কারাগারে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা নতুন কথা নয়। টাকা তবে এবার কাশিমপুর কারাগারে হলমার্কের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমদের সঙ্গে বাইরের এক নারীর সময় কাটানোর ঘটনায় কারাগারের নিরাপত্তা ফের প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের কারাধ্যক্ষ সোহেল রানা বিশ্বাসকে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, দুই কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর, এক কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক, ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে রেলওয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে৷
গত বছরের আগস্টে কাশিমপুর কারাগার থেকে ১২ ফুট উচ্চতার মই বানিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যায় আবুবকর সিদ্দিক নামে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত এক কয়েদি৷
নাজমুল হুদা করোনার আগে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন প্রায় দুই মাস৷ সেই অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেন ডয়চে ভেলের কাছে৷ তার কথা, ‘‘কারাগারে টাকা হলে সব পাওয়া যায়৷ করা যায় সব কিছু৷”
তার ভাষায় কারাগারের ভিতরটা হলো একটা অবৈধ ব্যবসা কেন্দ্র৷ সেখানে রয়েছে নানা ধরনের সিন্ডিকেট৷ এই সিন্ডিকেটে কয়েদিরা যেমন আছেন তেমনি বাইরের লোকও আছেন৷ তবে সবার উপরে আছে কারগারের কিছু অসাধু কর্মকর্তা৷
কারাগারের ভিতরে বিভিন্ন ব্লক অবৈধভাবে লিজ দেয়ার অভিযোগও রয়েছে৷ মাসিক দুই লাখ আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে এই লিজ নেন কয়েদিদের একটি সিন্ডিকেট৷ যারা কারাগারে যান, তারা কেথায় থাকবেন, কতটা ভালো থাকবেন তা নির্ভর করে তাদের ওপর৷ টাকার বিনিময়ে তারা এই সুবিধা দেন৷ কারাগারে সাধারণভবে বুথে গিয়ে টেলিফোনে কথা বলার সুযোগও আছে৷ কিন্তু এর বাইরে মোবাইল ফোনে সেলে বসেই ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলার সুযোগ আছে৷ এর জন্যও দিতে হয় টাকা৷ কারারক্ষীদের সিন্ডিকেট এই মোবাইল ফোন ব্যবসায় জড়িত৷ তারাই রাতে ফোন সরবরাহ করে আবার সকালে নিয়ে যায়৷
নাজমুল হুদা আরো দাবি করেন, কৌশলে কারাগারে মাদক ঢোকানো হয়, কারাগারের ভেতরেই টাকার বিনিময়ে ইয়াবা ও গাঁজাসহ আরো অনেক মাদক পাওয়া যায়৷ কারাগারের ভেতরেই একটি সিন্ডিকেট এই মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে বলেও জানান তিনি৷
নাজমুল জানান, ‘‘বাইরে থেকে মনে হবে কঠোর নিরাপত্তা৷ কিন্তু এইসব সিন্ডিকেটের কারণে বাস্তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল৷”
কাশিমপুর কারাগারে যে ঘটনা ঘটেছে এটা নতুন নয়৷ করোনার কারণে এখন বন্দিদের সাথে স্বজনদের দেখা সাক্ষাৎ অফিসিয়ালি বন্ধ থাকলেও কথিত ‘ভিআইপি’ ব্যবস্থাপনায় সবই সম্ভব৷ আর স্বাভাবিক সময় টাকা দিলেই ভিআইপি ব্যবস্থাপনায় বাইরের লোকজন কারাকন্দিদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারেন৷ আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা হয়৷ এটা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য৷
রাশেদুল ইসলাম সানি গত সপ্তাহেই কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘করোনার সময় দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ থাকলে ১০-১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে দেখা করার ব্যবস্থা ছিল৷” তিনিও নাজমুলের মতো কারাগারে নানা ধরনের সিন্ডিকেটের কথা জানান৷ তিনি জানান, ‘‘করোনার কারণে ওই সিন্ডিকেট এখন কারাগার থেকে বাইরে মোবাইল ফোনে কথা বলার জন্য প্রতি তিন মিনিটে ১০০ টাকা নেয়৷”
