অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
প্রাণঘাতী করেনায় থেমে নেই আক্রান্তর হার। মৃত্যুর মিছিলও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। করোনা পরিস্থিতি এখন ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। কোনো প্রকার উপসর্গ ছাড়াই মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। কে সুস্থ আর কে আক্রান্ত সেটা এখন পরীক্ষা করা ছাড়া ডাক্তাররাও বলতে পারছে না। টেস্ট যত বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও তত বাড়ছে। সারা দেশে যখন ২৪ ঘন্টায় অক্রান্তের সংখ্যা সর্বাধিক তখন গার্মেন্টস খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ক্ষমতাসীন সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার তথ্য গোপন, ক্ষমতাসীনদের অব্যবস্থাপনা, সমন্বয় হীনতার বলি হচ্ছেন গার্মেন্টস কর্মীরা। তারা বলছেন ক্ষমতাসীনরা প্রণোদনার নামে সুদে টাকার যে কৌশল চালু করেছে এটা শ্রমিকদের সাথে এক ধরনের প্রতারণা।
ক্ষমতাসীনদের অব্যবস্থাপনা
করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা যখন প্রতিদিন দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ঠিক তখন শেখ হাসিনা তার কথিত উন্নয়ন ধরে রাখতে করোনার হটস্পট হিসেবে খ্যাত গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানাগুলো খুলে দিয়েছে। সকল শ্রেণি পেশার মানুষ আপত্তি করলেও শেখ হাসিনা এসবকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। তিনি তার মতই করে সব কিছু করছেন।
দেখা গেছে, গতকাল করোনা ভাইরাসের সংক্রামণে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত নারায়ণগঞ্জে নতুন করে আরও ২৩টি তৈরি পোশাক কারখানায় সীমিত পরিসরে কাজ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত জেলায় ১২৬টি কারখানা খোলা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানাগুলো খোলার পর দিনই আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে এক লাফে চলে গেছে ৮৪ জনে। যা নারায়ণগঞ্জের জন্য সর্বোচ্চ রেকর্ড। এনিয়ে এখন জেলা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামে চালু হয়েছে ৬০ গার্মেন্টস কারখানা। সেখানে নেই শ্রমিকদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা।
এরপর, পিরোজপুরের এক ব্যক্তির করোনার রিপোর্ট পজেটিভ আসার পরও তিনি চাকরি বাঁচাতে আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় যোগ দিয়েছেন। এ সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ওই কারখানার অন্য শ্রমিকদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেছেন, আমরা এখনো লকডাউন যথাযথভাবে প্রয়োগ এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মানুষজনকে বাধ্য করতে পারিনি। মানুষ এখনো এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, আমরা যদি কারখানাগুলো আবার চালু করি, আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর করোনাভাইরাসের হটস্পট (সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত এলাকা), যেখানে বেশিরভাগ কারখানা অবস্থিত। আমরা যদি এসব এলাকার শ্রমিকদের কারখানায় কাজ করার অনুমতি দেই, তবে ভাইরাসটি ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়বে। করোনা আক্রান্ত কর্মীর মাধ্যমে অন্য সব সহকর্মীদের মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে।
অপরদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও এ অবস্থায় শ্রমিকদেরকে কাজে লাগানোর বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন। তারা বলছেন, পরিবেশ ভাল না হলে শ্রমিকরা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, পোশাক কারাখানাগুলো খুলে দিয়ে সরকার আত্মঘাতী কাজ করেছে। শেখ হাসিনা তার কথিত উন্নয়ন ধরে রাখতে ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে সস্তা বাহ বাহ অর্জনের জন্য তিনি হাজার হাজার পোশাক শ্রমিককে মৃুত্যর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। হাজার হাজার পোশাক শ্রমিকের মাধ্যমে এই ভাইরাস এখন সারাদেশ ছড়িয়ে পড়বে। তারা বলছেন, সরকার যদি এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এসে তাহলে কিছু দিনের মধ্যেই করোনায় সারাদেশ মৃত্যুকুপে পরিণত হবে।
হাসিনার দ্বিমুখী আচরণ, শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরা
করোনা সংক্রমণে অল্প বা মধ্যবয়সীদের মধ্যে মৃত্যুহার কম বলে যাঁরা ভাবছেন, পোশাকশ্রমিকদের ওপর করোনার থাবা তীব্র হবে না, তাঁরা গুরুতর ভ্রান্তির মধ্যে বসবাস করছেন। এই ভাবনা অত্যন্ত অমানবিকও বটে। একে তো যেকোনো বয়সী মানুষ এই সংক্রমণে মারা যেতে পারে, অন্যদিকে, পোশাকশ্রমিকদের পরিবারে শিশু থেকে বৃদ্ধ নানা বয়সী মানুষ আছেন। কর্মক্ষেত্রে একজন পোশাকশ্রমিকের মধ্যে সংক্রমণ হওয়ার মানে তার গোটা পরিবারকেও বিপন্ন করা।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, করোনাভাইরাস সতর্কতা নিয়ে তাদের সঙ্গে দ্বিমুখী আচরণ করা হচ্ছে। তাদের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কেউ করোনা থেকে বাঁচতে ঘরে বসে সামাজিক দূরত্ব মানবে, আর কেউ গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও বাইরে বের হবে শ্রমঘন খাতে কাজ করার জন্য!
