– রুদ্র আহনাফ
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ। সারাদেশের মানুষ যখন ঈদ উৎসবে মেতে উঠার কথা, তখন ভাগ্যাহত উপকূলবাসী নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে দিনাতিপাত করছে। প্রলয়ঙ্কারি ঘূর্ণিঝড় আম্পান কেড়ে নিয়েছে তাদের বসতভিটার শেষ অংশটুকুও। ঈদের উৎসবে তাদের মনযোগ দেয়া অসম্ভব। বরং প্রাণ বাঁচাতে তারা নেমে পড়েছেন বাঁধ নির্মাণে। গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুলনা জেলার কয়রা এলাকার ব্যতিক্রমি কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায় জোয়ারের পানিতে প্লাবিত জমিতে দাঁড়িয়েই ঈদের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করছেন এই ভাগ্যাহত জনপদের মানুষেরা। এ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই বামপন্থী নাস্তিক্যবাদী কিছু গণমাধ্যম তাদের একগুয়েমি চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারেনি। দক্ষিণাঞ্চলের ভাগ্যাহত মানুষের কাছে না গিয়েই এসি রুমে বসে থেকে সময় টিভির সাংবাদিক লিখে দিলেন ‘পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ, পরিকল্পনা জামায়াতের-মদদে উপজেলা চেয়ারম্যান!’ আর তারপর মনগড়া মিথ্যাচারে তার আঙুলের দক্ষতা কতটুকু, তা প্রদর্শনের ব্যাপক চেষ্টা করলেন।
সময় টিভি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে খুলনার কয়রায় জামায়াত নেতাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়েছে। আর এতে মদদ ছিল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যান। হয়তো এখানেই সরকার বিরোধী মারাত্মক ষড়যন্ত্র খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন এই কথিত সাংবাদিক। অথচ নির্মম বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় আম্পানে দেশের দক্ষিণাঞ্চল লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার পর ৫ দিন পার হয়ে গেলেও যখন সরকারি কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তখন জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমীর তমিজ উদ্দিন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে বাঁধ নির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুধু ঈদের নামাজের নেতৃত্ব নয়। তার উদ্যোগে যে এত বড় বাঁধ নির্মাণে দল-মত নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ আন্তরিকতার সাথে অংশ নিয়েছে তা কি আর বদ্ধ এসি রুমে বসে অনুমান করা যায়! সময় টিভির কথিত এই সাংবাদিক হয়তো সেই ব্যর্থ চেষ্টাটাই করেছেন।
এবার চলুন একটু বাস্তবতা দেখে নেওয়া যাক। গত ২০ শে মে সুপার সাইক্লোন আম্পানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার একটি কয়রা উপজেলা। এই সাইক্লোনে মানুষের ঘর, গাছসহ অনেক কিছু ভেঙে যায় এবং সবথেকে বড় বিষয় উপজেলার ৭ টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নে নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে জেলার দক্ষিণ বেদকাশি, জোড়শিং বাজার, চোরামোখা, গোলখালী, উত্তর বেদকাশি গাজীপাড়া, ঘাটাখালী এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়। বাড়ি ঘর ও ফসল হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পরে লাখো মানুষ। কিন্তু এত ভয়ানক ঝড়ের পরেও সরকারি কোন জরুরী পদক্ষেপ দেখতে না পেয়ে নিজেদের স্বেচ্ছাশ্রমে গত ২২শে মে থেকে বাঁধ নির্মাণের কয়েক দফা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় জনগণ। ধীরে ধীরে ভাঙনের পরিধি আরও বাড়তে থাকে।
এরপর স্থানীয় জামায়াত নেতা তমিজ উদ্দিনের আহ্বানে ঈদের দিন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ বাঁধ নির্মাণে অংশ নেয়। স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নেয়া জনগণের চলমান কাজের এক পর্যায়ে জোয়ারের পানি চলে আসলে কাজ চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয়নি। সে পরিস্থিতিতে কি করার ছিলো? প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ কি নতুন ঈদগাহ তৈরী করে সেখানে ঈদের সালাত আদায় করবে? তা কি সম্ভব? ফলে কাজে অংশ নেয়া এই বিপুল সংখ্যক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এবং কাজের উৎসাহ ধরে রাখতে সেখানেই ঈদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়। জনগণ অত্যন্ত আগ্রহের সাথে সেই ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করে।
এখন প্রশ্ন হলো, এরমধ্যে সময় টিভির কথিত সাংবাদিক কেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন? কেনই বা তিনি এমন জনমুখী একটি কার্যকর উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করলেন? কেন তিনি এসবের মধ্যেও মাথামোটা আওয়ামী নেতাদের মত বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র খুঁজতে গেলেন? উত্তরটা খুবই সোজা। শহুরে বুর্জোয়া পরিবেশের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা এসব কথিত সাংবাদিকরা স্বভাবতই উগ্র নাস্তিক্যবাদে আকৃষ্ট। তাই মানুষকে চরম বিপদ মূহুর্তেও সিজদাবনত দেখলে এদের গাত্রদাহ হয়। শরীর পুড়ে ওঠে। ভয়ানক অ্যালার্জি অনুভূত হয়। ফলে যেকোনো ভাবে তারা এর বিরোধীতায় অংশ নিয়ে থাকে। কিন্তু এতে যে ফলাফল তার বিরুদ্ধেই চলে যায় তা বুঝার মত চিন্তার গভীরতা তাদের থাকে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে তো আর জনগণের দূর্দশা উপলব্ধি করা যায় না। ফলে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য এতটুকু ভেবে দেখার প্রয়োজনীয়তাও তারা উপলব্ধি করে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট