বাংলাদেশে চলছে উৎকল্পনার রাজনীতি। যার পরিণতি শেষ হয় হতাশায়। এই লেখায় উৎকল্পনার রাজনীতিকে বুঝতে ব্রেক্সিটকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য লেখাটি খুবই প্রাসঙ্গিক। লিখেছেন, থমাস ওয়েলস, তিনি নেদারল্যান্ডের দর্শনের শিক্ষক। তিনি নিয়মিত দর্শন ও রাজনীতি নিয়ে লিখেন। থ্রি কোয়ার্ক ডেইলি থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছে জবান। অ্যানালাইসিস বিডি পাঠকদের জন্য অনুবাদটি তুলে ধরা হলো:
উৎকল্পনার রাজনীতি (ফ্যান্টাসি পলিটিক্স) শুরুই হয় এমন প্রত্যাশা দিয়ে যে, সকল আকাঙ্ক্ষা সত্য হবেই এবং কল্পিত ফলাফল অর্জন করা শুধু সম্ভবই না বরং তা মাত্রাতিরিক্তভাবেই সম্ভব।
ব্রেক্সিট উৎকল্পিত রাজনীতির একটি অসাধারণ উদাহরণ। এর শুরু হয়েছিল আনন্দদায়ক আশাবাদ থেকে, যে যুক্তরাজ্য যদি ( ইউরোপীয় ইউনিয়ন) তার সকল বন্ধন হতে নিষ্কৃতি লাভ করতে সক্ষম হয় তবে তারা খুব সহজেই তাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ বন্দোবস্ত করতে পারবে, মূলত এটাই ছিল প্রথমিক কল্পনা।
এই উৎকল্পনার রাজনীতির একটা বিরাট দিক হচ্ছে, এটা আপনাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখবে। কল্পনার শক্তিকে ব্যবহার করে আপনি শুধু আপনার কার্যক্রমকেই নিয়ন্ত্রণ করবেন না বরং অন্যান্য সবার প্রতিক্রিয়া কি হবে তাও নিয়ন্ত্রিত হবে।
এই উৎকল্পনার রাজনীতির একটা বিরাট দিক হচ্ছে, এটা আপনাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখবে। কল্পনার শক্তিকে ব্যবহার করে আপনি শুধু আপনার কার্যক্রমকেই নিয়ন্ত্রণ করবেন না বরং অন্যান্য সবার প্রতিক্রিয়া কি হবে তাও নিয়ন্ত্রিত হবে।
কখনো কখনো প্রকৃতির বিধানকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন আপনি; যেমন, অর্থনীতি, এমনকি পদার্থবিদ্যা। এই ধরনের রাজনীতি আপনার কামনার আলোকেই চালিত হয়, এটা মোটেও চমকপ্রদ ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রে আপনাকে সফল হতে শুধু একটি গুনের প্রয়োজন হবে, আর তা হল সিদ্ধান্তগ্রহণ। আপনার কৃতিত্বকে সবাই স্বীকার করবে এবং স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে, তা আপনাকে শ্রদ্ধা করেই হোক কিংবা ভয়ে।
তবে, আজকাল এই উৎকল্পনার রাজনীতি কেন এতটা জনপ্রিয়? এর একটি কারণ হচ্ছে এই ধরণের রাজনীতি প্রকৃত রাজনীতি থেকে অনেক বেশি সহজ। সাধারণ বা প্রকৃত রাজনীতিতে আমরা নানান, বহুবিধ বিভক্তি এবং সম্মিলিতভাবে নানান জটিল সমস্যা নিয়ে কাজ করে থাকি এবং সেগুলোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করি- যেমন, শ্রমবাজারে লিঙ্গ বৈষম্য কিংবা আবাসন খাতে মূল্যের উর্ধ্বগতি- একই সময়ে নানান রকম বিশ্বাসের মধ্যে বৈষম্যকে, মূল্যবোধকে এবং স্বার্থকে ধারণ করা এবং আমরা আমাদের সমাজের ভেতরে এইসব নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে থাকি।
