অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর; এভাবে বছরের পর বছর পার হয়ে যায়, তবু ফিরে আসে না তারা। অপেক্ষায় কেটে যাচ্ছে নিখোঁজ মানুষের স্বজনের দিন। কবে ফিরে আসবেন, সেই প্রহর গুনছেন স্বজনেরা। অনেকে এখন আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। ধরেই নিয়েছেন আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না তাদের প্রিয়জন।
এ নিখোঁজের তালিকায় মেধাবী ছাত্র, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রয়েছেন সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ীরা। দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন, সুশীলসমাজসহ অনেকেই এর প্রতিবাদ করে আসছেন, রাস্তায় মানববন্ধন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনের নিয়ে মহাসমাবেশ পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু আজও নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান মেলিনি।
২০১২ সালের ৪ ফেব্রয়ারি ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে মধ্য রাতে বাস থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়েছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র শিবির নেতা ওয়ালীউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাস। তারপর ৮ বছর এখনও গ্রেফতার দেখায়নি পুুলিশ।
সে সময় তাদের সন্ধানের দাবিতে উত্তাল হয়েছিলো ইবি ক্যাম্পাসসহ সারাদেশ। চলেছে ধর্মঘট, মানববন্ধন, মিছিলসহ বিভিন্ন আন্দোলন। সরব প্রতিবাদ করেছিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশনার পর ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুই মাধাবী ছাত্রকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেনি। তাদের মা-বাবা আজও সন্তানদের ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। অপেক্ষা শেষ হবে কিনা তা নিয়েই চিন্তার ভাঁজ মায়ের কপালে।
দেখা গেছে, ক্ষমতাসীনদের আমলে বাংলাদেশে নাগরিকদের গুম করে ফেলার এক নিষ্ঠুর সংস্কৃতি চালু হয়েছে। গুমের এই বিভীষিকা বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে। গত দশ বছরে ৫২৪ জন মানুষ বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই এখনও কোন হদিস মেলেনি।
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত দশ বছরে ৫২৪ জনের মধ্যে ২০০৯ সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ১৮ জন, ২০১১ সালে ৩১ জন, ২০১২ সালে ২৬ জন, ২০১৩ সালে ৫৪ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন, ২০১৫ সালে ৬৬ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৮৬ জন, ২০১৮ সালে এখন পর্যন্ত ৫৫ জন। এদের বেশিরভাগেরই এখনও হদিস মেলেনি।
এছাড়া পুলিশ সদরদপ্তরের রিপোর্ট অনুসারে গত দশবছরে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৭৪৫২টি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৮০০ জন, ২০১০ সালে ৮৮১ জন। ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে ৮৭০ জন করে অপহৃত হয়েছে। ২০১৪ সালে ৯২২ জন, ২০১৫ সালে ৮০৬ জন, ২০১৬ সালে ৬৩৯ জন, ২০১৭ সালে ৫০৯ জন, ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত ২৮৫ জন অপহরণের শিকার হয়েছে।
এদিকে গ্রেফতারকৃত দুই মেধাবী ছাত্র ও শিবিরনেতা ওয়ালীউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসসহ গুম হওয়া সকল ছাত্রের সন্ধান ও মুক্তি দিতে প্রশাসনের প্রতি আহবান জানিয়েছিন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
এক যৌথ বিবৃতিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ সিরাজুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল সালাহউদ্দীন আইউবী বলেন, দীর্ঘ ৮ বছর হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত তাদের গ্রেফতারের কথা স্বীকার করেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদেরকে গ্রেফতারের পরেই ৬ ও ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দারুস সালাম ও সাভার আশুলিয়া থানায় জিডি করে তাদের পরিবার। কিন্তু জিডি আমলে নিয়েও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। তাদের ব্যাপারে ২০১২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বিচারপতি আব্দুল আউয়াল ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের পক্ষ থেকে পুলিশের আইজিকে তলব করে দু’ছাত্র নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে তদন্তের অবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
অন্যদিকে তাদের উদ্ধারের দাবিতে ক্যাম্পাসে ধর্মঘট, মানববন্ধন, মিছিলসহ বিভিন্ন আন্দোলন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সরব প্রতিবাদ এবং হাইকোর্টের নির্দেশনার পর ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুই মেধাবী ছাত্রকে গ্রেফতারের কথা স্বীকার করেনি বা সন্ধান দেয়নি। এত কিছুর পরও প্রশাসন কর্তৃক বিষয়টিকে উপেক্ষা করায় প্রমাণ হয় হয়ত তারাই দুই ছাত্রকে গুম করে রেখেছে। অথচ তাদের মা-বাবা আজও সন্তানদের ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছেন।
সহপাঠিরা তাদের ফিরে পাওয়ার আশায় প্রহর গুণছে। এমনিভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারের পর বহু ছাত্রের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মেধাবী ছাত্ররা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এমনভাবে গুম হয়ে যাবে তা কল্পনাও করা যায়না। এটা কোন সভ্য রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিফলন হতে পারে না।
নেতৃবৃন্দ বলেন, অন্য সবার মত ওয়ালীউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসও এদেশের সন্তান। সাংবিধানিকভাবে তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আইনের ধারক-বাহকরাই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুই মেধাবী ছাত্রকে গুম করে রেখেছে। কোন সভ্য সমাজে এমন লোমহর্ষক আচরণ চিন্তা করা যায় না। এত কিছুর পরও আমরা বিশ্বাস করি ওয়ালীউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেই নিরাপদে আছে। অবিলম্বে তাদের সন্ধান দিতে হবে। অন্যথায় দেশের মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে আস্থা উঠিয়ে নিবে।
আরো পড়ুন: অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে চলে গেলেন মা, ফেরেনি আমান আযমী!