তদন্তকমিটিযাবলেছে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি এক বছর আগে কারাগারে অনিয়ম ও দুর্নীতির যেসব খাত খুঁজে পেয়েছে সেগুলো হলো: ক্যানটিনের অনিয়ম, বন্দি বেচাকেনা, সাক্ষাৎ-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য, খাবার-বাণিজ্য, চিকিৎসা, পদায়ন, জামিন-বাণিজ্য৷
কারগারেটাকা দিলে শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে যে কেউ অসুস্থ না হয়েও কারা হাসপাতালে আরাম-আয়েশে থাকতে পারেন৷ টাকা বেশি হলে বাইরের হাসপাতালেও থাকার সুযোগ আছে৷ আর জামিনের আদেশ কারাগারে যাওয়ার পর টাকা না দিলে বন্দিরা ছাড়া পান না৷
কারাগারেএখন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আসামিরা যেমন আছেন, তেমনি আছে বিভিন্ন সময় আটক জঙ্গিরাও৷ এছাড়া পেশাদার আরো অনেক সন্ত্রাসীও আছে৷ দেশের ৬৮টি কারাগারে মোট বন্দি ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৪৫০ জনের৷ কিন্তু আছে তার প্রায় দ্বিগুণ ৮২ হাজার ৬৫৪ জন৷ তাদের মধ্যে মধ্যে পুরুষ ৭৯ হাজার ৪৫৪ জন ও নারী ৩ হাজার ২০০ জন৷
দেশের বিভিন্ন কারাগারে এখন আটক জঙ্গি সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৯১২৷ এর মধ্যে ১ হাজার ৭৩৩ জনই জামিনে মুক্ত রয়েছেন৷
আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান মামুন বলেছেন, ‘‘আটক জঙ্গিদের কারাগারের বিশেষ নিরাপত্তা এলাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারগুলোতে হাই সিকিউরিটিতে রাখা হয়৷ তারা তাদের স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ বা ফোনে কথা বলার সুযোগ পান না৷ সাধারণ বন্দিদের সাথে তাদের দেখা হওয়া বা কথা বলার সুযোগ নাই৷”
কারাগারে নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা আছে৷ এর বাইরে ওয়াচ টাওয়ার ও প্রচলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে৷ তার কথা, ‘‘কাশিমপুর কারাগারে বন্দির সাথে গিয়ে এক নারীর সময় কাটানো সেটা আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেমেই ধরা পড়েছে৷ আমাদের কাছেই আগে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আসে৷ গণমাধ্যমে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশ হওয়ার আগেই আমরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে শুরু করি৷ দুইজনকে প্রত্যাহার করার পর তদন্ত চলছে৷ আর যে বন্দি এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে৷”
তিনি এই ঘটনার পর ডিআইজি প্রিজনস এবং সব জেলারের সাথে বৈঠক করে আরো কিছু আধুনিক নিরপত্তা ইকুইপমেন্ট ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানান৷ আর কারাগারে দুর্নীতির কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘আমরা চেষ্টা করছি এগুলো বন্ধ করার৷”
সাবেক ডিআইজি প্রিজন মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী তার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, কারাগারে কিছু কর্মকর্তা এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত৷ দেখা যাবে ঘুরে ফিরে তারাই বড় বড় কারাগারে পোস্টিং নিচ্ছেন৷ তাদের ট্র্যাক করলেই আসলে কারা কী করেন তা জানা সম্ভব৷ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেই বার বার একই ধরনের ঘটনা ঘটে৷ তার কথা, ‘‘এখন বন্দিদের জন্য কিছু কারাগারে সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হলেও অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে৷ যেসব কারাগারে বেশি বন্দি, সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতিও বেশি৷”
সূত্র: ডয়েস ভেলে