অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
কার নির্দেশে, কোথায়, কীভাবে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী খুন হয়েছিলেন, হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় সংবাদ সম্মেলন করে সবই জানিয়েছিল র্যাব। হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি আজমেরী ওসমান তখন আত্মগোপনে ছিলেন। র্যাবের তৎপরতা থেমে গেলে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমানের ভাতিজা এবং নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমান এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ অপহরণের দুই দিন পর ত্বকীর লাশ উদ্ধার হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীর শাখাখাল থেকে। ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বীর উপলব্ধি হলো, বিচারটা থেমে আছে একটি নির্দেশের অপেক্ষায়। তিনি মনে করেন, ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল শামীম ওসমানের ভাই সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান মারা যাওয়ার পর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ওসমান পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছিলেন। এরপর থেকেই ত্বকী হত্যার তদন্ত কার্যত থেমে যায়।
রফিউর রাব্বী গত বছর প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ত্বকী হত্যার বিচার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। তিনি চাইলে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, না হলে হবে না। ত্বকীর ঘাতকেরা সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। ২০১১ সালে সিটি নির্বাচনে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া, সাংসদ শামীম ওসমানের চাঁদাবাজি, তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের ভূমি দখলের প্রতিবাদে জনগণকে সংগঠিত করায় রফিউর রাব্বির ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সাংসদ ও তাঁর অনুগতরা। তাঁকে শায়েস্তা করতেই ছেলেকে হত্যা করেন তাঁরা।
১৮ বছরে ১২ খুনে জড়িত আজমেরী ওসমান!
প্রথম আলোর একটি অনুসন্ধানে বলছে, শুধু ত্বকী নয় ২০১৩ সাল পর্যন্ত ত্বকীসহ ১২ টি খুন করেছে আজরী। যার একটিরও বিচার হয়নি। বরং সংসদে শেখ হাসিনা এই খুনি পরিবারের ছাপাই গেয়ছেন।
দেখা গেছে, ২০০৯ সালের এপ্রিলে শহরের আমলাপাড়ায় ১৪ টুকরা লাশ পাওয়া যায়। মামলা হলেও পুলিশ এই খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। ২০১১ সালে শহরের প্রেসিডেন্ট রোডে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে জবাই করে খুন করা হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক জামালকে। অবৈধ অস্ত্র ও মাদক পরিবহনে রাজি না হওয়ায় তাঁকে খুন করা হয়। এই ঘটনায় মামলা হলে র্যাব-১১-এর সদস্যরা আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী গালপোড়া রঞ্জুকে গ্রেপ্তার করেন। সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পাওয়া গালপোড়া রঞ্জুকে আজমেরী ওসমান কসমেটিক সার্জারি করে তাঁর মুখমণ্ডলে পরিবর্তন আনেন।
২০১১ সালের জুনে শীতলক্ষ্যা নদীতে ব্যবসায়ী আশিক ইসলামের লাশ পাওয়া যায়। তাঁর মুখমণ্ডল ঝলসানো ও বিকৃত এবং অণ্ডকোষ থেঁতলানো ছিল। তাঁর ভাই বাদী হয়ে আজমেরীর ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগী সিজার ও সিদ্দিককে আসামি করে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেন। আজমেরীর কথা বলে সিজার ও সিদ্দিকই আশিককে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যান।
এরপর খুন হন টানবাজারের সুতা ব্যবসায়ী ভুলু সাহা। তাঁর লাশও শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায়। চাঁদা না দেওয়ায় তাঁকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হলেও রহস্যজনক কারণে খুনিদের আজও চিহ্নিত করতে পারেনি। মূলত শহরের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য, যেন তাঁরা চাওয়ামাত্রই চাঁদা দিয়ে দেন সে জন্য ভুলু সাহাকে হত্যা করা হয়। এরপর গাবতলী এলাকার বাসিন্দা মিঠুকে শহরের জামতলা এলাকায় প্রকাশ্যে খুন করা হয়। মিঠু গাবতলী এলাকায় আজমেরীর অনুগত মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। মিঠু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ঢাকাই চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় খলনায়ক আদিলের ছেলে হামীম।
খুনের সাক্ষী না রাখার জন্যই তিন দিন পরে হামীমকে কক্সবাজারে নিয়ে মদের সঙ্গে বিষ পান করিয়ে হত্যা করা হয়। সাংস্কৃতিককর্মী চঞ্চলকে খুন করা হয় গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শামীম ওসমানের পক্ষে কাজ না করে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে কাজ করার অপরাধে। সর্বশেষ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের পরপরই ওসমান পরিবারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। মিঠুর বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা খোরশেদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ফতুল্লা থানার তৎকালীন ওসি তাঁকে উল্টো ভয় দেখান আজমেরীর নাম দিলে মামলাই নেওয়া হবে না।
শুধু খুন নয়, আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে তাঁর টর্চার সেলে ধরে এনে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তাঁর বাবা নাসিম ওসমান, দুই চাচা সাবেক সাংসদ শামীম ওসমান ও বিকেএমইএ এবং নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি সেলিম ওসমানের প্রশ্রয়ে আজমেরী ওসমান শহরের উত্তর চাষাঢ়ায় একটি ও কলেজ রোডে দুটি টর্চার সেল গড়ে তোলেন। সিসি ক্যামেরা দ্বারা টর্চার সেলের আশপাশের রাস্তায় পথচারী ও যানবাহন চলাচল সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করা হতো।
ত্বকী হত্যা মামলা তদন্তের অংশ হিসেবে র্যাব-১১-এর সদস্যরা গত ৭ আগস্ট শহরের কলেজ রোডে আজমেরী ওসমানের একটি টর্চার সেলে অভিযান চালিয়ে রক্তাক্ত জিনসের প্যান্ট, রক্তমাখা গজারির দুটি লাঠি ও বস্তায় ভর্তি নাইলনের রশি জব্দ করেন। গত ১২ নভেম্বর ভ্রমরের দেওয়া জবানবন্দিতে জানা যায়, আজমেরীর নেতৃত্বে ৬ মার্চ এই টর্চার সেলেই ত্বকীকে খুন করা হয়।
২০১৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে ত্বকী হত্যা মামলার বাদী রফিউর রাব্বি বলেন, ভ্রমরের জবানবন্দিতে উল্লেখ রয়েছে, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে তাঁর অফিসে ত্বকীকে খুন করা হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক খুন করার পরও তাঁর বিরুদ্ধে একটিও মামলা নেই। কারণ, তাঁকে আসামি করে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয় না। আর এ জন্যই শামীম ওসমান বলতে সাহস পান যে তিনি নিরপরাধ। শত কোটি টাকার চাঁদাবাজি করলেও তাঁরা চাঁদাবাজ নন, জোরপূর্বক নিরীহ মানুষের ভূমি দখল করলেও তাঁরা ভূমিদস্যু নন। খুন করলেও খুনি নন। কারণ, তাঁদের নামে কোনো মামলা নেই।
Discussion about this post