অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
কেন্দ্র দখল, ব্যালটে সিলমারা, ককটেল বিস্ফোরণ, দফায় দফায় সংঘর্ষ, টেঁটাযুদ্ধ, গুলি ও মারামারির মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে পাঁচজন নিহতের পর দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা চলাকালেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। শুধু তাই নয় চলতি বছর জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন নির্বাচনী সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু ভোটের আগে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের ধরতে বিশেষ কোনো অভিযান চালানো হয়নি। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচন কমিশন বা স্থানীয় প্রশাসন কেউ এ বিষয়ে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ভোটের দিনেও যেসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো উদ্ধারে পুলিশের দৃশ্যত কোনো তৎপরতা নেই। বরং ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করে সুষ্ঠ নির্বাচনের ফাঁকাবুলি শুনিয়ে যাচ্ছেন।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)-এর তথ্যমতে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৮ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪১ জন, বিএনপির ২ জন, সাধারণ মানুষ ২২ জন, পুলিশের গুলিতে ১৫ জন এবং একজন সাংবাদিক মারা গেছেন। সবশেষে গত ১২ নভেম্বর নির্বাচনে ৭ জন নিহত নিয়ে মোট মারা গেছেন ৯২ জন। এরমেধ্যে দ্বিতীয় ধাপেই নিহত ৩৭ জনের মধ্যে গুলিতে মারা গেছেন ১৬ জন। সর্বোচ্চ মৃত্যু নরসিংদীতে ৯। সহিংসতাগুলো বেশিরভাগই ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীনদের দলের মধ্যে সংঘঠিত হয়েছে।
অধিকাংশকেই গুলিত করে হত্যা, ধারালো অস্ত্রের মহড়া চোখে পড়ার মতো
দ্বিতীয় ধাপে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে নরসিংদীতে। সদর ও রায়পুরা উপজেলায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সহিংসতায় ৯ জন নিহত হন। এর মধ্যে নির্বাচনের আগে ৬ জন এবং নির্বাচনের দিন সহিংসতায় নিহত হন আরও ৩ জন। এঁদের সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার সম্পর্কে জানতে চাইলে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান প্রথম আলোকে বলেন, তিন চরাঞ্চলে বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ টেঁটা, ককটেল ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এ সময় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের পরিমাণ বলতে পারেননি তিনি।
সহিংসতা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কোনো চিঠি দেওয়া হয়েছিল কি না জানতে চাইলে নরসিংদীর জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মেছবাহ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে আলাদা করে কোনো চিঠি দিইনি।’
সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা মাগুরায়। মাগুরা সদর উপজেলার জগদল ইউপি নির্বাচন নিয়ে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের বিরোধে নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এতে চারজন নিহত হন। এরপর রূপগঞ্জে মুড়াপাড়া ইউপি নির্বাচনে ওয়ার্ড সদস্য প্রার্থীদের বিরোধকে কেন্দ্র করে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এ ছাড়া কুমিল্লা ও কক্সবাজারে একজন করে গুলিতে নিহত হন। এসব এলাকাতেও আসামি গ্রেপ্তার, দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার ছাড়া অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের ব্যাপারে আর কোনো তৎপরতা নেই। কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার মানিকারচর ইউপিতে সংঘর্ষে গোলাগুলিতে ১ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হন। আহতদের বেশির ভাগের শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল। জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, পুলিশ নির্বাচনের দিন তিতাস উপজেলা থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে। মেঘনা থেকে কোনো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি।
অন্যদিকে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাথুলী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষ্মীনারায়ণপুর বিল ধলা গ্রামে দুই গোষ্ঠীর বিরোধের জেরে দুই সহোদর হত্যার ঘটনা ঘটে। ধারালো অস্ত্রের কোপে মারা যান তাঁরা। নির্বাচনের আগে-পরে ধারালো অস্ত্রের কোপে নিহতের ঘটনা আরও আছে। দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচনে ফরিদপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, পাবনা, গাইবান্ধা ও রংপুরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে একজন করে মোট ছয়জন নিহত হয়েছেন।
ফরিদপুরের সালথায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়ে পরে মারা যান মারিজ সিকদার (৩৫) নামের এক ব্যক্তি। গত ২৪ অক্টোবর উপজেলার যদুনন্দী ইউনিয়নের খারদিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
সালথার থানার ওসি মো. আশিকুজ্জামান বলেন, থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে ঢাল, সড়কি, বল্লমসহ শতাধিক দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গোপালঘাটা ভোটকেন্দ্রের কাছে তিন সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় ছুরিকাঘাতে এক প্রার্থীর সমর্থক মুহাম্মদ শফিউল আলম (৫৫) নামের এক দোকানি নিহত হন।
