আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। নানা ক্ষেত্রে সমালোচিত এই কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার বিভিন্ন বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ইভিএমসহ বিভিন্ন বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন তিনি। এমনকি ইভিএম নিয়ে বিরোধিতা করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া থেকে শুরু করে কমিশন সভা বর্জন করেছেন তিনি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মাহবুব তালুকদারকে ‘বিএনপির মনোনীত’হিসেবে দেখে এসেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। বিভিন্ন সময়ে তার সমালোচনায় মুখর হতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী ও শীর্ষ নেতাকে।
এ অবস্থায় বর্তমান কমিশন থেকে বিদায় নেওয়ার আগে গত ৫ বছরে কমিশনের নানা কর্মকাণ্ড, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে কমিশনের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ নির্বাচনের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা দ্য ডেইলি স্টারের সাথে কথা বলেছেন মাহবুব তালুকদার।
অ্যানালাইসিসের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ৫ বছর মেয়াদ পূর্ণ করলেন, কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
মাহবুব তালুকদার: নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বাইরের শান-শওকত, গানম্যান, প্রটেকশন ফোর্স, অফিস ও বাসায় জাতীয় পতাকা, গাড়িতে নিজস্ব পতাকা ইত্যাদি আমার জন্য ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু, অভ্যন্তরীণ নানাবিধ টানাপোড়েনে আমি বিপর্যস্ত ছিলাম। আমি নির্বাচন সম্পর্কে নীরব জনগোষ্ঠীর না বলা কথা শোনার চেষ্টা করেছি এবং তাদের মনোভাব অনুযায়ী চলতে চেয়েছি। কারণ নির্বাচনে জনমানসের প্রতিফলন অপরিহার্য। বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ার সামনে যেসব বক্তব্য দিয়েছি, তাতে আমি ছিলাম নির্বাক জনগণের নীরব ভাষার মুখপাত্র। কিন্তু, বাস্তব অবস্থার টানাপোড়েন এড়াতে পারিনি।
নিজেদের সফল দাবি করবেন, নাকি ব্যর্থ?
মাহবুব তালুকদার: নিজেদের সফল বা ব্যর্থ দাবি করা আমার জন্য অমূলক। সফল হয়েছি না ব্যর্থ হয়েছি, সে মূল্যায়ন করবে দেশবাসী, মিডিয়া বা সংশ্লিষ্টরা। সুতরাং এ নিয়ে আমার কোনো দাবি নেই।
সংবিধান অনুযায়ী ইসি স্বাধীন। আপনাদের মেয়াদকালে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছিলেন, নাকি কোনও মহলের চাপ ছিল?
মাহবুব তালুকদার: নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, কিন্তু এই স্বাধীনতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দী। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। বিদ্যমান সংবিধান ও আইনে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও, ক্ষমতা প্রয়োগের মনস্তাত্ত্বিক দৃঢ়তা না থাকলে তা সম্ভব হয় না।
আমার ওপর বাইরের কোনো চাপ ছিল না, আমার ভিন্নধর্মী বক্তব্যের কারণে মন্ত্রীরা আমার সমালোচনা করেছেন, প্রকাশ্যে আমার পদত্যাগ দাবি করেছেন। আমি এসব চাপ হিসেবে গ্রহণ করিনি। তবে, চাপ ছিল কমিশনের ভেতর থেকে।
আপনি অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনের কথা বলেছেন। আবার কমিশনের ভেতর থেকে চাপের কথাও বলেছেন। এগুলো কেমন ছিল?
মাহবুব তালুকদার: কমিশন সভায় আমি যা কিছু বলেছি, অনেক ক্ষেত্রে তার বিরোধিতা হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় তথা একজন সচিবের সঙ্গে এক পর্যায়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, যা আমাকে বিপর্যস্ত করে। এ সবই ছিল টানাপোড়েন ও চাপ।
বিরোধী দলের অভিযোগ আছে, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগের রাতে ভোট হয়েছে, অনেক কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে, নির্বাচনের আগে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চলেছে। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
মাহবুব তালুকদার: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। নির্বাচনের আগের রাতে বাক্স ভর্তি ব্যালটের ছবি বিবিসি’র সংবাদদাতা তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে নির্বাচনের পূর্বে বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন আমাদের দেশে একটা কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে গায়েবি মামলার হিড়িক পড়ে যায়। আমি সবসময় এর বিরোধিতা করেছি। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যখন কাউকে গ্রেপ্তার করে তখন উচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা অনুযায়ী করে না। এসব কথা বলে লাভ নেই।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’- এর অস্তিত্ব ছিল না। যদিও সিইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে দাবি করেন। জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিটিং এমপিদের বিষয়ে তাদের নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল বলে মনে করি না। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এতেই বোঝা যায় নির্বাচন কেমন হয়েছে? এভাবে না-অবাধ, না-সুষ্ঠু, না-নিরপেক্ষ, না-আইনানুগ, না-গ্রহণযোগ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আপনি বলেছেন রাতের ভোট প্রতিষ্ঠিত সত্য। কোন ভিত্তিতে বলেছেন?
