বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। পত্রিকা খুললে প্রায় প্রতিদিনই মানুষের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার লোক আত্মহত্যা করেন, যাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি৷ বয়সের হিসেবে তরুণ-তরুণীরাই বেশি আত্মঘাতী হচ্ছেন৷ তবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এরচেয়ে আরো ১০ গুণ বেশি মানুষ৷
সেসব খবরের আলোকে আত্মহত্যা বিষয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ নীচে তুলে ধরা হলো:
আত্মহত্যার কিছু কারণ:
আত্ম বা নিজেকে হত্যা করাই আত্মহত্যা হলেও এর পেছনে যে শুধু আত্মহত্যাকারীই দায়ী এমনটা নয়। এর পেছনে পারিপার্শিক অনেক কারণ ও প্ররোচনা থাকতে পারে। আত্মহত্যা বন্ধ করতে শুধু ব্যক্তিকে মোটিভেশন দিয়ে নয় এই প্ররোচিতকারী কারণগুলোও চিহ্নিত করে দূর করা দরকার। আত্মহত্যার সাধারণ কিছু কারণ-
১. প্রচণ্ড হতাশা
আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। তারপরও ব্যবসায় ব্যর্থতা, পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা,ঋণের চাপসহ নানামুখী সঙ্কটে প্রচণ্ডভাবে হতাশ হয়ে মানুষ যদি কখনো ভেবে বসে তাকে দিয়ে আর কিছু সম্ভব নয় তার আর উপায় নেই, আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয় তখন মানুষ আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে।
২. সমাজস্থ মানুষের সংকীর্ণমনতা:
ব্যর্থতা, দুর্ঘটনা, প্রতিবন্ধকতা,বেকারত্ব বা পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার কারণে সমাজের মানুষের খোঁটা, কটু কথা, বাঁকা চোখে তাকানোর শিকার হওয়া আত্মহত্যার পেছনে বড় প্ররোচক হিসেবে কাজ করে।
৩. মর্যাদা ও মূল্যবোধ হারানো:
অপমান ও অবহেলার কারণে কেউ যখন মানুষ হিসেবে তার সম্মানটুকু হারিয়ে ফেলে তার থেকে যেকোনো ঘটনা ঘটতে পারে। নিজের পরিবার, ও প্রিয়জনদের থেকে অপমান অবহেলা ও দোষারোপই এক্ষেত্রে বেশি বিপজ্জনক । আমি সমাজের অনেক বাবা মাকে ছেলের প্রতি বিরক্ত হয়ে বলতে শুনেছি “তুই মরিস না কেন?” বাবা মা রাগের বশে বা মন থেকে না বললেও এটা খুবই ভয়ঙ্কর।
৪. প্রতিশোধ:
মিথ্যা অপবাদ, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে এর জন্য যারা দায়ী তাদেরকে আজীবন দোষী করে রেখে যেতে অনেকে আত্মহত্যা করেন। তিনি মনে করেন আত্মহত্যার পর ঐ লোকেরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তার জন্য কাঁদবে, আফসোস করবে। আসলে তাতে কোনো লাভ নেই।
৫. পরকালে অবিশ্বাস:
যারা পরকালে অবিশ্বাস করে তাদের জন্য আত্মহত্যা করা সহজ কারণ তারা মনে করে আত্মহত্যা করে দুনিয়া থেকে মুক্তি পেলাম ব্যস।
বেঁচে থাকার কারণ:
দুঃখ, কষ্ট, ব্যর্থতা ও হতাশা আমাদের সবার জীবনেই আসে, আমরা অনেকেই জীবনে কখনো কখনো প্রচণ্ড অভিমানী হই, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবি, তাই বলে কি আমরা সবাই আত্মহত্যা করি? করি না। এরও কিছু কারণ আছে যেমন-
ক. আমাদের অধিকাংশ মানুষের জীবনের আশার দিকটাই শক্তিশালী ।
খ. হতাশার পর বেঁচে থাকার আরও কারণ আছে সেটা আমরা নিজেরাই বের করে ফেলি।
গ. আমরা আত্মহত্যা মহাপাপ বলে জানি, পরকালে বিশ্বাস করি পরকালীন জীবনকে নষ্ট করতে চাই না।
ঘ. ব্যর্থতার অপবাদ ঘোচাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে বড় কিছু করে দেখিয়ে দেব
ঙ. কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠায় আমরা বেঁচে থাকার মূল্য বুঝি।
আত্মহত্যা মহাপাপ কেন?
