‘জনির বুকে ১৬টা গুলি করা হয়। ঘাড়ে ও হাতের তালুতে একটা করে গুলি করা হয়। মোট ১৮টি গুলি করে হত্যা করা হয় আমার স্বামীকে। এতো নির্মমতা কেন? আমার কথা হচ্ছে যে, ১৮টা গুলি কেন? কেন ১৮টা গুলি? কী অপরাধে ১৮টা গুলি? একটা মানুষকে মারতে কয়টা গুলি করতে হয়?’
সাত বছর আগে নুরুজ্জামান জনিকে হত্যা করা হয়েছিল। বিচার না পাওয়ার কথা জানিয়ে (০৯ এপ্রিল ২০২২) শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার লেডিস ক্লাবে এক ইফতার অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেন তাঁর স্ত্রী মুনিয়া আক্তার। গুম ও খুন হওয়া ৪৮ ব্যক্তির পরিবারের স্বজনদের নিয়ে এই ইফতার অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয়তাবাদী কৃষক দল।
এ সময় মুনিয়া বলেন, ‘আমি তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমার বাচ্চার বয়স এখন সাত বছর চলছে। সে এখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। এখন আমার বাচ্চাকে বাবার নাম লিখতে লেট (মৃত) নুরুজ্জামান লিখতে হয়। বাচ্চা আমাকে প্রশ্ন করে, মামণি আমার ফ্রেন্ড আমাকে কোশ্চেন করেছে, ওর বাবার নামের আগে লেট নেই, আমার বাবার নামের আগে লেট কেন?’
খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনির (৩০) স্ত্রী মনিয়া পারভীন তার স্বামীকে হত্যার নির্মমতা বর্ণনা করে এভাবেই প্রশ্ন রাখেন।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে ২০১৫ সালের ২০শে জানুয়ারি ভোরের কোনো এক সময় খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার জোড়পুকুরমাঠ এলাকায় ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
রাজনৈতিক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বরাবরের মতোই তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের মিথ্যা বর্ণনা গণমাধ্যমের কাছে দিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) হিসেবে দায়িত্ব থাকা মাসুদুর রহমান।
জনি ছিলেন খিলগাঁও এলাকার অত্যন্ত জনপ্রিয় ছাত্রদল নেতা।
ডিবির তখনকার অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা কৃষ্ণপদ রায় এর নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নির্মম এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল বলেই মনে করেন জনির আপনজনরা।
সম্প্রতি এই পুলিশ কর্মকর্তাকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ৩১তম কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
জনিকে যেভাবে খুন করা হয়েছিল:
যেই বছর ছাত্রদল নেতা জনিকে হত্যা করেছিল ডিবি পুলিশ, তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তাঁর (জনি) স্ত্রী মনিয়া পারভীন। ভয়াবহ সেই স্মৃতি এখনও তাঁকে তাড়া করেন।
স্বামীহারা হতভাগ্য এই নারীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় আমার দেশ-এর।
নির্মম সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মনিয়া পারভীন বলেন, ‘জনিকে একটা-একটা করে ১৮টি গুলি করে হত্যা করা হয়। কী নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে! একটা মানুষকে মারতে কয়টা গুলি করতে হয়?’
সেদিনের ভয়াবহ ঘটনা বর্ণনা করে মনিয়া পারভীন বলেন, “ঢাকা মেডিকেলে যাবার পর মর্গে লাশটা পাই। যাওয়ার পর দেখি একটা টেবিলে শুয়াইয়া রাখসে। সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা আর গায়ে যে শার্টটা ছিলো ওইটা ওর মাথার নিচে দেয়া। এক আত্মীয় চাদরটা সরাল। আমি ভেবেছিলাম অসুস্থ। মারা গেছে এমন তো ভাবি-ই নাই। সবাই তো কান্নাকাটি শুরু করে দিসে। আমি দেখে ভাবতেসি এই মনে হয় উঠে যাবে। তারপর … পরে দেখলাম ওর বুকে ১৬টা গুলি বুকে করা হয়। একটা গুলি ঘাড়ে। ঘাড়ে করার কারণে রক্তক্ষরণ বেশি হয়। এই কারণেই ওর শার্টটা ওর মাথার নিচে দেওয়া। আরেকটা গুলি ওর হাতের তালুতে একপাশ থেকে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়।”
এভাবেই জনির ওপর পুলিশের নির্মমতার বর্ণনা করেন তিনি।
মনিয়া পারভীন প্রশ্ন করেন, “আমার কথা হচ্ছে যে, ১৮টা গুলি কেন? কীজন্য ১৮টা গুলি? কী অপরাধে ১৮টা গুলি? এতো নির্মমতা কেন?”
