পোশাক শিল্প মালিকদের চাকচিক্যের জীবন অনেকটাই ফেকাসে হয়ে পড়ছে। আর শিল্প মালিকদের এই বিবর্ণ চেহারাই সতর্ক করে দিচ্ছে দেশের অর্থনীতির আগাম অশনি সংকেত। বেলুন ফোটা অর্থনীতির আসল রূপ বেরিয়ে আসছে দিনকে দিন। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ও পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ মুহূর্তে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যাংক দেনায় দেউলিয়ার পথে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপও রয়েছে। মূলত খেলাপি ঋণে ‘বড় ছাড়’ দিয়ে প্রকৃত তথ্য আড়ালে রাখায় শিল্প খাতের নাজুক এ পরিস্থিতির বিষয়টিও আড়ালে রয়েছে এখনো।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। আর এখন তা ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকা। একটা সময় ছিল যখন ব্যাংকে টাকা আমানত হিসেবে রাখলে মাত্র ছয় বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে যেত। কিন্তু আমানতকারীদের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। এ জায়গাটি দখল করে নিয়েছে ঋণখেলাপিরা। এসব খেলাপি ঋণের সিংহ ভাগই পোশাক মালিকদের। এতে মাত্র ১ যুগের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। আর যদি অবলোপন করা ঋণ ধরা হয়, তাহলে তা দেড় লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি চলে যাবে। এখন পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এটাকে সরকারের চালাকি খেলাপি ঋণ বলা যায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে, ব্যাংক দেনায় জর্জরিত পোশাক খাতের অবস্থা এখন শোচনীয়। ঋণের টাকা ফেরত না পেয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
পোশাক শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, রপ্তানি আয় বাড়ার খবর দিয়ে এই খাতের প্রকৃত সত্য আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে। মূলত দেশের পোশাক খাত সার শূন্য হয়ে পড়েছে। দফায় দফায় জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়া, পর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে কারখানার উৎপাদন সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে না পারা এবং নিজেদের মধ্যে মূল্যছাড়ে রপ্তানি আদেশ ধরার অশুভ প্রতিযোগীতার মুখে পড়েই পোশাক শিল্পের এই দুর্দশা বলে জানান তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিএমইএ’র একজন সাবেক সভাপতি এই প্রতিবেদককে বলেন, পোশাক রপ্তানিতে স্বস্তি কমে আসছে। কমে যাচ্ছে রপ্তানি আদেশ। ক্রেতারা আগে দেওয়া রপ্তানি আদেশ কাটছাঁট করছেন। চাহিদা কমে আসার কারণে দামও কম দেওয়ার সুযোগ নিতে শুরু করেছেন ক্রেতারা। অবিক্রীত ব্র্যান্ড পোশাকের স্টক বাড়ছে।
রপ্তানি আয়েও এ চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করেছে। মে মাসের গত ২৯ দিনে আগের মাসের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি কম হয়েছে ৮৭ কোটি ডলার বা সাত হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। আগামী মাসগুলোতে রপ্তানির চিত্র আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনাকালের মতো আবার সংকটে পড়তে যাচ্ছে পোশাক খাত।
রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের জেরে ইউরোপ এবং আমেরিকায় লাগামহীন মূল্যস্ফীতি ও ভোগক্ষমতা কমে আসার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) তথ্য সরবরাহ সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের তথ্য বলছে, এপ্রিলে ইউরো অঞ্চলের গড় মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কোনো কোনো দেশে এ হার ১০ শতাংশের বেশি। ইইউ বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান বাজার। পোশাকের মোট রপ্তানির ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ এ জোটের ২৭ দেশগুলোতে যায়। ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়া যুক্তরাজ্যে যায় ১১ থেকে ১২ শতাংশ।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম দিকে রাশিয়ায় রপ্তানি কমে যায়। তবে ইউরোপ এবং আমেরিকায় রপ্তানি নিয়ে সমস্যা হয়নি। তবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় অর্থনৈতিক সংকট এবং মূল্যস্ফীতির চাপে গত এক মাস ধরে দুই প্রধান বাজার থেকে রপ্তানি আদেশের প্রবাহ কমে আসছে। নতুন করে রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়া এবং থেকে থেকে নানা প্রতিকূলতা কারণে বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলোও এখন নাকাল।
পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, পোশাক খাত এখন দুই দিক থেকে বিপদে রয়েছে। প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। ফলে চাহিদা কমছে পোশাকের। আবার কাঁচামালের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির কারণে মুনাফা পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। গত কয়েক মাসে বড় অঙ্কের রপ্তানি আয় দেখা গেলেও নিট মুনাফা কম ছিল। এর সঙ্গে চাহিদা কমে আসায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরেই পোশাক খাতে দেয়া ব্যাংক ঋণগুলো ফিরে আসছে না। মালিকরা আবার নতুন ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোতে ধর্না দিচ্ছে। সরকারও এদের ঋণ দিতে আবার চাপ দেয়ায় ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। এর ফলে এখন যে অবস্থা অনেক মালিক বাধ্য হয়ে পালিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছেন।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, তার ব্যাংকে পোশাক খাতেই বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। আর এ কারণে ব্যাংকটি এখন বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে। তিনি বলেন, সরকার বিদেশী সহায়তা পেতে মন্দ ঋণকে আড়ালে রাখতে কৌশল বের করেছে। কিন্তু এর প্রভাবে সব ব্যাংকে ধস নামার উপক্রম। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০১৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণের হার মাত্র ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু আইএমএফ মনে করে, এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত আরও কয়েকটি বিষয়। যেমন আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে মোট ঋণের ৪ দশমিক ১ শতাংশকে খেলাপি ঋণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, যা অবশ্যই করা উচিত। আবার বিশেষ নির্দেশিত হিসাব বা স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট এই নামেও রাখা আছে মোট ঋণের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থ। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে অনাপত্তি সার্টিফিকেট (এনওসি) দিয়ে রেখেছে। এ ধরনের ঋণের হার মোট ঋণের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সুতরাং প্রকৃত চিত্র বুঝতে এই তিন ধরনের খেলাপি ঋণ অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
সুতরাং এভাবে হিসাব করলে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কেননা ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তখন পর্যন্ত ৬৭৫ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন। এতে ঋণখেলাপি হিসেবে তাঁদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। এ রকম ঋণের পরিমাণ এখন ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। আবার বিভিন্ন সময়ে বিশেষ ব্যবস্থায়, সরকারি নির্দেশে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। যেমন ২০১৫ সালে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের পুনর্গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এ রকম বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে সে সময় পর্যন্ত আরও ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে দিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। এভাবে হিসাব করলে দেশে তখন খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের মার্চে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা, গত বছরের ডিসেম্বরে যা ছিল ১৩ লাখ ১ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। এসব ঋণের সিংহ ভাগই পোশাক শিল্প মালিকদের। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক এ প্রতিবেদন বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ২০১৯ সালে আইএমএফ হিসাব কষে দেখিয়েছে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মার্চে নিঃসন্দেহে সেই খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে, যা ৪ লাখ কোটি টাকার কম হবে না। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক দেখিয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, এতে ফাঁকি রয়েছে।
এদিকে ঋণে জর্জরিত হয়ে বছরান্তেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে বড় কয়েকটি পোশাক শিল্প গ্রুপ। যেমন গত বছর অক্টোবরে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাক কমপ্লেক্স হিসাবে পরিচিত ওপেক্স গ্রুপের কাঁচপুরের কারখানাগুলো। এই গ্রুপের কারখানাগুলোতে কাজ করতেন ৪০ হাজারের বেশি শ্রমিক। যাদের প্রায় সবাই এখনো বেকার।
ঋণে ডুবতে বসা পোশাক মালিকরা বিপদে পড়েও কেন চুপ আছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে শীর্ষ স্থানীয় একটি পোশাক শিল্প গ্রুপের মালিক এই প্রতিবেদককে বলেন, এর দু’টি কারণ। প্রথমত কারখানা বন্ধ করতে হলে যে পরিমাণ টাকা দরকার তা অনেকের হাতেই নেই। দ্বিতীয়ত এসব শিল্প গ্রুপের কোন কোনটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। ফলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসলে এসব কোম্পানির শেয়ারে ধস নামবে। আর এই ধাক্কা লাগবে গোটা পুঁজিবাজারে। তিনি বলেন, তাঁর নিজের কোম্পানিটিও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। এমনিতেই শেয়ার বাজারের অবস্থা তলানিতে। এখন প্রকৃত লোকসানের প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসলে তাকে হাতে ‘হারিকেন’ নিয়ে দেশ ছাড়তে হবে।
হারিকেন নিয়ে দেশ ছাড়ার এই অবস্থা শুধু পোশাক মালিকদেরই নয়, হাসিনা সরকারের আমলা-চাটুকার থেকে শুরু করে অনেকেরই। আর এরা দেশ থেকে পালিয়ে গেলে বিপদে পড়বে গোটা ব্যাংক খাত।
সূত্র: আমার দেশ
Discussion about this post