জাকারিয়া লুসাইয়ের সঙ্গে আলাপটা বেশ জমে উঠেছিল। সাজেকের একটি খাবার হোটেলের স্বত্বাধিকারী তিনি। খাওয়ার পর পাহাড়ি হরেক পদ নিয়ে বেশ কৌতূহল হলো। বাঁশ-চা খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। জানতে চেয়েছিলাম বাঁশ দিয়ে নানা খাবারের উৎপত্তির কথা। তিনি মোটাদাগে শোনালেন সেই কথা। যার অনেকটা এ রকম—একসময় পাহাড়ের মানুষ যখন শিকারে যেতেন, তখন বেশ কদিন জঙ্গলে থাকতে হতো। শিকারে যাওয়ার সময় বেশি কিছু সঙ্গে নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জঙ্গলের বাঁশ কেটে সঙ্গে থাকা চাল, ডাল তাতেই ফুটিয়ে নিয়ে খেতে হতো। সেখান থেকেই বাঁশ মুরগি ও বাঁশ বিরিয়ানির মতো খাবারের প্রচলন। কথা শেষে অনেকটা কৃতিত্ব পাওয়ার আশায় বললেন, ‘তবে সবাই কিন্তু ভালোভাবে এটা তৈরি করতে পারে না।’
গত ডিসেম্বর মাসে কয়েকজন সহকর্মী মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম রাঙামাটির ছাদখ্যাত সাজেক উপত্যকায়। রাতের বাসে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে ভোরে পৌঁছাই খাগড়াছড়ি। সেখান থেকে স্থানীয় চাঁদের গাড়িতে চড়ে সাজেক পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর ১২টা। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের এই যাত্রাপথ পুরোটাই উপভোগ্য। পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথের অনুভূতিটা ছিল অনেকটা রোলার কোস্টারে চড়ার মতো। তাই তো চিৎকার করে সবাই গেয়ে উঠলাম, ‘পাহাড়ের বাহারে বাহারে/ কত–কী যে সুখ আছে, আহা রে।’
পাহাড়ের ঢালে খুঁটি গেড়ে তৈরি করা সাজেকের অধিকাংশ কটেজ কিংবা রিসোর্টই কাঠ ও বাঁশের। আধুনিক ভবনও চোখে পড়ল, তবে সংখ্যায় খুবই নগণ্য। আমরা সবাই কাঠ ও বাঁশের তৈরি একটা কটেজে উঠেছিলাম। কটেজে ব্যাগ রেখে বারান্দায় দাঁড়াতেই যাত্রীদের সব ক্লান্তি নিমেষেই শেষ! সামনের আদিগন্ত পাহাড় আর সবুজের মিতালিতে সবাই যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম।
ভোরে সবাই চলে গেলাম হেলিপ্যাডে, সূর্যোদয় দেখব বলে। হিম হিম ঠান্ডায় আমরা সবাই রীতিমতো কাঁপছি, এমন সময় দিগন্তে দেখা মিলল সূর্যের। রক্তিম আভায় চারদিক ভাসিয়ে উঁকি দিয়ে দেড় মিনিটের মধ্যেই পূর্ণ উদিত হলেন সূর্যদেব। মন্ত্রমুগ্ধের মতো
আমরা তাকিয়ে থাকি, ভুলে যাই হাড়কাঁপানো শীতের কথা। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা
বলি না, অনুভূতিটা ঠিক বলে বোঝানো
যাবে না।
পাহাড়ি ও বাঙালি—উভয় ধরনের খাবার পাওয়া যায় সাজেকে। সন্ধ্যার পর সাজেকের বাতাসে ভেসে বেড়ায় বারবিকিউয়ের সুঘ্রাণ। এখানে প্রতিটি সন্ধ্যা নামে উৎসবের আমেজ নিয়ে। সাজেকে খাবারের কথা রেস্তোরাঁয় আগেই বলে রাখা ভালো, তা না হলে খাবার পাওয়া কঠিন কিংবা সময় বেশি লাগে। এ ছাড়া সন্ধ্যা হলেই রাস্তার দুই পাশে খাবারের অসংখ্য দোকান চোখে পড়বে। আগে থেকে বলা ছিল এক রেস্তোরাঁয়। রাতে বাঁশ বিরিয়ানি খেতে গিয়েছি। খাওয়ার সময় এক সহকর্মী বললেন, ‘এখানে সবাই টাকা খরচ করে হাসিমুখে বাঁশ খায়।’
যাঁরা ট্রেকিং ভালোবাসেন, একজন গাইডের সহায়তা নিয়ে যেতে পারেন সিকাম তৈসা কিংবা কংলাক ঝরনায়। গাইড সূর্য চাকমার নির্দেশনায় আমরা গিয়েছিলাম সিকাম তৈসা ঝরনায়। রওনা হই বেলা সাড়ে তিনটায়। পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে সূর্যকে বলি, ‘তুমি অস্ত যাওয়ার আগেই আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে সাজেকে।’। সূর্য হাসে আর বলে, ‘আপনারা তাড়াতাড়ি করেন, আগেই ফিরা আসব।’ ঝরনায় গোসল করব বলে আমাদের সঙ্গে ছোট দুটি ব্যাগ ছিল। খাড়া পাহাড় বেয়ে নামতে গিয়ে অনভ্যস্ত আমাদের পা যখন আর চলে না, অপার মমতায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে ১৫ বছরের সূর্য বলে, ‘ব্যাগগুলো আমাকে দ্যান।’ পাহাড়ের বিশালতা হৃদয়ে ধারণ করা ছোট্ট সূর্যকেও আমাদের কাছে তখন পাহাড়ের মতোই বিশাল মনে হয়!