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার পর তথাকথিত ক্রসফায়ারের এর নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদও করেন তিনি।
মনিয়া পারভীন বলেন, “আপনারা বার বার ক্রসফায়ার-ক্রসফায়ার বলছেন? ক্রসফায়ার মানে টা কী? দুই পক্ষে গুলি হবে। কিন্তু, পুলিশের তো কেউ আহত হয়নি। কিন্তু, আমার হাজবেন্ডকে তো ১৮টা গুলি করা হয়েছে। কেন?”
তিনি বলেন, “সাংবাদিকদের কাছে এমন প্রশ্নের পরে দেখলাম খিলগাঁও থানার পুলিশ এক প্রেস ব্রিফিং করে। সেখানে একজন পুলিশকে আহত দেখানো হয়। জনি নাকি পুলিশের ওপর হামলা করেছে। সাধারণ মানুষ পুলিশের ওপর কেন হামলা করবে? মানে কী কারণে? ওঁ (জনি) কি চোর-ডাকাত ছিলো? কী ছিল? ওঁ (জনি) পলিটিক্স করতো! পলিটিক্স কে করে না? কে করে না পলিটিক্স? ওঁ (জনি) পুলিশের ওপর কেন হামলা করবে? এটা একটা ব্লেইম এক্সকিউজ না? টোটাল একটা ব্লেইম এক্সিকিউজ! ছোট একটা বাচ্চাও এটা বুঝবে। পুলিশের ওপর আমি কেন হামলা করতে যাব শুধু-শুধু? আর সন্ত্রাসী বললেই কি সন্ত্রাসী হয়ে গেল? কি মামলা ছিল (জনির বিরুদ্ধে)? হ্যাঁ এখন যদি পুলিশ সাজানো মামলা দেখাতে পারে। এই মামলা-ওই মামলা এমন সাজানো মামলা দেখাতে পারে। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে তো আমি অনেক কিছুই দেখাইতে পারবো। আমার হাতে ক্ষমতা আছে আমি অনেক কিছুই দেখাতে পারবো ব্যাপারটা তো এরকমই।
ডিবি যেভাবে তুলে নিয়েছিল:
জনিকে প্রকাশ্য দিবালোকে তুলে নিয়েছিল সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করে মনিয়া পারভীন বলেন, “ওঁ (জনি) তো ২ দিন আগে চলে গিয়েছিল (পুলিশের ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিল)। ১৮ তারিখে (১৮ই জানুয়ারি, ২০১৫) ধানমন্ডিতে ওঁর (জনি) একটা কাজিনের বাসায় ছিলো । ১৯ তারিখ (১৯শে জানুয়ারি, ২০১৫) দিনের বেলা ওঁর (জনি) জেল গেটে যাওয়ার কথা ছিলো। কারণ ১২/১৩ তারিখের দিকে আমার দেবরকে (মনিরুজ্জামান হীরা) অ্যারেস্ট করা হয় প্রথমে। ওঁ (মনিরুজ্জামান হীরা) জামাতে (তাবলীগে) ছিলো। জামাত থেকে আসার পরে ঢাকায় মাত্র ঢুকসে, ঢুকার পর একটা চায়ের দোকানে বসা ওখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। একদম টোটালি একটা মিথ্যা মামলায় ওকে ধরে নিয়ে যায়।”
নিহত জনির স্ত্রী মনিয়া পারভীনের বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট যে জনিকে গ্রেফতারের ফাঁদ হিসেবেই তার ছোট ভাইকে (মনিরুজ্জামান হীরা) প্রথমে গ্রেফতার করেছিল ডিবি পুলিশ।
হীরার গ্রেফতারে বর্ণনা দিয়ে মনিয়া পারভীন বলেন, “ওই জন্যই জেল গেট গেসিল (জনি) আমার দেবরের সাথে দেখা করতে। ১৯ তারিখে (১৯শে জানুয়ারি, ২০১৫) সকাল বেলা যায়। আমার সাথে সকাল সোয়া ১১টার দিকে কথা হয়। সোয়া ১১টার দিকে আমাকে বলল জেল গেট যাচ্ছি। আমি ওখান থেকে বের হয়ে তোমাকে ফোন দিব। কারণ আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। যেহেতু তখন প্রেগন্যান্ট ছিলাম। তো ওইটাই আমার সাথে লাস্ট কথা। এর পরে আর কথা হয়নি। এরপরে আমি যখন দুপুরবেলায় ওকে ফোন দিচ্ছি তখন ফোন বন্ধ পাই। আবার ওপেন হচ্ছে। বারবার কেটে দিচ্ছিলো। আবার বন্ধ করে দেয়। মেসেজ দিলাম কল করো, জরুরী। এভাবেই ঘন্টাখানেক পার হয়ে যায়। আমি ভাবলাম জেল গেটে কি কিছু হলো? আমি দৌড়ে তখন জেলগেট যাই।”