মাহবুব তালুকদার: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগের রাতে যে ভোট দেওয়া হয়, বিবিসি-র সংবাদদাতা তা মিডিয়ায় প্রচার করেন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। বরং সিইসি পরদিন সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমি অতৃপ্ত নই। আমি তৃপ্ত। তিনি আরও বলেছেন, নির্বাচন কমিশনাররাও নির্বাচনের ফলাফলে সন্তুষ্ট। সত্যি বলতে কি, আমরা তখন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছিলাম, ফলে এ নিয়ে আলোচনার কথা মনে হয়নি। এতদিন পরে জানতে পারলাম, রাতের ভোটের বিষয়টি সিইসি দেখেননি।
আপনি কখনো কমিশন সভায় রাতের ভোট নিয়ে আলোচনা করেছেন?
মাহবুব তালুকদার: না। আমি এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা করিনি।
ইসি উল্লিখিত অভিযোগগুলো নিজ থেকে তদন্ত করতে পারতো কি না? আপনারা নিজেরা তদন্ত করলেন না কেন?
মাহবুব তালুকদার: একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আগের রাতে ভোট দেওয়া হয়েছে, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। এই নির্বাচনে অভিযোগগুলো তদন্তে আদালত বা অন্য কারো নির্দেশনার প্রয়োজন ছিল না। আমার ধারণা, রাতের ভোটের বিষয়টি তদন্ত করলে নিজেদের ওপরেই দায় এসে পড়ত বলে তদন্ত হয়নি।
আপনাদের অধীনে কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু, অন্য অনেক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতা, অনিয়ম নিয়ে সমালোচনা আছে। অন্য নির্বাচনগুলোতে আপনারা ব্যর্থ কেন হলেন?
মাহবুব তালুকদার: কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় নতুন কমিশন হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালনে বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। প্রথম দিকে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ ছিলাম। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভেতর ও বাইরের নানা চাপের কারণে সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব, এটা প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ফলে এই নির্বাচন ছিল ব্যতিক্রমী। অন্যদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশ নির্বাচন আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এর স্বরূপ সন্ধান করি। এর বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করি ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমি একক দায়িত্ব পালন করেছি। অনিয়মের কারণে বরিশালের নির্বাচন বন্ধ করতে চেয়েও সহকর্মীদের অসহযোগিতায় আমি তা পারিনি। এ ২টি নির্বাচনে কমিশনের কোনো কর্তৃত্ব ছিল বলে মনে হয় না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব ছিল দৃশ্যমান। আবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল অনিয়মের মডেল। বাকি সিটি করপোরেশ নির্বাচনেরও তথৈবচ অবস্থা। যেনতেনভাবে নির্বাচন হয়েছে।
আপনারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ কেন রাখতে পারেননি?
মাহবুব তালুকদার: সংসদ নির্বাচনের আগে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ইসির নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বর্তমান নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এটাই তো স্বাভাবিক। নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানেন, নির্বাচন কমিশন সাময়িকভাবে তাদের ‘বস’ হলেও স্থায়ী ‘বস’ হচ্ছেন যারা সংসদ সদস্যের চেয়ারে আসীন থেকে পুনরায় নির্বাচনে সংসদ সদস্য হবেন। রিটার্নিং অফিসারদের নিরপেক্ষহীনতার কথা আগেই বলেছি। আমার মতে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত হওয়া উচিত।
আপনাদের কমিশনের বিরুদ্ধে দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচনে অনিয়ম, আর্থিক অনিয়ম ইত্যাদির অভিযোগ এনে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়েছেন এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি করেছেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
মাহবুব তালুকদার: দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন কমিশনারদের বিষয়ে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, তা থেকে আমি অব্যাহতিপ্রাপ্ত নই। সুতরাং এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য বা মন্তব্য করার অবকাশ নেই।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এগুলোতে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন। সরকারি দলের একক আধিপত্য দেখা যাচ্ছে, ভোটারের উপস্থিতিও কম। অনেকেই বলে থাকেন, জনগণ নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বলে এই নির্বাচন বিমুখতা তৈরি হয়েছে। আপনার মতামত কী?
