বলিউডের জনপ্রিয় পরিচালক হৃষীকেশ মুখার্জি প্রায় চার দশক আগে ‘কিসি সে না কহনা’ নামে একটি কমেডি ঘরানার ছবি বানিয়েছিলেন। ফারুক শেখ, দীপ্তি নাভাল, উৎপল দত্ত অভিনীত ওই ছবিটিকে প্রায় কাল্ট ক্লাসিকের পর্যায়ে গণ্য করা হয়।
ছবিটিতে একটি দৃশ্য ছিল – ফারুক শেখ তার প্রেমিকা দীপ্তি নাভালকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে একটি হোটেলে চেক-ইন করতে যাচ্ছেন। তারা জানতেন, হোটেলটির নাম ‘হানিমুন হোটেল’, কিন্তু গিয়ে দেখেন সাইনবোর্ডে লেখা ‘হনুমান হোটেল’।
আসলে পুরনো ‘হানিমুন’ শব্দটারই কিছু অংশ অদল বদল করে সাইনবোর্ডে ‘হনুমান’ করে দেওয়া হয়েছে, এটা আবিষ্কার করে হাসিতে ফেটে পড়েন দুজনেই!
এবারে চলে আসা যাক ২০১৮ সালে। অর্থাৎ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পঁয়ত্রিশ বছর পরে।
ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়ের সে বছর ‘কিসি সে না কহনা’ ছবির ওই স্টিল ফ্রেমটি ব্যবহার করেই একটি ‘রাজনৈতিক’ টুইট করেছিলেন।
সঙ্গে তিনি লেখেন : ‘২০১৪ সালের আগে : হানিমুন হোটেল; ২০১৪ সালের পর : হনুমান হোটেল’।
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ২০১৪ সালেই দেশের ক্ষমতায় এসেছিল।
তবে মোহাম্মদ জুবায়েরের সেই টুইট নিয়ে তখন কোনও হইচই হয়নি। এদিকে গত মাসে বিজেপি মুখপাত্র নুপূর শর্মা লাইভ টেলিভিশনে ইসলামের নবী সম্পর্কে যে অবমাননাসূচক মন্তব্য করেছিলেন, তা টুইট করে প্রথম প্রচারের আলোয় আনেন মি জুবায়ের।
এর পর থেকেই তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয় এবং আরব বিশ্বের দেশগুলোর চাপে বিজেপি শেষ পর্যন্ত মিস শর্মাকে দল থেকে বহিষ্কারও করতেও বাধ্য হয়।
কিন্তু এরপর মোহাম্মেদ জুবায়ের নিজেও অতীতে নানা সময়ে হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন, এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ভারতে একের পর এক এফআইআর হতে থাকে।
এই পটভূমিতেই নজরে আসে মোহাম্মদ জুবায়েরের চার বছরের পুরনো ‘হনুমান হোটেল’ টুইটটি। গত ১৯ জুন ‘হনুমান ভক্ত @বালাজিকিজৈন’ নামে একটি টুইটার হ্যান্ডল থেকে দিল্লি পুলিশকে ট্যাগ করে মি জুবায়েরের পুরনো ওই টুইটটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
সঙ্গে লেখা হয়, “আমাদের দেবতা হনুমানজির সঙ্গে হানিমুন (মধুচন্দ্রিমা) শব্দটা যুক্ত করা মানে হিন্দুদের সরাসরি অপমান করা। কারণ হনুমানজি ছিলেন ব্রহ্মচারী। এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”
এরপরই বিজেপি সরকারের কড়া সমালোচক বলে পরিচিত মোহাম্মদ জুবায়েরকে দিল্লি পুলিশ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার করে।
দিল্লি পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, “ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগেই” তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। @বালাজিকিজৈন টুইটার হ্যান্ডল থেকে করা অভিযোগের ভিত্তিতেই যে এই পদক্ষেপ, সেটাও এফআইআরে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, @বালাজিকিজৈন অ্যাকাউন্টের আড়ালে ব্যক্তিটি কে, তা কিন্তু এখনও জানা যায়নি। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই অ্যাকাউন্ট থেকে মাত্র একটিই টুইট করা হয়েছে (যেটি মোহাম্মদ জুবায়েরের বিরুদ্ধে), আর তার ফলোয়ারও ছিল মাত্র তিনজন।
