ভারতীয় গণতন্ত্র সম্প্রতি একটা র্যাংকিং সমস্যায় পড়েছে। ‘পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র’ বলে যে ভারত গর্ববোধ করে – তাদের জন্য এটা উদ্বেগের খবর। স¤প্রতি বেশ কিছু সূচকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান নেমে গিয়েছে।
কী ঘটছে?
এ মাসেরই প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজ এক বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে – যার বিষয় ছিল বৈশ্বিক রাজনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতা। এতে ভারতকে ‘মুক্ত গণতন্ত্রের’ তালিকা থেকে নামিয়ে দিয়ে ‘আংশিক মুক্ত গণতন্ত্রের’ তালিকায় স্থান দেয়া হয়। গত সপ্তাহেই সুইডেন ভিত্তিক ভি-ডেম ইনস্টিটিউট গণতন্ত্র বিষয়ে তাদের সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করে।
এতে বলা হয়, ভারত একটি ‘নির্বাচন-ভিত্তিক স্বৈরতন্ত্রে’ পরিণত হয়েছে। গত মাসেই আরেকটি রিপোর্টে ভারতকে বর্ণনা করা হয় ‘ত্রুটিপুর্ণ গণতন্ত্র’ হিসেবে এবং গণতান্ত্রিক সূচকে দুই ধাপ নিচে নেমে দেশটির স্থান হয় ৫৩ নম্বরে। এ রিপোর্টটি প্রকাশ করে ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট।
‘দায়ী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি’:
এসব র্যাংকিং-এ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অধোগতির জন্য নরেন্দ্র মোদি এবং তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর ওপর চাপ বেড়েছে, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের ভীতিপ্রদর্শন করা হচ্ছে, বিশেষ করে মুসলিমদের ওপর অনেকগুলো আক্রমণ ঘটেছে। রিপোর্টগুলোতে বলা হয়, এর পরিণতিতে ভারতে রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতা কমে গেছে।
‘বাংলাদেশ ও নেপালের চাইতেও খারাপ’ : ফ্রিডম হাউস বলছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নাগরিক স্বাধীনতার অবনতি হচ্ছে। তারা আরো বলেছে যে, ‘মুক্ত রাষ্ট্রের উচ্চ কাতার থেকে ভারতের এই পতন’ বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানদন্ডের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে।
ভি-ডেম বলেছে, মি. মোদির শাসনকালে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা’ সঙ্কুচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তারা আরো বলছে, সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে ভারত এখন পাকিস্তানের মতই স্বৈরাচারী এবং বাংলাদেশ ও নেপালের চাইতেও সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ।
ডেমোক্রেসি ইনডেক্স বলছে, কর্তৃপক্ষ গণতন্ত্রকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়ায় এবং নাগরিক অধিকারের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ হওয়ায় ভারতের র্যাংকিং-এর অবনতি হয়েছে। এতে বলা হয়, মি. মোদির নীতিসমূহ ভারতে মুসলিম-বিরোধী অনুভূতি এবং ধর্মীয় সঙ্ঘাত উস্কে দিয়েছে এবং তা ভারতের গণতন্ত্রের কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া কী?
এতে বিস্মিত হবার কিছুই নেই যে, পরপর বেশ কিছু জরিপে ভারতের অবস্থান নিচের দিকে নেমে যাওয়ায় তা মি. মোদির সরকারকে বিব্রত করেছে, বিশ্বব্যাপী ভারতের গণতন্ত্রের যে ইমেজ ছিল তার ওপর একটা কালো ছায়া ফেলেছে।
ফ্রিডম হাউজের রিপোর্টটির ব্যাপারে ভারতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ভারতের প্রতিষ্ঠানসমূহ মজবুত এবং তার গণতান্ত্রিক রীতিনীতিও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত’ এবং যারা তাদের মৌলিক বিষয়গুলোই ঠিক করতে পারেনি তাদের কাছ থেকে ভারতের কোন সদুপদেশ নেবার দরকার নেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, রিপোর্টটিতে যেসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে ‘তথ্যভিত্তিক নয় এবং বিকৃত’। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের চেয়ারম্যান ভেঙ্কাইয়া নাইডু ভি- ডেমের রিপোর্ট সম্পর্কে একজন বিরোধীদলের এমপিকে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ দেননি। তিনি বলেন, ‘যেসব দেশ ভারতকে নিয়ে মন্তব্য করছে তাদের উচিৎ আগে নিজেদের দিকে তাকানো এবং তারপর ভারতকে নিয়ে মন্তব্য করা’। সবচেয়ে কড়া ভাষায় এসব রিপোর্টের সমালোচনা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর।
‘আপনি গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রের বৈপরীত্যকে ব্যবহার করছেন। আপনি সত্য উত্তর চান… একে বলা হয় ভন্ডামি। কারণ পৃথিবীতে একদল স্বনিয়োজিত মাতব্বর আছে – ভারত যে তাদের অনুমোদন চাইছে না এটা তারা এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তারা যে খেলা চায় তা ভারত খেলতে রাজি নয়’ -একটি সংবাদ নেটওয়ার্ককে বলেন মি. জয়শংকর।
‘কাজে তারাই তাদের নিয়মকানুন বা মানদন্ড আবিষ্কার করছে, তারাই রায় দিচ্ছে এবং এমন ভাব করছে যেন এটা এক ধরনের বৈশ্বিক কর্মকান্ড’।
এসব র্যাংকিং কতটা নির্ভরযোগ্য?