মাহবুব তালুকদার: প্রতিটি নির্বাচনের লক্ষ্য হচ্ছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। নির্বাচন ও গণতন্ত্র একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু, স্থানীয় নির্বাচনে এই সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সারাদেশে যে অরাজকতা লক্ষ্য করা গেছে, তা কখনো কাঙ্ক্ষিত ছিল না। ইউনিয়ন পরিষদের এই নির্বাচন তৃণমূল পর্যায়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। এককেন্দ্রিক দলীয় শাসন থাকলে সরকারি দলের একক আধিপত্য বিস্তার স্বাভাবিক। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন গণতন্ত্রকে লাইফ সাপোর্টে পাঠিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মনে নির্বাচন বিমুখতা তৈরি হয়েছে, যা গণতন্ত্রকে মৃত্যুমুখে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন প্রথা উঠিয়ে দিলে এর থেকে উত্তরণ হতে পারে। তবে, অন্য সমস্যাগুলোরও সুরাহা করতে হবে।
আপনি অনেক সময়ে নির্বচন কমিশনের অবস্থান থেকে ভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। নির্বাচনে অনিয়ম, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, এমপিদের আচরণ নিয়ে কথা বলেছেন। এগুলো নিয়ে কি কমিশন সভায় কথা বলেছেন? বলে থাকলে সফলতা পাননি কেন?
মাহবুব তালুকদার: নির্বাচন কমিশন সভার কার্যবিবরণীতে বক্তব্য বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় না। আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য কমিশন সভার কার্যবিবরণীতে স্থান পায়নি। ভিন্নমত হলে তো কথাই নেই। কিছু ক্ষেত্রে আমার লিখিত বক্তব্য কার্যবিবরণীত সংযুক্ত করতে বলেছি। তবে, আমার ভিন্নমত যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্য আমি অসংখ্যবার ইউ, ও নোটের (আনঅফিসিয়াল নোট) মাধ্যমে সিইসি, কমিশনার ও সচিবকে জানিয়েছি। এ ছাড়া, আমি ভিন্নমত পোষণ করে কয়েকবার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি। কমিশন সভায় আমাকে বক্তব্য রাখতে না দেওয়ার জন্য ঘোষণা দিয়ে সভা বর্জন পর্যন্ত করেছি। কী ধরণের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি, তার একটি ঘটনা তুলে ধরতে চাই।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় ৩ মাস পূর্বে আমি একটি লিখিত বক্তব্য কমিশন সভায় উপস্থাপন করতে চাই। আমার বক্তব্যের শিরোনাম ছিল, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে কতিপয় প্রস্তাবনা’। বিষয়টি আমি ইউ, ও নোটের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জানাই। প্রস্তাবনাটি ৩৬তম কমিশন সভায় উপস্থাপনার জন্য লিখিতভাবে আমাকে জানানো হয় ও প্রস্তাবনার কপি সব নির্বাচন কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু, অবাক করা ব্যাপার হলো হচ্ছে, প্রস্তাবনাটি আমি যাতে কমিশন সভায় উপস্থাপন করতে না পারি, সেজন্য ৩ জন কমিশনার অভিন্ন ভাষায় ইউ, ও নোটের মাধ্যমে সিইসিকে অনুরোধ জানালে তিনি সভায় প্রস্তাবনা উপস্থাপন করতে দেননি। তাদের অভিমত ছিল, আমার বক্তব্য সংবিধানবিরোধী। বিষয়টি আমাকে খুবই মর্মাহত করে। আমার বিপরীতে অবস্থান নেওয়া কমিশনারদের চিঠির কপি আমাকেও দেওয়া হয়েছিল। ফলে, আমি এ বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ তৈরি করে সভায় উপস্থিত হই। ওই ‘নোট অব ডিসেন্ট’- এ আমি বলি, বাক প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান প্রদত্ত আমার মৌলিক অধিকার। নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই আমার এই অধিকার খর্ব করতে পারে না। কমিশনের এমন অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ আমি কমিশন সভা বর্জন করেছি।
আপনি যখন গণমাধ্যমে নির্বাচনে অনিয়ম ও সহিংসতা নিয়ে কথা বলেছেন, সে প্রসঙ্গে সিইসি বলেছেন যে, আপনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন এবং আপনার ব্যক্তিগত এজেন্ডা আছে। এ প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য কী?
