ঘর থেকে বেরিয়ে সবমিলিয়ে মোটামুটি ১৮ ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে সেন্টমার্টিনে যখন পা রাখলাম দুপুরের তখন ভরযৌবন। পার্টিগণিতের সেই পুত্রের বয়স পিতার বয়সের অর্ধেকের মতো বয়সের সমীকরণ নিয়ে আমরা চারজন পা রেখেছি মার্টিন সাধুর দ্বীপে, দু’জন দু’জন করে, দুই জলযানে, লোকমুখে জাহাজে।
আসার পথে একদিকে মিয়ানমার আরেক দিকে বাংলাদেশ রেখে প্রথমে নাফ নদে, তারপর বঙ্গোপসাগরে সঙ্গী হয়েছিল ঝাঁকে ঝাঁকে গাঙচিল। জাহাজ থেকে পর্যটকদের ছুড়ে ফেলা চিপস খাওয়ার আশায় এভাবে ছুটে আসা ওদের। গাঙচিলের চিপসপ্রেমের দৃশ্য দেখে হঠাৎ ভাবতে মন চাইল অদূর ভবিষ্যতে কি ফাস্ট ফুডের দোকানের সামনেও ভিড় জমাবে এই পাখিগুলোর? যা হোক, সে চিন্তা খুব একটা পাত্তা পায় না শুভ্র শান্তির কাছে। শান্ত সমুদ্রে মৃদু ঢেউ থেকে সৃষ্ট দুলুনি ক্লান্ত শরীরে অদ্ভুত একটা ঝিমুনি এনে দিচ্ছিল। জলপাখিদের সীমানা ছাড়িয়ে জানালার বাইরে চারপাশে যখন অথৈ পানি ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না, সব দিকে গম্ভীর-স্থির আকাশের ঠোঁট মিশতে দেখা যায় দুরন্ত-চঞ্চল সমুদ্রের বুকে, সেই অস্তিত্বে কেমন একটা ক্ষমতা দেখিয়ে গেল গাঙচিলগুলো। নির্বাক বয়ানে বলে গেল- এখানে সাম্রাজ্য ওদেরই; আর মঙ্গলপথযাত্রী মানুষগুলো স্রেফ পথিক, জলপথিক।
সেন্টমার্টিন সৈকতে দাঁড়িয়ে বহুদূর চোখ রাখলে শেষ বাধা হয়ে দাঁড়ায় মেঘ। আকাশ আর সমুদ্রের প্রেমে একমাত্র বাধা যেন সে-ই। সৈকতের একটা প্রান্ত থেকে তাকালে দেখা যাবে মাঝে বুকটা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দ্বারুচিনি দ্বীপ, আবছা, বহুদিনের পুরোনো খুব সুখের কোনো স্মৃতির মতো করে দাঁড়িয়ে আছে সে, হারিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা না হয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। কক্সবাজার সৈকতের মতো এ সৈকতে মানুষের সংখ্যা অত বেশি নয়। ফলে কোলাহলও কম (তুলনামূলক; আরও নির্জন হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়)। একটু সুযোগ খুঁজলেই ডুবে যাওয়া যায় সমুদ্রের সীমায়। ঢেউগুলো এখানে দেখতে ছোট হলেও শব্দে ওদের পরিচয়। কী উথাল-পাতাল গর্জন! একের পর এক আছড়ে পড়ছে! চোখ বন্ধ করে ওই গর্জন শুনলে গা শিউড়ে ওঠে। মনে হয় কী সর্বনাশটাই না হয়ে যাচ্ছে, না হলে এত আওয়াজ হয়? শহুরে মানুষের কাছে এ আওয়াজ যেন খুব ঝড়ের।
সমুদ্রের ঢেউগুলো আছড়ে পড়তেই থাকে, ওদের সকাল-বিকেল-রাত বলে কিছু নেই, সময় শব্দটা ওদের জন্য কেবলই অক্ষরমালা, চূড়ান্ত অর্থহীন। ঢেউগুলোর শৈশব নেই, যৌবন নেই, বার্ধক্য নেই। চুপমনে চোখবুজে থাকলে ঢেউয়ের শব্দ পরিণত হয় দৃশ্যে, গর্জনগুলো গল্পে। মনে হয় আছড়ে পড়া একেকটা ঢেউ একেকটা গল্পের একেকটা দৃশ্যপট। দাপট দেখানো ঢেউগুলোতে যেমন আছে শক্তির প্রতিধ্বনি, তেমনি রয়েছে একাকীত্বের চরম হাহাকার। ঢেউয়ে ঢেউয়ে আছড়ে পড়া গল্পগুলোতে অজস্র না বলা কথা। সদ্য কথা বলতে শেখা শিশুর মতো অফুরান গল্প তার। পর্যটকদের কেউ কেউ সেগুলো পায়ে মেখে নেন, কেউ শরীরটা ভিজিয়ে নেন, কেউ হৃদয়ে গেঁথে নেন।