মনিয়া পারভীন বলেন, “জেলগেটে গিয়ে আশপাশে লোকদের জিজ্ঞাসা করতে থাকি। আমার মনে হলো ওখানে কি কিছু হয়েছে? অ্যারেস্ট হলো বা এমন কিছু কি না! আমি সবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা এখানে (জেলগেট) কেউ কি অ্যারেস্ট হইসে বা এমন কিছু? কিন্তু, কেউ কিছু বলতে পারল না! তারপর ওখানে আমি এদিক-ওদিক কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করলাম। এরপর আমি বাসায় আসলাম। “
জনিকে ডিবি পুলিশের তুলে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিয়ে মনিয়া পারভীন বলেন, “”বাসায় আসার (জেলগেট থেকে) কিছুক্ষণ পরে ওঁর (জনি) এলাকারই এক ছোট ভাই আমাকে বলল যে ভাবী টেনশন কইরেন না জনি ভাইয়ের সঙ্গে তো আমার কথাবার্তা হয়েছে। দুপুরবেলায় কথা হলো কিন্তু, উনি বলল যে টেনশন করিস না আমি ফ্রি হয়ে ফোন দেব। একটু প্রবলেমে আছি।”
তিনি বলেন, “আমি ভাবলাম যে প্রবলেমে যতোই থাকুক সে তো আমাকে বাইরে থেকে হলেও একটা নক করবে বা শিওর করবে যে আমি ঠিক আছি। কিন্তু, আমার তো মন স্থির হচ্ছে না। তারপর এভাবেই বসে আছি একে-ওকে ফোন দিচ্ছি যে কোনো খবর আছে কি না। সন্ধ্যার পরে ওঁর (জনি) এক ছোটভাই (এলাকার) জানালো যে কবি নজরুল কলেজের এক ছেলে দেখসে যে ওঁকে (জনি) সাদা-পোশাকধারী কেউ ওকে কোমরে ধরে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। এইটুকু। তখনই তো আমরা বুঝে গেলা যে ও অবশ্যই অ্যারেস্ট হইসে। আমি ভাবতেসি যে ডিবি পুলিশ হয়তো ধরসে পরের দিন হয়তো ইয়ে করবে। সবাই বলল ডিবি ধরলে অবশ্যই পরের দিন কোর্টে তুলবে।”
জনিকে ধরার পর যেভাবে হত্যা করেছিল পুলিশ:
ভয়াবহ সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে নিহত জনির স্ত্রী মনিয়া পারভীন বলেন, “(জনিকে ধরে নিয়ে যাবার পর) আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছিল। কিন্তু, আমরা বুঝি নাই যে এমন একটা কিছু করে ফেলবে (ডিবি)। ওঁর (জনি) সাথে আরেকটা ছেলেকেও ধরসিল। মঈন নামে। মঈনের বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হইসে। মঈনের বড় ভাই বললেন, ডিবি ধরসে হয়তো কাল পরশু ইয়ে করবে। বড়জোর একটু টর্চার করবে। ভোর বেলা মঈনের বড় ভাই আমাকে ফোন দিল সকালে। ছয়টা-সাড়ে ছয়টার দিকে। বলল যে আপু ওদেরকে তো হসপিটালে নিয়েছে। ওরা ঢাকা মেডিকেলে। আমি বললাম হসপিটালে কেন? বলল, বুঝ না ডিবি পুলিশ ধরসে একটু মারধর করসে।”
মঈনের ভাই এও মনিয়া পারভীনকে টেলিফোনে এও বললেন যে, ” .. তো তোমার আসার দরকার নাই। তুমি বিকালের দিকে খাবার-দাবার নিয়া এসো। এখন তো কারো সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না। তুমি তোমার শ্বশুর বা বাসায় তোমার ভাই যে আছে তাদেরকে পাঠাও। এখন গিয়ে উনারা কথা বলুক তুমি পরে আসো।”
মনিয়া পারভীন বলেন, “মঈনের ভাইকে তখন আমি বলি কেন পরে আসবো? আমি এখন যাব। উনি বলল যে না এখন তো কারো সঙ্গে দেখা…(করতে দিবে না) । আমি বললাম আমি ওয়াইফ আমার সঙ্গে তো দেখা করতে দিবে অবশ্যই। আমার সঙ্গে কেন দেখা করতে দিবে না? আমি আর কোনো কথা না বলে, লাইনটা কেটে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে আমার মাকে নিয়ে চলে গেলাম, সিএনজিতে (অটোরিকশা) করে। আমি গিয়ে দেখি শুধু আমিই জানি না। সবাই অলরেডি জানে (জনিকে হত্যার বিষয়টা)। ওঁকে (জনি) জোড়পুকুর মাঠে ফজরের সময় ১৮টা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়।”
Discussion about this post