মাহবুব তালুকদার: সিইসি ঠিকই বলেছেন, আমি এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করেছি। তবে এজেন্ডাটি আমার নিজস্ব নয়, জনগণের তথা দেশবাসীর। এই এজেন্ডা হচ্ছে– সকল নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, আইনানুগ ও শান্তিপূর্ণ করা। কোথাও সহিংসতা হলে তার দায় এড়াব না। সর্বশক্তি দিয়ে এর পুনরাবৃত্তি রোধ করব। আমার এজেন্ডা হচ্ছে─ ভোটাধিকারের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আমার এজেন্ডা হচ্ছে─ গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা, যা সংবিধানের মূল পথনির্দেশ। ‘গণতন্ত্রহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়?’
আপনার ‘আমলার আমলনামা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, চাকরি জীবনে আপনি ও সিইসি সহকর্মী ছিলেন। সিইসি একবার আপনার বিরোধিতা করেছিলেন। আপনাদের এই পূর্ব সম্পর্ক কি ইসিতে কাজ করার সময় কোনো মতবিরোধ তৈরি করেছিল?
মাহবুব তালুকদার: ঘটনাটি এ রকম– ১৯৯৮ সালে আমি জাতীয় সংসদে অতিরিক্ত সচিব পদে নিয়োজিত ছিলাম। ওই সময়ে কে এম নূরুল হুদা যুগ্মসচিব হিসেবে সরাসরি আমার সঙ্গে কাজ করতেন। আমার যোগদানের আগে জাতীয় সংসদে ২টি অতিরিক্ত সচিবের পদ ছিল এবং ২জন কর্মকর্তা পদ ২টিতে নিয়োজিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা সংসদনেত্রীর অফিসের ১টি অতিরিক্ত সচিবের পদ জাতীয় সংসদে সাময়িকভাবে অন্তর্ভুক্ত দেখিয়ে আমাকে সেই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব আমি কিছুই জানতাম না। তবে, এ ব্যাপারে সবই আইনতভাবে করা হয়েছিল। ওই সময় আকস্মিকভাবে কে এম নূরুল হুদা জাতীয় সংসদের সচিবের কাছে একটি নোট পাঠিয়ে জানালেন, আমি বহিরাগত (যেহেতু আমি সংসদ সচিবালয়ের নির্ধারিত পদের অতিরিক্ত সচিব নই)। তিনি আমার নির্দেশ মানতে বাধ্য নন। তৎকালীন সংসদসচিব কাজী মুহম্মদ মনজুরে মওলা তাকে ভর্ৎসনা করে বলেন, এটা তার ইনসাবর্ডিনেশনের পরিচায়ক। সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তিনি (নূরুল হুদা) ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন তুলতে পারেন না। সংসদ সচিবের এমন নির্দেশের পর নূরুল হুদা আর উচ্চবাচ্য করেননি। তাকে আমার উইং থেকে অন্য কোনো উইংয়ে বদলিও করা হয়নি। উল্লেখ্য, আমার বইটি ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। আমি মনে করি না যে, ৩০ বছর পূর্বের এই ঘটনা নির্বাচন কমিশনে কোনো মতবিরোধ তৈরি করেছে।
আপনি গত জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে ছিলেন। এই ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার উচিত হবে কি না?
মাহবুব তালুকদার: ইভিএম-এর শুরু থেকে আমি এর বিরোধিতা করেছি। জনগণ অভ্যস্ত না হলে এর ব্যবহার ঠিক হবে না বলেছি। ইভিএম ব্যবহারের পূর্বে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি। অজ্ঞাত কারণে আমাদের ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তের পূর্বেই ইভিএম কেনা হয়ে যায়। আমার কাছে ইভিএম মেশিন অপূর্ণাঙ্গ মনে হয়। নাসিক নির্বাচনে দেখেছি ইভিএমের কার্যকারিতা বেশ স্লো। ইভিএম নিয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি ঐতিহাসিক নির্দেশনা আছে। এতে বলা হয়েছে, ইভিএমে ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএট) যুক্ত থাকতে হবে। এতে ভোটার দেখতে পারবেন, তার ভোটটি ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কি না। বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য আমাদের ইভিএমে এটি যুক্ত করা উচিত। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার ঠিক হবে কি না, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিএনপি ইতোমধ্যে বলেছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেবে না। এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন রাজনৈতিক সরকারের অধীনে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে?