এটা ঠিক কথাই যে, এসব র্যাংকিং একটা বৈশ্বিক ব্যাপারই বটে। রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা বিষয়ক ফ্রিডম হাউজের সর্বশেষ বৈশ্বিক রিপোর্টটিতে ১৯৫টি দেশ ও ১৫টি টেরিটরি বা স্বশাসিত অঞ্চলের তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে।
গণতন্ত্র বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উপাত্ত হাজির করেছে বলে দাবি করে থাকে ভি-ডেম। এতে ২০২টি দেশের ১৭৮৯ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়কালের তথ্য আছে। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের তৈরি গণতন্ত্রের সূচকে ১৬৫টি দেশ এবং দুটি স্বশাসিত অঞ্চলে গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এসব র্যাংকিংএর নিয়মকানুন ও মানদন্ডও আছে।
ভি-ডেম বলছে, তারা গণতন্ত্রের বিভিন্ন দিক যাচাই করতে প্রায় ৩ কোটি উপাত্তের উৎস, সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি বিদ্বান ব্যক্তি ও একেকটি দেশ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে থাকে।
ইকোনমিস্টের ডেমোক্রেসি ইনডেক্স তৈরি করতে নির্বাচনী ব্যবস্থা বহুত্ববাদ, সরকারের কর্মপদ্ধতি, রাজনৈতিক অংশগ্রহ,ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকারের মূল্যায়নকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। ফ্রিডম হাউস বলছে, তারা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে যাতে একেকটি দেশকে তার প্রতিটি রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক অধিকারের সূচকের জন্য পয়েন্ট দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ইয়োনাটান এল মোর্স বলছেন, এটা ঠিক যে গণতন্ত্র যাচাই করার ক্ষেত্রে কাজটা কে বা কারা করছেন তার কিছুটা প্রভাব পড়তেই পারে।
অধ্যাপক মোর্স ভি-ডেমের একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলছেন, এ সমস্যাটা কাটিয়ে ওঠার জন্য নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র, এবং পরিচ্ছন্ন নির্বাচনের মূল্যায়নের লক্ষ্যে ভি-ডেম একটি ব্যাপকভিত্তিক প্রশ্নমালা তৈরি করেছে। প্রতিটি দেশের মূল্যায়ন করেন একাধিক বিশেষজ্ঞ। তাদের মতের পার্থক্য হলে সেক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের কিছু মডেল ব্যবহার করা হয় – যাতে ফলাফলকে আরো বেশি নির্ভরযোগ্য করে তোলা যায়।
তা ছাড়া বেশিরভাগ র্যাংকিং-এ গণতন্ত্রের কোন একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা চাপিয়ে দেয়া হয় না। বিশেষজ্ঞরা একমত যে একটি ‘নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র’ হচ্ছে একেবারেই ন্য‚নতম পূর্বশর্ত।
ভারতের এই অবনতি কি অস্বাভাবিক?