ভারতে ফেক নিউজের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যে ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইটটিকে প্রায় পথিকৃৎ বলে ধরা হয়, সেই অল্ট নিউজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মেদ জুবায়ের। আহমেদাবাদের অ্যাক্টিভিস্ট প্রতীক সিনহার সঙ্গে মিলে তিনি এই সাইটটি চালু করেছিলেন, যা এখন খুবই জনপ্রিয়।
নিজস্ব টুইটার হ্যান্ডল থেকেও মি জুবায়ের নিয়মিত শাসক দল বিজেপি ও মোদী সরকারের সমালোচনামূলক বিভিন্ন টুইট করে থাকেন, যা নানা সময়ে তাদের অস্বস্তির কারণ হয়েছে।
তার সহকর্মী প্রতীক সিনহা মঙ্গলবার রাতে টুইটারে জানান, ২০২০ সালের পুরনো একটি মামলায় মি জুবায়েরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিল্লি পুলিশ প্রথমে তাকে ডেকে পাঠায় – যে মামলায় হাইকোর্ট তাকে আগেই গ্রেপ্তারি থেকে রক্ষাকবচ দিয়েছিল।
কিন্তু সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ সম্পূর্ণ আলাদা একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পুলিশ তাকে জেল হাজতে পাঠায় – যে মামলার এফআইআরও তাকে দেখানো হয়নি। পরে জানা যায়, জনৈক ‘হনুমান ভক্ত’র (বালাজিকিজৈন) অভিযোগের ভিত্তিতেই ওই মামলা রুজু করা হয়েছে।
মোহাম্মেদ জুবায়েরের গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে ভারতের সাংবাদিক সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতারাও এই পদক্ষেপের নিন্দায় মুখর হয়েছেন।
‘এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়া’ তাদের বিবৃতিতে বলেছে, “ভারতে ফেক নিউজ ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে লড়াইতে যে অল্ট নিউজ অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে, তার কর্ণধারকে এভাবে গ্রেপ্তার করা খুবই বিচলিত করার মতো ঘটনা।”
দেশের শীর্ষ সম্পাদকদের এই সংগঠন আরও বলেছে, “যেদিন জার্মানিতে জি-সেভেনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘অনলাইনে ও অফলাইনে’ বাকস্বাধীনতা রক্ষা করার অঙ্গীকার করলেন সে দিনই মোহাম্মেদ জুবায়েরকে দিল্লিতে গ্রেপ্তার করা হল – এটা একটা চূড়ান্ত প্রহসন।”
দিল্লিতে ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকেও এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-ও মন্তব্য করেছে, ভারত সরকার এই সাংবাদিকদের কাজের জন্য একটি বিদ্বেষপূর্ণ ও বিপজ্জনক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস এমপি ও মুখপাত্র মহুয়া মৈত্র অত্যন্ত কড়া ভাষায় টুইট করেছেন : “বিজেপি আসলে ফ্যাক্ট বা সত্যিকেই ঘৃণা করে। জুবায়ের যার প্রতীক তার সব কিছুই তাদের আসলে না-পসন্দ, তারা প্রোপাগান্ডা আর মিথ্যার কারবারি!”
মোহাম্মদ জুবায়েরের গ্রেপ্তারি প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী লিখেছেন, “যারাই বিজেপির ঘৃণা, পক্ষপাত আর মিথ্যা ফাঁস করে দিচ্ছেন তারা সবাই আসলে তাদের কাছে হুমকি।”
“কিন্তু একটি প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে গ্রেফতার করলে এরকম আরও হাজার কন্ঠস্বর গর্জে উঠবে।”
এর আগে শনিবার নরেন্দ্র মোদীর আর একজন তীব্র সমালোচক, মানবাধিকার কর্মী তিস্তা সেতালভাদও গ্রেপ্তার হয়েছেন, সরকারের নির্দেশে টুইটার আটকে দিয়েছে সাংবাদিক রানা আইয়ুবের অ্যাকাউন্ট।
সূত্র: বিবিসি
Discussion about this post