অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
করোনার শুরু থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিতর্কিত যেন থামছেইনা। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিভিন্ন সময় চাপাবাজি ও গলাবাজি করে আসলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। করোনার শুরু থেকে সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও অক্সিজেনের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক করোনা পরিস্থিতি ও টিকাদান কার্যক্রম নিয়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করে দুদিন আগে প্রেস ব্রিফিং ডেকে ‘অনিবার্য কারণে’ তা স্থগিত করায় এই বিতর্ক যেন আরো একটু বাড়িয়ে দিয়েছে।
এরপর শুক্রবার স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয় ‘করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে বিধিনিষেধ আন্তরিক ও কঠোরভাবে পালনের আকুল আবেদন’ শিরোনামে। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। টিকাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যেসব সুনির্দিষ্ট দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে উঠেছে সেগুলোর কোনো জবাব বা ব্যাখ্যা এই বিজ্ঞাপনে দেয়া হয়নি। বরং টিকা ক্রয় এবং এ বাবদ ব্যয়ের যে ‘গোঁজামিল মার্কা’ হিসাব এই বিতর্কিত বিজ্ঞাপনে তুলে ধরা হয়েছে তাতে দুর্নীতির থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। ফলে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
প্রশ্ন উঠেছে এত বিতর্কিত হওয়ার পরেও কেন এই বেহাল দশা স্বস্থ্যমন্ত্রণালয়ের? স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি দ্বায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন তাহলে পদত্যাগ কেন করছেন না? দেশের মানুষ যখন ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেনা সেখানে মন্ত্রণালয় বা কি জন্য দরকার। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিৎ বলে মনে করছেন তারা।
দেখা গেছে, গত বছর করোন সংক্রমণ কিছুটা কমার পর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছিলেন-হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বাড়ানোর জন্য। আর যেখানে আইসিইউ নাই সেখানে স্থাপন করার জন্য। কিন্তু কে শুনে কার কথা। এক বছর হাতে পেয়েও সরকার হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বৃদ্ধি করেনি। আর এখনো দেশের প্রায় ৩০টি জেলার সরকারি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ নেই। এসব এলাকায় আইসিইউ না থাকায় মানুষ গণহারে মারা যাচ্ছে।
এরপর, কয়েক মাস আগেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালিক বলেছেন-দেশে অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন আছে। অক্সিজেনের অভাবে কোনো মানুষ মারা যাবে না। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। অক্সিজেনের জন্যও সারাদেশে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। করোনা রোগীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পাচ্ছে না। এমনকি গত সপ্তাহে সাতক্ষীরাও বগুড়ায় অক্সিজেনের অভাবে ১৪ জন করোনা রোগী মারা গেছে।
জানা গেছে, বগুড়ায় করোনাভাইরাস বিশেষায়িত সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্টের কারণে ৭ জন রোগী মারা গেছেন। একই সময়ে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন আরও তিনজন রোগী।
মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালে শ্বাসকষ্ট থাকা এই রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহের জন্য পুরো হাসপাতালে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা আছে মাত্র দুটি। অক্সিজেন সরবরাহের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় মুমূর্ষু করোনা রোগীদের বাঁচানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ার তিন হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডে শ্বাসকষ্ট থাকা রোগীদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা আছে মোট ২৩টি। এর মধ্যে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ২টি, শজিমেক হাসপাতালে ১১টি এবং বেসরকারি টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০টি।
বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. শফিক আমিন কাজল জানান, তাদের হাসপাতালে রোগীর যে পরিমাণ চাপ সেখানে অন্তত ২০টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা প্রয়োজন, কিন্তু আছে মাত্র ২টি। এ কারণে চাহিদা অনুযায়ী রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অধিক শ্বাসকষ্টে থাকা রোগীদের বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সঙ্কটে সাতজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
দেখা গেছে, গত বছরও করোনা মহামারির সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালিক বলেছিল-পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। শেখ হাসিনাও বলেছিল বিনাচিকিৎসায় কেউ মারা যাবে না। কিন্তু চিত্র দেখা গেছে মানুষ চিকিৎসার অভাবে রাস্তা-ঘাট, হাসপাতালের মাঠ ও বারান্দায় পড়ে মারা গেছে। অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেছে।
এসব ব্যর্থতার দায় দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালিককে সরিয়ে দেয়ার দাবিও তুলেছন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অনিতিবিলম্বে অপসরণ করা হোক। জাতীয় সংসদেও একাধিকবার এমপিরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অপসারণের দাবি তুলেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা জনমতকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। দুর্নীতির বরপুত্র হিসেবে পরিচিত এই অথর্ব মন্ত্রীকে সরাচ্ছেন না।
জানা গেছে, বিগত ১২ বছরে স্বাস্থ্যখাত থেকে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে সরকার। আর এসব লুটপাট হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালিকের মাধ্যমেই। বিশেষ করে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে টিকাসহ বিভিন্ন সরাঞ্জামাদি কিনার নামে হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়েছে সরকার। আর সবই হচ্ছে জাহেদ মালিকের হাত দিয়েই। তাকে এখন সরাতে গেলেই শেখ হাসিনার থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছেন।
এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনা পরিস্থিতি শামাল দিতে না পারার দায়ে পদত্যাগ করেছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধণ ও প্রতিমন্ত্রী অশ্বিন চৌবেসহ অন্তত ৯ জন মন্ত্রী। গত বুধবার মন্ত্রিসভায় রদবদলের আগে হেভিওয়েট ওই মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন বলে খবর দিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে ভারতে দৈনিক করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। পরে এপ্রিল-মে মাসে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পুরো এপ্রিল-মে থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশটিতে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে তিন লাখ থেকে ৪ লক্ষাধিক মানুষ। দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল ৪ হাজারেরও বেশি।
এই পরিস্থিতিতে করোনা মোকাবিলায় ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। চলমান এই সমালোচনার মধ্যেই পদত্যাগ বুধবার পদত্যাগ করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন ও একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অশ্বিন চৌবে।
Discussion about this post