র্যাংকিং-এর দিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হয়, মানুষের মনে এর আবেদন যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক না কেন – সারা পৃথিবীতেই আসলে গণতন্ত্র এখন নানা সমস্যায় আক্রান্ত। ভি-ডেমের মতে, পৃথিবীর ৮৭টি দেশে এখন নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র চালু রয়েছে এবং এসব দেশে বাস করে পৃথিবীর ৬৮% মানুষ।
সংস্থাটি বলছে, লিবারেল বা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা এখন কমে যাচ্ছে এবং এসব দেশে বাস করে পৃথিবীর মাত্র ১৪% মানুষ। ফ্রিডম হাউসের মতে পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশেরও কম লোক এখন ‘মুক্ত’ দেশে বাস করে। ১৯৯৫ সালের পর থেকে এ সংখ্যা এখন সবচেয়ে কম। তাছাড়া ২০২০ সালের ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে দেখা যায়, ১৬৭টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে মাত্র ৭৫টি- অর্থাৎ মাত্র ৪৪.৯% দেশকে এখন গণতান্ত্রিক বলে মনে করা হয়।
অধ্যাপক মোর্স বলছেন, ‘কিন্তু যা অনেককে উদ্বিগ্ন করছে তা হলো প্রতিষ্ঠিত দেশে গণতন্ত্রের ভেঙে পড়া। হাঙ্গেরি এবং তুরস্কের পর ভারত হচ্ছে এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত’।
‘বিশেষ করে ভারতের দৃষ্টান্তটি চোখে পড়ার মত, কারণ এর জনসংখ্যার আকার এবং বহু-জাতিগোষ্ঠীর গণতন্ত্রের একটি সফল দৃষ্টান্ত হিসেবে তার অতীতের রেকর্ডের নিরিখে’। তিনি বলছেন, গণতন্ত্রের ভেঙে পড়ার ক্ষেত্রে অন্য কিছু দেশে যা হয়েছে, ভারতে সেই একই প্যাটার্ন অনুসৃত হচ্ছে।
‘পপুলিস্ট নেতারা প্রথমে আমলাতন্ত্র বা বিচারবিভাগীয় নিয়োগগুলোকে রাজনীতিকীকরণ করার মত পদক্ষেপ নিয়ে রাষ্ট্রের ‘গেটকিপারদের’ কব্জা করে ফেলে। তারপর তারা মিডিয়া সেন্সরশিপ, একাডেমিক স্বাধীনতা সীমিত করা বা নাগরিক সমাজকে সঙ্কুচিত করার মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন করে’।
‘পপুলিস্ট নেতারা প্রায়ই সমাজে এমন মেরুকরণ ঘটায় যে রাজনৈতিক বিরোধিতা বৈধতা হরণ করা হয়, তাদেরকে প্রায়ই রাষ্ট্র বা জনগণের শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এরপর যা হয় তা হলো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নষ্ট করা বা সরাসরি জালিয়াতির পথ নেয়া’।
এসব র্যাংকিংএ কি ডানপন্থী সরকার-বিরোধী পক্ষপাত দেখা যায়? : শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক পল স্ট্যানিল্যান্ড ভারত সম্পর্কে ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত ভি-ডেমের ডেমোক্রেসি ইনডেক্সের মূল্যায়ন পরীক্ষা করে দেখেছেন। তিনি দেখেছেন ১৯৭০-এর দশকে সাবেক কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন নাগরিক অধিকার স্থগিত করেছিলেন – তখন ভারতের র্যাংকিং এখনকার চাইতে খারাপ ছিল।
দেখা যায় যে, ১৯৫০ বা ৬০-এর দশকের চাইতে ১৯৯০-এর দশক অপেক্ষাকৃত বেশি গণতান্ত্রিক ছিল এবং সেই দশকটিতে ছিল কংগ্রেসেরই প্রাধান্য। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিজেপি-নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের সময়ও ভারতের র্যাংকিং-এর তেমন কোন অবনতি হয়নি।
অধ্যাপক স্ট্যানিল্যান্ড বলছেন, ‘সুতরাং সরাসরি দক্ষিণপন্থা-বিরোধী পক্ষপাত আছে এমনটা বলা যায় না। এমনকি ২০০৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট ক্ষমতাসীন থাকার সময়ও সূচকে ভারতের অবস্থান সামান্য নেমে যেতে দেখা যায়’।
‘এসব র্যাংকিংয়ের সাথে একমত হতে কেউ কাউকে বাধ্য করছে না’ -বলেন অধ্যাপক স্ট্যানিল্যান্ড। ‘তবে এমন মনে করার অনেক কারণ আছে যে, এগুলোতে বৃহত্তর চিত্র বা গতিপথ ধরা পড়ে’।
এসব র্যাংকিং কতটা কাজে লাগে?
ইয়েল-এনইউএস কলেজের রাজনীতি বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক রোহান মুখার্জি বলছেন, এসব র্যাংকিং নানা গবেষণায় এবং বৃহত্তর প্রবণতা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কাজে লাগে। গণতন্ত্র বলতে আমরা কী বুঝি এবং গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কে নির্ধারণ করছেন – এসব প্রশ্নেও এরকম র্যাংকিংগুলো কাজ দেয়।
অধ্যাপক মুখার্জি বলছেন, একাডেমিক ক্ষেত্রের বাইরের লোকেরা এ ব্যাপারটা পছন্দ করেন না যে, একদল গবেষণা সহকারী ও বিশেষজ্ঞ মিলে একটি দেশকে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের তকমা দিচ্ছে – যার সাথে সেই দেশের কোটি কোটি মানুষ হয়তো একমত নয়।
তার কথায়, ‘আসলে এটা একটা ‘একাডেমিক’ বিতর্ক যা মানুষের জীবনের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার থেকে অনেকটা দূরের ব্যাপার।… কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তাদের অভিজ্ঞতা সঠিক নয়। কিন্তু এতে আবার এই সংযোগহীনতারও একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়’।
সূত্র : বিবিসি বাংলা।
Discussion about this post