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক জুলহাসনাইন বাবু বলেন, ‘আমরা শ্রমিকের স্বাস্থঝুঁকির কথা বিবেচনা করে সব গার্মেন্ট বন্ধ রাখতে বলেছি। যে গার্মেন্ট খোলা ছিল সেগুলোও বন্ধ রাখতে বলেছি। কিন্তু এখন দেখছি এতদিন যারা বন্ধ রাখছিল তারাও খুলছে।’ শ্রমিকরা হতাশ ও ভীত হয়ে পড়ছে বলে জানান তিনি।
মানবিকতা ছাড়াও অর্থনীতির কৌশল হিসেবে শ্রমিকের সুরক্ষা দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে জুলহাসনাইন বাবু বলেন, ‘শ্রমিকদের মধ্যে করোনা ছড়ালে আমরা কাউকে রক্ষা করতে পারব না। তাতে এ শিল্পেরই ক্ষতি হবে।’
সরকারও কি সেই দায় এড়াতে পারবে?
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর আমীন আল রশীদ দ্য ডেইলি স্টারের একটি কলামে বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক পরিণতি নিয়ে উদ্বেগে আত্মহত্যা করেছেন জার্মানির হেসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী টমাস শেফার (বিবিসি, ২৯ মার্চ)। করোনার কারণে বাংলাদেশের সব খাতই, বিশেষ করে রপ্তানিনির্ভর শিল্প যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হবে—সে বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই।
অস্বীকারের উপায় নেই যে, দেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক খাতের ভূমিকা বিরাট। গ্রামের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী এই খাতে কাজ করে সংসার চালান। তাদের জীবনমান কতটা উন্নত হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অন্তত খেয়ে পরে যে এই পরিবারগুলো বেঁচে থাকতে পারছে, সেটিও বাংলাদেশের মতো একটি অতি ঘনবসতিপূর্ণ এবং তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতির দেশের জন্য কম কথা নয়। সেজন্য পোশাক কারখানার মালিকরা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, করোনাভাইরাসের কারণে যখন সারা বিশ্বই বলতে গেলে লকডাউন বা অচল; যখন জরুরি সেবা সংস্থাগুলো ছাড়া দেশের সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানই বন্ধ, তখন পোশাক কারখানার মতো একটি অতি সংবেদনশীল স্থান—যেখানে একসঙ্গে হাজার হাজার মানুষ কাছাকাছি বসে ও দাঁড়িয়ে কাজ করেন এবং যখন করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান অস্ত্রই হচ্ছে শারীরিক দূরত্ব—তখন একসঙ্গে অনেক লোক এক জায়গায় বসে কাজ করতে হয়—এমন একটি কর্মক্ষেত্রে কেন খোলার সিদ্ধান্ত হলো? এটি কি আত্মঘাতী নয়?
যে শ্রমিকরা সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরই দলে দলে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কতজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত লোকের সংস্পর্শে এসেছেন এবং এরই মধ্যে কতজন আক্রান্ত হয়েছেন—তার তো কোনো হিসাব নেই। এই লোকগুলোর মধ্যে যদি ১০ জনও আক্রান্ত হন তাহলে একসঙ্গে, এক ছাদের নিচের কাজ করতে গিয়ে তাদের মাধ্যমে কত হাজার লোক আক্রান্ত হবেন? যদি দলে দলে লোকজন আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হওয়া শুরু করেন, সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কি কারো পক্ষে সম্ভব হবে? এই ঘটনায় একজন শ্রমিক বা তার পরিবারের সদস্যেরও যদি মৃত্যু হয়, সেই দায়ভার কি পোশাক কারখানা মালিকরা এড়াতে পারবেন? সরকারও কি সেই দায় এড়াতে পারবে?
প্রশ্ন হলো, কী ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা কারখানায় নিশ্চিত করা হয়েছে? কিছু যে নেই তার বড় প্রমাণ, এই যে হাজার হাজার বা লাখো শ্রমিক দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় আসবেন, সেটি তো মালিকরা জানতেন। যদি তাদের একান্তই আনতে হয় এবং যেহেতু সব গণপরিবহন বন্ধ—সেক্ষেত্রে মালিকরা তাদের জন্য বিশেষ যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারতেন। যে মালিকরা শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপদে তার শ্রমিকদের আনার কোনো ব্যবস্থা করেননি, তারা কারখানার ভেতরে তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য কতটুকু কী করবেন—তা সহজেই অনুমেয়।