খবর নিয়ে চলেছেন। কিভাবে তার পরিচিত কিছু লোকের আয়ের ব্যবস্থা করে তাদের পরিবারের দূর্দশা দূর করবেন সেই আকাঙ্খা। নিজের বা নিজের পরিবারের জন্য কোন আক্ষেপ নেই।
যাই হোক, এরপর তিন দিন বেশ কয়েকবার তাকে ডাক্তার হিসেবে খুব কাছে থেকে দেখেছি, প্রতিবারই মাথা নাড়িয়ে বলেছেন, কোনো কষ্ট নাই। যেন প্রিয় রবের সাথে সাক্ষাতের ঘ্রাণ তার সব কষ্ট দূর করে দিয়েছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন আজীবনের সেই কাঙ্ক্ষিত মূহুর্তের জন্য।
শেষবার গতকাল দুপুর ১২ টায় দেখেছি। তখন তার জাগতিক অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। সবাই বুঝতে পারছিলাম, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, বাকিটা মহান আল্লাহর বিশেষ রহমতের অপেক্ষা।
তখনও যেন তিনি মাথা নাড়িয়ে বলছিলেন,আর কোনো কষ্ট নাই। এর কিছুক্ষণ পরেই আল্লাহ তাকে কবুল করলেন। আলহামদুলিল্লাহ।
সারাজীবন ইসলামী আন্দোলনের জন্য যে জীবন আপনি বার বার উৎসর্গ করার শপথ করেছেন, সবসময় শহীদী মৃত্যু কামনা করেছেন, সেই মৃত্যু আল্লাহ কবুল করেছেন হাসপাতালের বিছানায়, মহামারী আক্রান্ত হয়ে, রোগে ভুগে।
মহান আল্লাহর দরবারে এই ১ম রোজার ইফতারের আগে দোয়া করি, আল্লাহ আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের ওয়ারিশ হিসেবে কবুল করুন। আমীরে জামায়াতকে সামান্য সেবা করার সুযোগ আমাদের জীবনের বিশেষ পাওয়া। দোয়া চাই আমাদের জন্য।”
——————–
সবাই দুআ করবেন, মহান আল্লাহ আব্বার সমস্ত নেক আমল গুলো কবুল করে,তার ভুল ত্রুটি মাফ করে তাকে যেন জান্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান বানিয়ে দেন। আমীন।
লেখক : জামায়াতের সাবেক আমীর মকবুল আহমদের ছেলে
Discussion about this post