নারিকেল জিঞ্জিরা বা সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য অপার্থিব, তীব্র প্রাকৃতিক। যে জীবনের সঙ্গী কেবল সমুদ্র, সে জীবন পরলৌকিক। দার্শনিক প্লেটো যেমনটা ভাবতেন- সংখ্যার ধারণা মানুষকে ঈশ্বরের স্বরুপ উদঘাটনে প্রেরণা যোগায়, দৃশ্যত সমুদ্রের বিশালতাও তেমন একটা স্পর্শ দিয়ে যায়। জড়-জলের হাতে ধরে বহু প্রাণও ভেসে আসে সৈকতে। কেউ ফিরে যায়, কেউ কোনোমতে ফিরে যেতে পারে, আর কেউ কেউ ফিরে যেতে পারে না। যারা পারে না তাদের পরকাল হয় এ সৈকত।
ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিনের যাত্রাপথ নিতান্ত কম নয় (কক্সবাজার পর্যন্ত বিমানে গেলে ভিন্ন কথা)। দ্বীপে পৌঁছানোর পর শরীরে ক্লান্তি ভর করা তাই খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হলো। ক্লান্ত শরীরে চোখের সামনে যখন দেখছি একটু একটু করে সূর্য এদিকটার জীবনে তার এ পর্বের সমাপ্তি টানছে, শরীর, সূর্য আর সমুদ্রের তখন ঐশ্বরিক এক টানাপোড়েন শুরু হয়। তবে এর শেষ হাসি সমুদ্র হাসবেই।
দিনের স্বচ্ছ পানি, নীল সমুদ্র, নীল আকাশ আর চকচকে রোদের সেন্টমার্টিনের সাথে রাতের সেন্টমার্টিন বা নির্জন সমুদ্রের তুলনা চলে না। সূর্যাস্তের হাত ধরে বদলে যাওয়া আবহে হঠাৎ যেন হয়ে গেল টাইম ট্রাভেল। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আমরা পৌঁছে গেলাম আরেক জগতে। সেখানে জাদু দেখাবে আরেক জাদুকর। সে জাদু দেখতে আমরা শুয়ে পড়লাম সৈকতে রাখা কিটকট চেয়ারে। জাদুকর কিন্তু চালাক অনেক। দর্শকের মনোযোগ পুরোটা না পাওয়া পর্যন্ত জাদুর ঝুলি খুলবেন না তিনি। প্রাত্যহিক জীবনের সমস্তটা ওপাশেই রেখে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে জাদুকরের হাতে।
সেই একই সমুদ্র, একই আকাশ অথচ চোখের সামনে অপরিচিত দৃশ্য। চোখের পলক ফেলতেই যেন জাদুর হাতে বদলে গেল এ অংশটা। একটু একটু করে মাথার ওপরে বাড়তে থাকবে নক্ষত্রদের খেলা। চেনা তারা, অচেনা তারা। সামনে থেকে সঙ্গ দেবে সমুদ্র। যোগ দেবে চঞ্চল শিশুর মতো অবাধ্য হাওয়া। মাথাটা উঁচু করতেই চোখে ধরা দেবে কত কত আলোকবর্ষ দূরের অচেনা সব নক্ষত্র। এমনও হতে পারে কারো আলো হয়তো এইমাত্র পৃথিবীর বুকে এসে পড়ল সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে। আর সেই আলোমাখা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল এদিকটায়, এ জীবনের অংশ হওয়ার বাসনায়। ওদিকে চাঁদের টানে নিয়ম মেনে জোয়ার-ভাটা জোয়ার-ভাটা খেলা তো চলছেই। সে টানও অদৃশ্য; তবে বৈজ্ঞানিক। আর সমুদ্র মানুষগুলোকে যে প্রেমে টানে সে টানও অদৃশ্য, তবে তা বৈজ্ঞানিক নয়, মানবিকও নয়, আবার সামুদ্রিকও নয়।