মাহবুব তালুকদার: আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ না করলে সেই নির্বাচন ঘরে ও বাইরে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিগত ২টি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। এ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব জাতীয় নির্বাচন হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য হয়েছে। সংবিধান সংশোধন ছাড়া এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়।
পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ করার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?
মাহবুব তালুকদার: পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন ও হস্তান্তর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকা অত্যাবশ্যক। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দৃশ্যত ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের, ইচ্ছানুযায়ী ভোট দিতে পারবেন– ভোটারদের মনে এই আস্থা জাগিয়ে তুলতে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কারের জন্য সংবিধান ও বিধি-বিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। একমাত্র গণতন্ত্রই মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারে। সাংবাদিকরা সেই গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী।
আপনি ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’, ‘আমলার আমলনামা’ এসব বই লিখেছেন। এবার কি নির্বাচন কমিশনে কাটানো ৫ বছর নিয়ে কিছু লিখবেন?
মাহবুব তালুকদার: নির্বাচন কমিশনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি যে বই লিখেছি, তার নাম ‘নির্বাচননামা’। এ বই আমাদের কার্যকালের ডকুমেন্টেশন। ১২০০’র অধিক পৃষ্ঠার এ বই আমার মৃত্যুর পূর্বে প্রকাশ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার আপনার চিকিৎসা বাবদ যে অর্থ ব্যয় করেছেন সেটা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। আইনত এটা আপনি করেতে পারেন কি না?
মাহবুব তালুকদার: এ বিষয়ে আমি গত ২৮ জানুয়ারি আমি একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেই। যা নিম্নরূপ– গত ২৭ জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা নির্বাচন ভবনে এক প্রেস কনফারেন্স করে আমার চিকিৎসার ব্যয় বছরে ৩০ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। তিনি অবশ্য খরচের প্রকৃত হিসেব দেননি। তিনি আমাকে রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বলে উল্লেখ করে বলেছেন, আমি কখনো আইসিইউতে বা কখনো সিসিইউতে থাকি। কিন্তু, ইচ্ছা করলেই কেউ আইসিইউ বা সিসিইউতে থাকতে পারে না। বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমকে বিশদভাবে অবহিত করা প্রয়োজন মনে করি।
প্রকৃতপক্ষে আমি নির্বাচন কমিশনার হওয়ার সময় থেকেই প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত। ক্যানসার কালক্রমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি সিঙ্গাপুর ও ভারতের চেন্নাইয়ে এর চিকিৎসা করিয়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালের ৪ জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড ২ দফা শারীরিক পরীক্ষা করে সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমোদন দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনারদের চিকিৎসাবিধি অনুযায়ী আমার চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছে। তবে, গত ২ বছরে আমি চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে বিদেশে যাইনি। বরং এই ২ বছরে চিকিৎসার জন্য সম্পূর্ণ নিজের খরচে আমি আমেরিকা গিয়েছি। বর্তমানে কর্মরত নির্বাচন কমিশনাররা এবং অবসরপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনাররা সবাই প্রাপ্যতা ও বিধি অনুযায়ী কমিশন থেকে চিকিৎসার খরচ নিয়ে থাকেন। কে এম নূরুল হুদা নিজেও নির্বাচন কমিশন থেকে চিকিৎসার জন্য টাকা নিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অসুখের যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া আমার মৌলিক অধিকার। চিকিৎসার কারণেই আমি এখন পর্যন্ত বেঁচে আছি। নির্বাচনের বিষয়ে আমার ভিন্নধর্মী অবস্থানের নিয়ে সিইসি তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চিকিৎসার বিষয় উল্লেখ করে আমার বিরুদ্ধে এমন নিকৃষ্ট পথ বেছে নিয়েছেন।
অন্য কমিশনারাও কি এটা করেন?
মাহবুব তালুকদার: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনাররা সবাই চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে থাকেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাও চিকিৎসা ব্যয় নিয়েছেন।
আপনি ‘বটম লাইন’ হিসেবে কিছু বলবেন?
মাহবুব তালুকদার: একমাত্র গণতন্ত্রই মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারে। সাংবাদিকরা সেই গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী।
Discussion about this post