প্রকৃত রাজনীতি একটি কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ কর্মপ্রক্রিয়া। যেখানে ত্যাগ এবং অন্য সকলের ভিন্নমতের প্রাধ্যান্য থাকতে হয় এবং যা প্রায়শই আমাদের জন্য হতাশাজনক হয়। তবে, আমরা যা বিশ্বাস করি তা সবাইকে বিশ্বাস করিয়ে সমর্থন অর্জন করা অনেক সহজ।
ঠিক যেমনটা ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট গণভোটের প্রচারণার সময় করেছিলেন বরিস জনসন, “আমাদের নীতি হচ্ছে আমাদের খাবার আমরাই খাবো।”
স্বাভাবিকভাবেই উৎকল্পনার রাজনীতি ‘প্রকৃত রাজনীতি’ থেকে অনেকটাই সহজ। এই ধরনের রাজনীতি আমাদের রাজনৈতিক আর্দশ ও বিশ্বাসকে সোজাসাপ্টাভাবে প্রকাশ করতে সুযোগ করে দেয় যা শুধু নিজেদের দলের মধ্যেই ভালো লাগে অন্যের ক্ষতি বা লাভ চিন্তার সুযোগ থাকে না। অনুর্বর মানসিকতার এইসব গুজামিলগুলা সফলতা হিসেবে মিশ্রিত হয় প্রকৃত রাজনীতিতে।
যেমন, নিছক একটি কণ্ঠস্বর লাখো কণ্ঠের কোলাহলের মাঝে বিশেষত্বহীন মনে হয়, তখন কারোর কণ্ঠই কারোর চেয়ে আলাদা করে বুঝতে পারা যায় না। উপরন্তু, যেই নীতি আমরা চাই তার সম্ভাব্য অর্জনের উপর ভরসা রেখে আমরা আমাদের আশার শেষ পরিণামকে কল্পনাতীতভাবে বাড়িয়ে নিতে পারি। যেন সীমাহীন আশা জেগে ওঠে আমাদের মনে। এভাবেই আমরা আমাদের রাজনৈতিক উৎকল্পনার মানসিক সুবিধা ভোগ করতে করতে পারি এবং করছিও তাই।
রাজনীতিতে এক রকমের মনঃস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটেছে বিগত কয়েক দশক ধরে। রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এবং যৌক্তিক সমস্যা ও কার্যক্রম থেকে আমাদের সরিয়ে মূলত বাস্তব জগৎ থেকে আলাদা করে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং রাজনীতি হয়ে উঠেছে নিছক কৌতুক।
রাজনীতিতে এক রকমের মনঃস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটেছে বিগত কয়েক দশক ধরে। রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এবং যৌক্তিক সমস্যা ও কার্যক্রম থেকে আমাদের সরিয়ে মূলত বাস্তব জগৎ থেকে আলাদা করে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং রাজনীতি হয়ে উঠেছে নিছক কৌতুক।
আর এর মধ্যে যারা রাজনীতিতে আগ্রহী তাদের বেলায় দেখা যাচ্ছে যে, তারা এমনভাবে সংঘবদ্ধ হয় যেমন ভাবে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাওয়া একপাল বন্ধুরা একত্রিত হয়।
সাধারণ পেশাগত জীবনে যারা রাজনীতিকে গ্রহণ করে এরাও ঠিক সেভাবেই দেখে যেভাবে স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখেন দর্শকরা। সেখানে তাদের মূল লক্ষ্যই থাকে তাদের দল কতটা ভালো খেলছে বা ভালো করছে তার উপর।
তারা এটা খেয়াল করে না যে খেলাটা ঠিক কোন পর্যায়ে আছে। ঠিক যেভাবে ফুটবল ম্যাচে মানুষ খেলোয়াড় বা কোচদের থেকেও বেশি বোঝে এবং হেরে গেলে খেলোয়াড়, কোচদের গালমন্দ করে, রাজনীতিতেও ঠিক তেমনই হচ্ছে। যারা রাজনীতির অনুরাগী তারা ভাবে তারাই শুধু রাজনীতি বোঝে।
বাস্তবিকভাবে উৎকল্পনার এই রাজনীতি তারাই পছন্দ করে বা তাদেরকেই টানে যারা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উপেক্ষিত হয় এবং যারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
বাস্তবিকভাবে উৎকল্পনার এই রাজনীতি তারাই পছন্দ করে বা তাদেরকেই টানে যারা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উপেক্ষিত হয় এবং যারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। যেমন শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণি বর্ণবাদী রাজনীতি করছে এই আধুনিক অর্থনীতির জাঁতাকলে পিষে যাওয়ার পরও। (ব্রেক্সিটের গণভোটে ২৮ লাখ ভোটার এমন ছিলো যারা প্রকৃত রাজনীতির উপর ভরসা হারিয়ে ভোট দেওয়ায় বন্ধ করে দিয়েছিল এবং তারাই মূলত ব্রেক্সিটকে সমর্থন যুগিয়েছিলো। যদিও ঐ মানুষগুলোই এখন ব্রেক্সিটের ফলাফলে তিক্ততা অনুভব করছে।)
হেরে যাওয়া এ ধরনের মানুষরা শুধু উৎকল্পনার রাজনীতির মাধ্যমেই নিজেদেরকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারে। তারা নিজেদের অনেকটা এমন ভাবেন যে, তারা এরকমের রাজনীতির মাধ্যমে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া সকল উৎপীড়নের প্রতিশোধ নিতে পারবে। যদিও এরকম ভাবনা কখনই সুফল বয়ে আনে না।
এটা এখন বলতেই হয় যে, আজকালকার যুগে উৎকল্পনার রাজনীতিই সবচেয়ে জনপ্রিয় কারণ স্বয়ং উৎকল্পনাই সর্বদা জনপ্রিয়তার শিখরে থাকে। যেমনটা ধরা যায়— আমেরিকায় জনপ্রিয় হওয়া অস্ত্র অধিকার আন্দোলন। আমেরিকার জনগণ হাতে হাতে অস্ত্র পাওয়ার যে আন্দোলন করেছে তা শুধুই কল্পনাকে কেন্দ্র করে। তারা ভাবছে সাধারণের হাতে অস্ত্র থাকলে তাদের মধ্য থেকেই এমন বীরের জন্ম হবে যারা সে অস্ত্র দিয়ে সকল অপশক্তিকে দমন করবে বা সরকারের সকল অপসিদ্ধান্ত থেকে তাদের রক্ষা করবে। ব্যাপারটা ঠিক তাদের সিনেমার গল্পের মত যেমন একজন নায়কের গুলি কখনও লক্ষ্যচ্যূত হয় না এবং একজন খলনায়কের গুলি সর্বদায় লক্ষ্যচ্যূত হয়!
সবশেষে এই বলা যায় যে, চাহিদা যেমন যোগান তৈরি করে। ট্রাম্প, ফ্যারেজ কিংবা বরিসের মত রাজনৈতিক ব্যবসায়ীরা এমনই নানা উৎকল্পনার পণ্য রাজনীতি আকারে হাজির করে ভোটারদের সামনে এবং তা বিক্রিও হয়।
অবশ্যই, প্রকৃত রাজনীতি ছাড়া কখনই ভবিষ্যৎ টিকবে না- যদি আমরা দীর্ঘমেয়াদীভাবে সবকিছু ঠিকঠাক করতে চাই। এতকিছুর পরেও আমাদের প্রতিরূপী নাগরিকগণ প্রকৃত রাজনীতির উপর আস্থা হারাচ্ছে এবং উৎকল্পনার রাজনীতিকে গিলেই চলেছে। আর এর মাধ্যমেই উৎকল্পনার ফেরিওয়ালা এই সব তথাকথিত জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতারা এই জণগণকে ঘোড়ার ঘাস কাটতে বাধ্য করছে।
লেখক: থমাস ওয়েলস (নেদারল্যান্ডের দর্শনের শিক্ষক)