ফারাহ মাসুম
স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উত্তরণের বিষয়টিকে বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবময় অর্জন হিসেবে তুলে ধরা হলেও এটি দেশের অর্থনীতিকে নজিরবিহীন চাপে ফেলবে। এর ফলে রফতানি বাজারে বাংলাদেশের ট্যারিফ সুবিধা যেমন সংকুচিত হয়ে যাবে, তেমনিভাবে রেয়াতি সুদ ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিশোধের শর্তে যে উন্নয়ন সহায়তা দেশ লাভ করে আসছিল, তা আর থাকবে না। একই সাথে বিশ্ব সংস্থাসমূহে বাংলাদেশের প্রদেয় চাঁদাও বেড়ে যাবে। অরেয়াতি সুদে ঋণ গ্রহণে বাধ্য হওয়ায় সুদের চাপ বাড়বে বাজেটে। কৃষিসহ বিভিন্ন অগ্রাধিকার খাতে বাংলাদেশ যে ভর্তুকি দিয়ে আসছিল, তা প্রত্যাহারে চাপ বাড়বে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। তাই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই সুখবরের আড়ালে লুকিয়ে আছে বিষাদের ছায়া।
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট (সিডিপি) গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে এই সুপারিশ করে। এই চূড়ান্ত সুপারিশের ফলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের এই চূড়ান্ত সুপারিশ লাভকে সমগ্র জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের এই উত্তরণ এমন একসময়ে ঘটল, যখন আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি; সেই সাথে আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের জন্য এ উত্তরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা ইউএন-সিডিপির সব মানদ- পূরণ করে ২০১৮ সালে। জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোনো দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদ- পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়।
সিডিপি তিনটি সূচকের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করে অনেক এগিয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ মানদ-ের চেয়ে প্রায় ১ দশমিক ৭ গুণ বেশি। মানবসম্পদ সূচকে নির্ধারিত মানদ- ৬৬-এর বিপরীতে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫.৪। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে উত্তরণের জন্য মানদ- নির্ধারিত ছিল ৩২ বা তার কম। কিন্তু ওই সময়ে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৭।
এবার বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল ও লাওসকেও এলডিসি থেকে বের হবার সুপারিশ করা হয়েছে। সিডিপির পরপর দুবারের ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে নির্দিষ্ট মান অর্জন করলে এ ধরনের সুপারিশ করা হয়।
২০২১ সালের সিডিপির এ মূল্যায়নে বাংলাদেশের পাশাপাশি লাওস ও মিয়ানমার নির্দিষ্ট মান অর্জন করেছে। কিন্তু মিয়ানমারকে সুপারিশ করেনি সিডিপি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করায় উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এলডিসি থেকে দেশটির বের হওয়ার সুপারিশের বিষয়টি ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। অন্যদিকে নেপাল ২০১৮ সালেই দ্বিতীয়বারের মতো মান অর্জন করেছিল। কিন্তু ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ওই বছর সুপারিশ করা হয়নি।
এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে রফতানি খাতে। কারণ এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধা পায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নে কোনো কোনো দেশ অবশ্য দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও (যেমন ভারত, চীন) এই ধরনের শুল্ক-সুবিধা পেয়ে থাকে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এলডিসি হিসেবে পাওয়া সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় এই শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত।
এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে রেয়াতি সুবিধাপ্রাপ্ত বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। সম্প্রতি প্রকাশিত ডব্লিউটিওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বাড়তি শুল্কের কারণে রফতানি বছরে ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে।
বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে ওষুধশিল্পকে। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে হয় না। এর কারণ মেধাস্বত্বের (পেটেন্ট) ওপর অর্থ দেওয়া হলে ওই ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। এ কারণে এলডিসির গরিব নাগরিকরা স্বল্পমূল্যে ওষুধ পাবে না। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এই সুবিধা বেশি পেয়েছে। এতে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। ২০৩৩ সালের আগে যদি কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যায়, তবে ওষুধশিল্পের এই সুবিধা থাকবে না। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এই সুবিধা শেষ হয়ে যাবে।
প্রতিটি এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশের ওপর প্রভাব হবে ভিন্ন ভিন্ন। এটি নির্ভর করে ডব্লিউটিওতে অংশগ্রহণ, বাজার অ্যাক্সেসের সুযোগ বা উন্নয়ন সহযোগিতার ওপর। এ হিসাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অন্যদের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।
বাজার অ্যাক্সেসের ওপর প্রভাব: অগ্রাধিকারের মার্জিন হ্রাসের ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর এলডিসিগুলোর জন্য সর্বাধিক প্রাসঙ্গিক উন্নত দেশের বাজার হলো ইইউ এবং কিছুটা হলেও কানাডা ও জাপান। এই বাজারগুলোয়, বেশিরভাগ এলডিসি রফতানি শুল্কমুক্ত প্রবেশ করে। বাংলাদেশের রফতানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (প্রধানত পোশাক) এই বাজারগুলোর জন্য নির্ধারিত। ইইউর বাজারে ইবিএ স্কিমের আওতায় পোশাকের ক্ষেত্রে প্রায় ১০ শতাংশ এবং নির্দিষ্ট মাছের পণ্যের মধ্যে ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক রেয়াত দেয়া হয়। এই রেয়াত উঠে গেলে বাংলাদেশ ও নেপালের জন্য গড় শুল্ক বৃদ্ধি হবে যথাক্রমে ৮.৯ শতাংশ এবং ৮.১ শতাংশ।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বাংলাদেশের রফতানিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে, যাতে রফতানি ১৪ শতাংশ কমতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অন্যান্য উত্তরণ হওয়া এলডিসিগুলো রফতানি হ্রাসের প্রত্যাশিত প্রভাব মাত্র ১ শতাংশের মতো।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন এর চ্যালেঞ্জের আরেকটি ক্ষেত্র হলো উত্তরণ হওয়া এলডিসিগুলোয় উন্নয়নের সহায়তার প্রভাব। এলডিসি দেশগুলো বিশ্বব্যাংক গ্রুপ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ থেকে নামমাত্র সার্ভিস চার্জে (১ শতাংশের কম) দীর্ঘ মেয়াদে পরিশোধযোগ্য (৩০-৪০ বছরে) উন্নয়ন সহায়তা লাভ করে। এটি আর থাকবে না। উন্নয়নশীল দেশ হবার পর বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক সুদে উন্নয়ন ঋণ গ্রহণ করতে হবে। এতে সুদের চাপ তিন-চার গুণ বেড়ে যাবে। বিদেশি দায়ের স্থিতিও দ্রুত বেড়ে যাবে।
আসলে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ কোনো দেশ চেষ্টা করে হয়Ñ এমনটা নয়। সহ¯্রাব্ধের লক্ষ্যমাত্রার মতো এমন কিছু উন্নয়ন লক্ষ্য বিশ্ব সংস্থা থেকে থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়, যাতে এ লক্ষ্যগুলো অর্জনের সাথে সাথে স্বল্পোন্নত হিসেবে দেয়া সুবিধাগুলো বন্ধ করে দেয়া যায়। এটি বিশ্ব সংস্থাগুলোর ওপর সহায়তাদানের চাপ কমায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে; বিশেষত সামাজিক সূচকগুলোয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যতটা অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি সরকারের ক্রেডিট অর্জনের জন্য অগ্রগতি দেখানো হয়েছে। এ কারণে রেয়াতি সুবিধাগুলো উঠে গেলে হঠাৎ করেই চাপের মধ্যে পড়ে যেতে পারে দেশ।
এলডিসি হিসেবে যেকোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন কৃষি ও শিল্প খাতের নানা পণ্য বা সেবায় ভর্তুকি দেয়। এসব ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করার চাপ আসতে পারে। এমনকি বাংলাদেশ এখন যে রফতানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে।
এলডিসি থেকে বের হলে জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশকে আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে। এছাড়া স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সরকারি কর্মকর্তারা জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় যোগ দিতে সৌজন্য টিকিট পান। গরিব দেশের কর্মকর্তা হিসেবে এই টিকিট দেওয়া হয়। ২০২৬ সালের পর এ ধরনের বিনা পয়সার টিকিট মিলবে না। আবার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বৃত্তি দেয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এ ধরনের বৃত্তির সংখ্যা কমে যাবে।
প্রশ্ন হলো এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে কী ধরনের লাভ হতে পারে। এলডিসি থেকে বের হলে প্রথমে যে লাভটি হবে, তা হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল দেখাবে। গরিব বা স্বল্পোন্নত দেশের পরিচয় থাকবে না। পুরোপুরি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হবে। অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে অনেক বেশি ঋণ নিতে পারবে। বেশি ঋণ নিতে পারলে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে আরও বেশি খরচ করতে পারবে বাংলাদেশ। আবার অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা মোকাবিলায় যথেষ্ট সক্ষমতা থাকায় বিদেশি বিনিয়োগও আকৃষ্ট হবে। অবশ্য বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ পরিবেশ বড় ভূমিকা পালন করে।
সুযোগ-সুবিধা কমার চ্যালেঞ্জ উত্তরণের জন্য সামনে যে ক’বছর উত্তরণ কার্যকর হবার সময় অবশিষ্ট রয়েছে, সে সময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রফতানি বাজারগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর করা গেলে বাজারে প্রবেশাধিকারের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। একই সাথে উন্নয়ন অর্থের এখন যে ধরনের অপচয় হচ্ছে, সেটা বন্ধ করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশে উন্নয়ন ব্যয় তুলনীয় দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। এর বড় কারণই হলো, দুর্নীতি ও অপচয়। এসবের রাশ টেনে ধরতে না পারলে এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে যে অর্র্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে বাংলাদেশ পড়বে, তা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না।
Discussion about this post