আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে এই পৃথিবীতে ঠিক আজকের মতোই রাত শেষে নতুন ভোর আসত। প্রভাতে সূর্য উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষরা ঘুম ভেঙে জেগে উঠত।
লেগে যেত তাদের নিজ নিজ কাজে। বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিকরা মত্ত হয়ে যেতেন তাদের স্বীয় গবেষণায়। যাতে পৃথিবীকে নতুন কিছু উপহার দেয়া যায়।
কিন্তু সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর পূর্বের সেই ভোরে যেন কোনো নতুনত্ব থাকত না, থাকত না কোনো প্রভাতের জয়গান। মানুষেরা জেগে উঠত ঠিক, কিন্তু তাদের অন্তরাত্মার ঘুম ভাঙত না। যেন তাদের অন্তরাত্মা ঘোর অমানিশার অন্ধকারে নিশ্চিন্তে ঘুমন্ত।
তারা জানত না কখন ভোর আসবে অথবা তাদের মনে হচ্ছিল অন্ধকার গভীর থেকে আরও গভীরতর হচ্ছে, প্রভাতের এখনও অনেক দেরি। এই চিন্তায় তারা আরও খানিক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।
কেউ ‘রাত পোহাবার কত দেরি’ প্রভাতের খোঁজ করার প্রয়োজনবোধ করল না অথবা তারা সবাই এমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল যে, প্রভাতের খোঁজ করার মতো কেউ ছিল না। হয়তো যে দু’একজন ছিল তারা অন্যদের ঘুম দেখে বিস্ময়-হতবাকে অথবা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে খানকা-গির্জায় আত্মগোপন করেছিল।
কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিকেরা নতুন নতুন কবিতা, দর্শনশাস্ত্র দিয়ে পৃথিবীর থলে ভারী করে দিচ্ছিল। কিন্তু তারা না পেরেছে মানবতার তৃষ্ণা নিবারণ করতে, আর না পেরেছে পৃথিবীকে এক নতুন প্রভাতের সন্ধান দিতে।
বিজ্ঞানীরা তাদের আবিষ্কার দ্বারা মানবজীবনের গতিকে তরান্বিত করতে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু মানুষের ঘুমন্ত অন্তরাত্মাগুলো যে অনন্ত অন্ধকারের দিকে যাত্রা, সেই অন্তরাত্মাগুলোর গতিপথ পরিবর্তন করতে তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না অথবা সেটা করতে তারা ছিল অক্ষম।
মানুষের মানবতার উপর ঝুলছিল বড় বড় তালা। যার কারণে তারা বুঝতেও পারত না যে তারা কোন্ অন্ধকারের দিকে যাত্রা করেছে। তারা সর্বদাই ব্যস্ত থাকত প্রবৃত্তির পূজায়। অবস্থা এমন হয়েছিল– রাত শেষে সূর্য ওঠে যে আলো দেয় তা যেন এক মিছেমিছি আলো, মিথ্যে প্রভাত কিংবা চোখের মরিচীকা।
এমনই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে একদিন সত্যি সত্যি প্রভাত আসল। সেই প্রভাতে এমন এক আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হল যার প্রভাবে কিসরার রাজপ্রাসাদের মিনারগুলো ধ্বসে পড়ল, নিভে গেল পারস্যের সহস্র বছরের অগ্নিশিখা।
মানুষরা যখন প্রবৃত্তির পূজায় নিমগ্ন ছিল, আরবদের প্রভু, মিশরীয়দের প্রভু, আর্যদের প্রভু, ইরানীয়দের প্রভু বলে নিজেদের মধ্যে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে রেখেছিল তখন মুহাম্মদ সা. ঘোষণা করলেন- আল্লাহু আকবার ও আসমান এবং জমিনের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ।
ঘোষণা করলেন- কালিমায়ে তাওহীদ। হেরাগুহার আলোকরশ্মি সিঞ্চিত এই সব বাণী মানুষের অন্তরাত্মায় গিয়ে আঘাত করল। ভেঙে ফেলল মানবতার দরজায় ঝুলে থাকা বড় বড় তারাগুলো।
ফলে তারা ছুঁড়ে ফেলে দিল তাদের সেই সব আভিজাত্যের পোশাক, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করল- আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লালাহ। যার ফলে তাদের জীবনযাত্রা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, দুনিয়াতে তারা (যেখানে তাদের কোনো ভয় নেই, তারা সেখানে চিন্তাগ্রস্থও হবে না)-এর ঝলক দেখা যেত।
আর আজকের চৌদ্দশ’ বছর পরের পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখা যায়, বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মুহূর্তে মুহূর্তে মানবজীবনের গতি তরান্বিত হচ্ছে। তারা এতটাই দুনিয়ামুখী হয়েছে যে, চারদিক থেকে কর্ণকুহরে শুধু ‘আরও কি আছে?’ এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
কিন্তু তারা এতটাই পরকালবিমুখ হয়েছে যে আজাব-গজব চারদিক থেকে তাদেরকে পাকড়াও করে রেখেছে। আর তারা এর থেকে বের হওয়ার জন্য খুঁজছে নানা থিওরি।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, আজ পর্যন্ত যারাই হজরত নুহ আ.-এর ছেলের মতো ‘আমি তো পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে ঝড় বান থেকে নিরাপদ থেকে যাব’ এর মতো অবান্তর দাবি করেছে, তারাই এর জবাবে পেয়েছে ‘আজ কোনো রক্ষাকারী নেই’।
আর আল্লাহ তো সূরা রূমের ৪১ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘জলে ও স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পরেছে, (মূলত) আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’
সুতরাং একবিংশ শতাব্দীর মানুষদের জন্য এই বার্তাটি আবারও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে– অতএব আল্লাহর দিকে ধাবিত হও, আমি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট সতর্ককারী। তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে ইলাহ সাব্যস্ত কর না, আমি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট সতর্ককারী। (সূরা যারিয়াত : ৫০-৫১)
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর রচনা অবলম্বনে