রাত যত গভীর হয় সমুদ্রের সেই টানও তত গভীর হয়। ইন্দ্রিয়গুলোর সঙ্গে সমুদ্রের আদি কোনো চুক্তি মোতাবেক শরীরটা অবধারিতভাবেই সমুদ্রের পক্ষ নিয়ে ফেলে। মৃত্যুর মতো, সে ডাক অস্বীকার করে অন্য পথে যাওয়ার বিকল্প কোনো পথ আর খোলা থাকে না। সামনে কেবল একটিই পথ সমুদ্র, কিছুক্ষণ পরপরই আসতে থাকে তার আহ্বান। আর সেই জাদুর আলোকসজ্জ্বা, তার পরিধি বাড়তেই থাকে।
কয়েক ঘণ্টা আগেও যেখানে চোখদুটো সাক্ষী হয়েছিল সমুদ্র আর আকাশের প্রেমলীলার, সেখানেই এখন অন্ধকারের সঙ্গে সমুদ্রের সে কী ভালোবাসাবাসি! লাখ লাখ নক্ষত্র হচ্ছে সে প্রেমের (রসিকতা করে আমি বলি পরকীয়া) সাক্ষী। দূরে কোথাও অন্য কোনো সমুদ্রেও হয়তো চলছে একই লীলা। এ ভাবনা রেখেই সে রাতের মতো সমুদ্র থেকে শরীর বিচ্ছিন্ন করে আমরা ফিরলাম রিসোর্টে। এবার গন্তব্য ঘুমের দেশ।
পুরোনো সূর্য একটু একটু করে উঁকি দিতে শুরু করতেই আমরা আবার হাজির সমুদ্রের কাছে। সমুদ্র এবার আরেক রকম। এখন ওকে দেখতে কেমন একটা শান্ত শান্ত লাগে। পোড় খাওয়া, খুব জীবন-বোঝা তরুণীর মতো। সন্তর্পণে পা ফেলাই যেন তার অভ্যাস। রোদটাও যেন খুব বোঝে সাগরকে, বহুদিনের প্রেমিকার মতো। সেও তাই ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়, তারপর মিলেমিশে একাকার। বেলা যত পড়তে থাকে রোদের কাছে সমুদ্রের আহ্লাদও বাড়তে থাকে। আবার ফিরে আসে আগের দিনের গল্পগুলো, নতুন হাতে। ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে নতুন দিনে পৃথিবী আবার প্রথমবার শুনছে কবেকার বলা সেই গল্প।
হাজার বছরের ষড়যন্ত্রে এ পারে জন্ম নেয়া পাথরগুলোতে আমরা খানিকটা আশ্রয় নিই। নিজেরা অংশীদার হয়ে যায় ওদের ধ্বংসপ্রক্রিয়ায়। সমুদ্রের টান তখন ওপারে। ঢাকা শহরের বিষ-শ্বাস ফেলে, নীড় ফেলে, সমুদ্রের বিশ্বাসে, নীড়-জনকে নিয়ে নির্জনে পাথুরে সৈকতে আমরা তখন বিলীন শান্তির অসীম সমুদ্রে। পাথরে শরীর বসিয়ে মন দুটো আমরা ভাসিয়ে দিলাম স্বচ্ছ শান্ত জলে। সফরসঙ্গী জীবনসঙ্গীকে নিয়ে ঢাকা ছাড়ার আগে মনে বেজেছিল নচিকেতার চারটি লাইন- চল যাব তোকে নিয়ে/ এই নরকের অনেক দূরে/ এই মিথ্যে কথার মেকী শহরের/ সীমানা ছাড়িয়ে…
সমুদ্রবেলায় আমরা সীমানা পেরিয়েছিলাম, হাতে হাত রেখে। আর বিদায়বেলায় গাঙচিলগুলো আবার এসেছিল… পর্যটকদের ছুড়ে ফেলা চিপস খাওয়ার আশায় হয়তো এভাবে ছুটে আসা ওদের। অথবা কে জানে এবার হয়তো ওরাও বিদায় জানাতে এসেছিল…যা হোক, সে চিন্তা খুব একটা পাত্তা পায় না শুভ্র শান্তির কাছে…শান্ত সমুদ্রে মৃদু ঢেউ থেকে সৃষ্ট দুলুনি ক্লান্ত শরীরে অদ্ভূত একটা ঝিমুনি এনে দিচ্ছিল। বন্ধ চোখে একেকবার একেকটা দৃশ্য খেলে যাচ্ছে, কোনোটা সম্পূর্ণ নয়… জলপাখিদের সীমানা ছাড়িয়ে আমরা ফিরে আসছি ঢাকা শহরে… ওখানে সমুদ্রে ঢেউ উঠছে…ফিরতি পথে আমরা এখন নাফ নদে.. ওদিকে এই বোধহয় অসতর্ক কেউ ভিজে গেল নোনা পানিতে…ঢাকার রাস্তায় জ্যাম কতটা আজ… ওদিকে নতুন কেউ সমুদ্র দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল হয়তো…আর আমরা ফিরে আসছি.. এটার নাম স্বর্গচ্যুতি হতে পারে… মসৃণ সড়কে বাস চলছে ঝড়ের গতিতে…আমরা ফিরে আসছি…আবার বাঁচতে হবে আমাদের অন্য সূর্যের সকালে… ঢাকা শহরে।