দায় নির্বাচন কমিশনের
দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন ঘিরে ১২ জেলায় সংঘাত, সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে ৩৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নরসিংদী, মাগুরা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও কক্সবাজার—এই পাঁচ জেলায় গুলিতে নিহত হয়েছেন ১৬ জন। বাকি ২১ জন মারা গেছেন প্রতিপক্ষের পিটুনি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। যেসব এলাকায় গুলির ঘটনা ঘটেছে, সেসব স্থানে দেশীয় কিছু অস্ত্র উদ্ধার হলেও কোনো আগ্নেয়াস্ত্র পায়নি পুলিশ। সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচন কর্মকর্তারাও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালাতে পুলিশকে কোনো তাগিদ দেননি।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ভোটের আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে বৈধ অস্ত্র জমা রাখা ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করতে ইসিকে নির্দেশ দিতে হয়। কিন্তু এখন কোনো কিছুই হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটিকে এই কমিশন একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। এরা কেবল তফসিল ঘোষণা করছে আর যে ফলাফল পাঠানো হচ্ছে তাতে সিল মেরে বৈধতা দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ভোটের আগে ও ভোটের দিন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার কীভাবে হচ্ছে; এর দায় নির্বাচন কমিশনের।
সহিংসতাকে ‘ঝগড়াঝাঁটি’ বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুই ধাপের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে৷ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না৷ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নির্বাচনী সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে৷
এসব সহিংসতার প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘ইউপি নির্বাচনে সবসময় একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়েই থাকে৷’’
বৃহস্পতিবার ৮৩৫টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে সাত জনের৷ এর মধ্যে নরসিংদীতে তিনজন, কুমিল্লায় দুইজন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে একজন করে মারা গেছেন৷ এর আগে ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম দফার ভোটে মারা যান ছয়জন৷ এরপর থেকে ভোটের মাঠের প্রচারণায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে আরও ২৪ জনের৷ সবমিলিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে৷
এই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন অপ্রীতিকর ঘটনা ও সহিংসতা বন্ধে আপনি পুলিশকে কী নির্দেশনা দিয়েছিলেন? জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনারা এমন একটা উদাহরণ দিতে পারবেন যে পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল? পুলিশের কাজ পুলিশ করছে৷ আমাদের বিশাল এলাকা নিয়ে নির্বাচন হচ্ছে৷ এই ইউপি নির্বাচন এটা সবসময় আপনারা দেখে আসছেন, এটা গোষ্ঠী-গোষ্ঠীর নির্বাচন, আধিপত্যের নির্বাচন, এখানে সবসময়ই একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়েই থাকে৷ যেটা হয়েছে বেশ কয়েকটি জায়গায় হতাহতের ঘটনা আমরা দেখছি৷ পুলিশ যথার্থভাবে চিহ্নিত করেছে, দোষীদের ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করে ফেলেছে৷ যারা এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে৷”
‘ঝগড়াঝাঁটি’ বিষয় জানতে চাইলে স্থনীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে তারা এই নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না৷ ৩৭ জনের মৃত্যুর পর এটা কিভাবে ঝগড়াঝাঁটি হয়৷ তার বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, মারামারি করে যে জিতে আসত পারবা সে আমার৷ আগামী নির্বাচনে তোমাকে আমার কাজে লাগবে৷’’ কেন এই সহিংসতা জানতে চাইলে ড. আহমেদ বলেন, ‘‘এটা তো নির্বাচনী সহিংসতা না, এটা ক্ষমতা দখলের সহিংসতা৷ এখানে যে নির্বাচিত হতে পারবে, সে তত বেশি লুটপাট করতে পারবে৷ এখন নির্বাচন করছে কারা? এদের লুটপাটের না হয় জবরদখলের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে৷ নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্যই তো তাদের নির্বাচিত হওয়া দরকার৷”
এত মৃত্যুর পরও নির্বাচনে কেউ ভোটকেন্দ্রে মারা যায়নি, ভালো ভোট হয়েছে বললেন ইসি সচিব
দ্বিতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবারের এই নির্বাচনের সহিংসতায় অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন শতাধিক। তবে পরিস্থিতি বিবেচণায় মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলেও জানা গেছে। অথচ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বললেন আজ কেউ মারা যায়নি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ৭ জনের মধ্যে নরসিংদীতে তিনজন, কক্সবাজারে একজন, চট্টগ্রামে একজন ও কুমিল্লায় দুজন নিহত হয়েছেন। তারপরেও ইসি দাবি করেন মোট যে ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়েছে। সব জেলা-উপজেলায় ভোট নাকি খুব সুন্দর ও উৎসবমুখর হয়েছে।
Discussion about this post