আমার দেহ আমার হলেও এটা আমি নিজে বানাই নি। অন্য একজনকে যেমন হত্যা করার অধিকার আমার নেই তেমনি নিজেকে হত্যা করার অধিকারও নেই। কঠোর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও আমরা যদি ভেবে দেখি- একজন মানুষ যদি আরেকজন মানুষকে হত্যা করে সেখানে, শাস্তিভোগের পর দায়মুক্তি, প্রায়শ্চিত্য , ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ থাকে এবং সর্বোপরি আল্লাহর কাছে তওবার সুযোগ থাকে কিন্তু আত্মহত্যায় এগুলোর কোনোটারই সুযোগ থাকে না।
শিশুদের আত্মহত্যা:
সম্প্রতি শিশুদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিয়েছে, পরীক্ষায় খারাপ করায় বাবা মার বকুনি,পছন্দের জামা কিনে না দেওয়া, মোবাইল কিনে না দেওয়ায় আত্মহত্যার মত বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। সমস্যা হল বড়দের ক্ষেত্রে যেভাবে বেঁচে থাকার মোটিভেশন কাজ করে শিশুদের ক্ষেত্রে সেটা একইভাবে কাজ করে না। সেক্ষেত্রে কী করণীয় হতে পারে-
ক. চাওয়ামাত্রই শিশুদের কোনো আবদার যদি পুরণ করেন তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে এই মানসিকতা তৈরি হয় যে এগুলো পাওয়া সহজ। বহু আবদার পূরণের পরও যদি কোনো একদিন কিছু দিতে সমর্থ না হন শিশুটি ভেবে নিতে পারে তাকে আর আপনি ভালো বাসেন না, তার আর গুরুত্ব নেই। এর থেকে আত্মহত্যার চিন্তা করতে পারে। এজন্য চাওয়ামাত্রই কিছু আবদার না মিটিয়ে জীবন যে কঠিন শিশুকে এটা বোঝার সুযোগ দিন। ওদের শক্ত হতে দিন।
খ. পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেই সব শেষ হয়ে যায় না। জীবনে অনেক কিছু করার আছে অনেক সুযোগ পড়ে আছে এটা বুঝতে দিন। আপনার মানসিকতাই যদি পাস ফেল বা ভালো রেজাল্টে আটকে থাকে শিশুরা সাহস পাবে কার থেকে।
গ. শিশুদেরকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলবেন না যার সমাধান করা সামর্থ্য আপাতত শিশুটির নেই।
ঘ. এখনকার শিশুরা ৮০-৯০ এর দশকের শিশুদের থেকে বেশি সংবেদনশীল, বেশি বিলাসী আবার মধ্যবিত্ববিত্ত পরিবারের শিশুদের থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরা বেশি সংবেদনশীল তাই এখন শিশুদের এখনকার মত করেই দেখা উচিৎ।
পরিশেষে বলবো, আমাদের সময়ে মৌলিক চাহিদাগুলো ছাড়া অন্যান্য আবদারগুলো ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা মার কাছে অপশনাল। যা চেয়েছি মোটামুটি ৯৮ ভাগই পাইনি। আমাদের মানসিকতাও ছিল দিলে দেবে না দিলে নাই টাইপের। বকুনি যা শুনেছি তা লিখলে মহাকাব্য হবে। অনেকেই জীবনে পিটুনি যা খেয়েছি তা কোনো মহাযুদ্ধের সমানও হতে পারে। তারপরও সেসময় আত্মহত্যা তো দূরের কথা চিন্তা করার সাহসও আমাদের কারো হত না। আমরা বুঝেছি জীবনের কত দাম, বেঁচে থাকার কত মূল্য…।
এরপরও কখনোই কারো ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয় যে সে কখনো আত্মহত্যা করবে না। কারণ রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ও প্রচণ্ড হতাশায় মানুষের হিতাহিত জ্ঞানই থাকে না। এজন্য খেয়াল রাখতে হবে একজন মানুষ যেন আত্মহত্যার চিন্তা করার মত পরিস্থিতিরই শিকার না হয়।