২০১৩ সালে দৃশ্যমান হওয়ার কথা থাকলেও এখনও দৃশ্যমান হয়নি পদ্মা সেতু। গত ১১ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ ২৪তম স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে সম্পূর্ণ হয়েছে এক তৃতীয়াংশ হয়েছে। এতো দিনে দৃশ্যমান হয়েছে সেতুর ৩.৬ কিলোমিটার। এখনও ৪২টি খুঁটির ওপর ৪১টি স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হলে দৃশ্যমান হবে ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুর শতভাগ।
কিন্তু সেতুটির শতভাগ শেষ হওয়ার পথে সময় যেমন বাড়ছে, সঙ্গে বেড়েছে নির্মাণ খরচও। ১১ বছরে তিন ধাপে ব্যয় বেড়েছে ২৯৭ শতাংশ। ২০১৩ সালে যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল তা এখন ঠেকেছে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। গত ৩ নভেম্বর সর্বশেষ দেড় বছর সময় বাড়িয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার সময়সীমা নির্ধারিত ছিল গত ৩০ ডিসেম্বর।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এ যাত্রায় ‘শূন্য খরচে’ প্রকল্পটির মেয়াদ বেড়েছে। তবে পরবর্তীতে ‘মেয়াদ আর বাড়ানোর অবকাশ থাকবে না’সহ সাতটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। বাকি শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রকল্পের অগ্রগতি ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত ওয়ার্ক প্ল্যান এবং ব্যয়ের প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত নিয়মিত আইএমইডিতে (বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) পাঠাতে হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
আর তিন ধাপে এই ব্যয় বাড়াতে কখনও নদী শাসন, কখনও জমি অধিগ্রহণ বা কখনও পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। তবে প্রকল্প ব্যয়ের বড় অংকটি যুক্ত হয় ২০১১ সালে। ওই বছরের ১১ জানুয়ারি সেতুর সঙ্গে রেলপথ সংযুক্ত করে প্রথম দফায় ব্যয় সংশোধন করে নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে প্রকল্পটি যাত্রা শুরু করে।
তবে ২০০১ সালে প্রথম প্রকল্পটি বাস্তবায়নে হাত দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ৪ জুলাই এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে ওই বছরের অক্টোবরের নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় এবং ২০০৮ সালে ফের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকল্পটি এগিয়ে নেয়ার কার্যক্রম হাতে নেয়। বিশেষ করে ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফেবার মানসেল লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। খরচ কমাতে সেতুর সঙ্গে রেলপথ যুক্ত করে দ্বিতল সেতুর ডিজাইন করে ফেবার মানসেল লিমিটেড।
অপরদিকে সরকার ২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করে এবং এতে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে যোগ দেয় বিশ্বব্যাংক, এশীয় ডেভলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভলপমেন্ট ব্যাংক, জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন (জেবিআইসি) এবং আবুধাবি ডেভলপমেন্ট গ্রুপ। এদের মধ্যে প্রধান অংশীধার ছিল বিশ্বব্যাংকের। কিন্তু ‘দুর্নীতির চেষ্টার’ অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে যায় এবং একে একে সরে পড়ে এশীয় ডেভলপমেন্ট ব্যাংক ও ইসলামিক ডেভলপমেন্ট ব্যাংকও। ফলে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কিছু দিন ধরে চলতে থাকা ধীর গতি হঠাৎই স্থবির হয়ে পড়ে। এরপর সরকার নিজস্ব অর্থেই এ সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সেতু বিভাগের আওতায় ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প’টিকে অনুমোদন দেয় এবং একই সঙ্গে বাস্তবায়ন ব্যয় আরও ৮ হাজার ২৮৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এছাড়া বাস্তবায়নের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ওই সময়ে সেতু নির্মাণের খরচ ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা ঠিক রেখে আট হাজার কোটি টাকার মধ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকাই ধরা হয় নদী শাসনের কাজে। জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ৮ কিলোমিটার নদীশাসনের কথা ছিল এবং ওই খাতে ২০১১ সালে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল চার হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। পরে এতে যুক্ত করা হয় আরও ১.৩ কিলোমিটার (সব মিলিয়ে ৯.৩ কিলোমিটার) এবং বাড়তি ওই ১.৩ কিলোমিটার নদীশাসনের জন্য ব্যয় বাড়ানো হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে নদীশাসন কাজে বরাদ্দ ছিল মাত্র দুই হাজার ৬১২ কোটি টাকা।
এরপরে তৃতীয় দফায় ২০১৮ ব্যয় বাড়ানো হয় ভূমি অধিগ্রহণ খাতে। ওই বছরের ২১ জুন এ খাতে ১৪০০ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব অনুমোদন দেয় একনেক। তাতে পদ্মা সেতুর মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকায়।
২০০৭ সালে ভূমি অধিগ্রহণ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০৬ কোটি টাকা এবং ২০১১ সালে তা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ১ হাজার ৮৬ কোটি টাকা।
নদীশাসন আর ভূমি অধিগ্রহণের এই খাত দুটিকেই ‘দুর্নীতি যুক্ত’ খাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্যয় সংশোধনীতে ২০১১ সালে বড় একটি অংক যুক্ত হয়েছে। তার যৌক্তিকতাও আছে। কারণ ২০০৭ সালের ডিজাইনের থেকে পরেরটা একেবারেই ভিন্ন। কিন্তু এর পরে যে দুটি খাতে খরচ বাড়ানো হয়েছে সেখানে সন্দেহের বেশ অবকাশ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সেতুর (যমুনা সেতুর) প্রসঙ্গ টেনে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ওখানে বিশ্বব্যাংকের একটি তদারকি ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুতে আন্তর্জাতিক কোন তদারকি নেই। তাছাড়া যমুনায় কয়েকটি কারণে সময় বেশি লেগেছিল কিন্তু ব্যয় বাড়ার তেমন কোন খবর আমরা পাইনি। ফলে ওর নির্মাণ খরচ কিন্তু আমরা ৮/৯ বছরের মধ্যেই তুলে ফেলেছিলাম।
পদ্মা সেতুতে এখন যে ব্যয় ও সময় নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যেও শেষ করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান মনসুর বলেন, এই পর্যায়ে থামা উচিত।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মূল সেতুর প্রথম স্প্যান স্থাপন করা হয়। এখনও নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার সময় যতটা দীর্ঘ হচ্ছে ততোটাই যেন দীর্ঘ হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন পুরণের অপেক্ষা।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর