আমীর হামযা
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়নের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নৈতিক অবক্ষয়। সামাজে অপরাধপ্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। খুন, গুম, চুরি, অপহরণ ছাড়াও অতি সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ধর্ষণ। একটি সমাজে কতটা নৈতিক অবক্ষয় ঘটলে প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে একাধিক নারী অথবা শিশুকে ধর্ষণের খবর, তা সহজেই অনুমেয়। সারা দেশে ধর্ষণপ্রবণতা মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। চরিত্রের অবক্ষয় কেমন হলে ছোট ছোট মেয়েশিশু পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হতে পারে; ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। দাঁড়িয়ে যায় শরীরের প্রতিটি লোম।
চার পাশের ‘সমাজ’ নামের আকাশটি অন্যায় অপরাধের কালো মেঘে ঢাকা পড়ছে। একের পর এক ধর্ষণের শিকার সব বয়সী নারী। বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের অবস্থা বড়ই করুণ। দুর্বল ও অসহায় হওয়ায় বিকারগ্রস্তদের সহজ নিশানা তারা। এমনিতেই পুরুষতান্ত্রিক প্রচলিত সমাজে নারীর অবস্থা শোচনীয়। রাষ্ট্রে-সমাজে হীনবল হওয়ায় তাদের প্রতি যখন তখন নেমে আসে নিষ্ঠুর নির্যাতন। এ নিয়ে অনেকের অভিযোগ তুড়ি মেরে উঠিয়ে দেয়া যায় না। এ কথা ঠিক, দেশে নারী নির্যাতন কোন মাত্রায় বর্তমান; তা অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে। নির্যাতনের চিত্র ঠিকভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি আমরা। এটি মোটা দাগে কথিত নারীবাদীদের দুর্বলতা।
এ দেশে ‘নারীবাদ’ এক ধরনের রোমান্টিকতায় মোড়ানো; মুগ্ধতার চাদরে ঢাকা। কেউবা পশ্চিমা অনুদান পেতে গৎবাঁধা স্লোগানে মুখর। এ অভিযোগ ষোলআনা ঠিক না হলেও অনেক বিষয়ে বাংলাদেশে নারীবাদী কর্মকাণ্ড কৃত্রিমতায় ভরা। ফলে দেশে নারীর স্বার্থে প্রকৃত সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। তাই লোক দেখানো এবং পাশ্চাত্যের অন্ধ আর উগ্র অনুকরণের দোষে দুষ্ট ‘নারীবাদী’ আন্দোলন। দেশে-সমাজে-রাষ্ট্রে নারীসমাজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে অপারগ তারা। এটি নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধের বিরুদ্ধেও নারীসংগঠনগুলোর দায়সারা প্রতিবাদ জনমনে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক। এটি সবার মনোযোগ ও সমর্থন পাওয়ার দাবি রাখে। এমনকি মিডিয়াও এ ইস্যুতে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারছে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে সোস্যাল মিডিয়ার কথা আলাদা।
এ দিকে ধর্ষণের বীভৎস সব খবর পড়ে সংবেদনশীল ও বিবেকবান সবাই বিমূঢ়। তারা ভুগছেন তীব্র মানসিক যন্ত্রণায়। কিন্তু করার কিছু নেই, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া। অপর দিকে, এ অপরাধ দমন করা যাদের দায়িত্ব; তারা সাধারণত নির্বিকার। রাষ্ট্রে যখন একটু একটু করে মানবিকতার রশি আলগা হতে থাকে, তখন অপরাধীরা হাত ফসকে বেরিয়ে যায়, অপরাধ যায় অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে। তা ছাড়া, রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরাধী শনাক্ত করার প্রবণতা ভয়ঙ্কর। আখেরে তা সবার ক্ষতির কারণ হলেও ক্ষমতাবান মতলববাজেরা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে অবলীলায় অপরাধীদের মদদ দেয় বাছবিচারহীন ভাবে। ফলে দেশের সামগ্রিক জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও এখন বাস্তবতা তা-ই। অপছন্দ হলেও বাধ্য হয়ে এরই মাঝে আমাদের বসবাস।
একটি শান্তিময় সমাজে কন্যাসন্তানের জন্মের পর প্রত্যেক মা-বাবা স্বপ্ন দেখেন, মেয়ে একদিন সমাজ নামক আকাশে প্রজাপতি হয়ে পাখা মেলবে। উড়ে বেড়াবে সেই আকাশে। থাকবে তার বাধাহীন বিচরণ। কিন্তু ওড়ার আকাশটা যখন কালো মেঘে ঢেকে যায়, তখন? আদরের ছোট্ট প্রজাপতিকে কি আকাশে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে? মেঘের সাথে টক্করে যদি তার পাখা ভেঙে যায়? মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে? তবে কি প্রজাপতি ঘরেই বন্দী থাকবে? তাহলে তো সে আর উড়তে শিখবে না। ‘শুঁয়োপোকা’ হয়েই জীবন পার করে দিতে হবে। উপায় কী? এ প্রশ্নগুলো এখন গগনবিদারী আওয়াজে প্রতিধ্বনিত সর্বত্র। সব বয়সী নারী যেখানে অনিরাপদ, তখন এ বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে শুধু রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে থাকাই কি যথেষ্ট? নাকি নিজেদেরও ভাবতে হবে বিপদ উত্তরণের পথ?
কারণ, দেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখে স্বাভাবিক থাকা অসম্ভব। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নিয়মিত মানবাধিকার প্রতিবেদনে শিশু ধর্ষণের যে হিসাব পাওয়া গেছে, তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। তাদের হিসাবে, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশে মোট ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৬৩০টি। এগুলোর অর্ধেকের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর বয়স বলা আছে। দেখা যায়, তাদের বেশির ভাগের বয়স ১৮ বছর বা তার নিচে। আর ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। তদুপরি ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে ৭-১২ বছর বয়সী শিশুরা।
দেশের ১৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী বছরওয়ারি হিসাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দুই হাজার ৮৩ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১৩ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। এ ছাড়া, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ১২৩ জনকে।
শুধু মাঠেঘাটে নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ঘটছে বীভৎস সব অপরাধ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ই কেবল নয়, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদরাসাতেও ধর্ষণের মতো ধর্মপরিপন্থী জঘন্য অপরাধ ঘটতে দেখে মানুষজন হতভম্ব। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। এখানে নৈতিকতার বাঁধন প্রবল ও মজবুত থাকার কথা। এই প্রত্যাশা ও বিশ্বাস এখন অকার্যকর।
সবার একটাই প্রশ্ন, কেন সমাজে অপরাধপ্রবণতা এভাবে জেঁকে বসেছে? মানবিক সমাজ গড়তে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায় সবার। দায়িত্বে অবহেলা কিংবা গাফিলতির অবকাশ নেই। এড়িয়ে যাওয়ারও জো নেই। তাহলে পস্তাতে হবে সামাজিকভাবে। এতে সমাজ হয়ে উঠবে মানুষের বসবাসের অযোগ্য। যেমন উপযোগিতা হারিয়ে ছিল প্রাক-ইসলামী যুগে আরব সমাজে, যা ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ (অন্ধকার যুগ) নামে অভিহিত। তৎকালীন আরবে দুর্বলরা ছিল ভয়াবহভাবে অসহায়। ওই সমাজে নারী ছিল নিছক ভোগ্যপণ্য। আর দুর্বল পুরুষেরা ছিল সেবাদাস। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, তখন মেয়েশিশুর নিরাপত্তা দিতে না পেরে অসহায় বাবা-মা শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দিতেন। দেশে ধর্ষণপ্রবণতা যেভাবে বাড়ছে; তাতে প্রশ্ন জাগে, আমাদেরও কি নিরাপত্তাহীনতার কারণে মেয়েশিশুকে জীবন্ত কবর দিতে হবে? এটি তো সমাধান নয়, আরেক ধরনের পৈশাচিকতা মাত্র।
এখন কোনো বাবা-মা কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দিতে চাইলে কন্যাভ্রূণ হত্যাই যথেষ্ট। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বদৌলতে মাতৃগর্ভে মেয়ে না ছেলেভ্রূণ, তা জানা এ যুগে মামুলি ব্যাপার। এর ব্যাপক চর্চা দেখতে পাই পড়শি দেশ ভারতে। সেখানে জাতপাতের যাঁতাকলে পিষ্ট অনেক দম্পতি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই জেনে নেন, ছেলে না মেয়ে জন্ম নেবে। মেয়েভ্রƒণ হলে কন্যাশিশুর অনাগত ভবিষ্যৎ চিন্তায় যারপরনাই বিচলিত হয়ে বাবা-মা তাকে দুনিয়ার মুখই দেখতে দিতে নারাজ। অর্থাৎ ভ্রূণেই হত্যার শিকার হচ্ছে অগণন কন্যাশিশু। অনুকরণপ্রিয় আমাদের দেশে মেয়েভ্রূণ হত্যার অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ করা অবাঞ্ছিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। মেয়েভ্রূণ হত্যা স্বাভাবিক, এমন একটি সমাজের কথা চিন্তা করলে চিত্রটি কী দাঁড়ায়? দেশের বর্তমান জনমিতির বিবর্তনে আগামী দিনের কাল্পনিক সমাজ হতে পারে এমন- যেখানে ছেলে-মেয়ের অনুপাত ১:১০। সে সমাজে ১০ পুরুষের ৯ জনকেই থাকতে হবে বিয়ে ছাড়া। এটা তো হতে দেয়া যায় না।
সমাজে অনাচার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ভোগবাদী সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের ফলে দেশে দেশে দ্রুত বস্তুসর্বস্ব ভোগবাদী অপসংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে; তাতে আমরাও আক্রান্ত। প্রযুক্তির উৎকর্ষে এ যুগে দেশের তরুণ সমাজে সহজে অনুপ্রবেশ ঘটেছে ইন্টারনেট কালচার। এতে অনেকের নৈতিকতা-অনৈতিকতার ভেদরেখা মুছে গেছে। ঐতিহ্যবাহী পুরনো মূল্যবোধের বাঁধন আলগা হতে শুরু করেছে। দেখা দিয়েছে ক্রমবর্ধমান সামাজিক অস্থিরতা। এর জের ধরে সমাজে বেড়েছে পশুপ্রবৃত্তি। অন্য দিকে ভোগবাদের প্রাবল্যে ব্যক্তি কেবল ‘সুখের লাগি’ যেনতেনভাবে অর্থ উপার্জনে ব্যতিব্যস্ত। উপার্জিত অর্থে বিলাসিতায় মত্ত। এর প্রতিক্রিয়ায় পারিবারিক বন্ধনে ধরেছে চির। পারস্পরিক সম্পর্ক হয়ে পড়েছে ভঙ্গুর। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে ‘সামাজিক ফাটল’। চার পাশে নিষ্ঠুরতা বেড়ে যাওয়ার জন্য এটিও দায়ী।
কে না জানে, ভোগবাদী সমাজ সব সময় যৌনতায় মোড়ানো। লাগামহীন লালসা পরিণত হয় অভ্যাসে। তা চরিতার্থ করতে লালায়িত দুর্বৃত্ত মন; যা বহুগুণে ব্যভিচার দেয় বাড়িয়ে। সমাজ অনাচারে যায় ছেয়ে। বৈশ্বিক অভিঘাতে আমরা সেই দিকে ধাবমান। আলামত স্পষ্ট। এর ধারাবাহিকতায় বাড়ছে ধর্ষণপ্রবণতা। এর মোকাবেলার উপায় কি কিছু নেই? হ্যাঁ, আছে। তবে উত্তরটি শুনলে ‘প্রগতিশীল’দের কপালে ভাঁজ পড়তে পারে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, কেবল আইন দিয়ে এ থেকে কোনো দিন মুক্তি মিলবে না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পশ্চিমা দুনিয়া। সেখানে আইনের কড়া শাসন বলবৎ থাকার পরও কোনো শহরে রাতে কিছুক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ না থাকলে কত নারী যে ধর্ষণের শিকার হয়, তা বলা দুষ্কর। এ দুষ্টক্ষত থেকে বাঁচার টেকসই উপায় হলো, ইহজাগতিকতার বিপরীতে ঘুরে দাঁড়ানো। ঐশী বাণীর নিবিড় অনুসরণ। এতেই নিহিত রয়েছে চতুর্মাত্রিক পৃথিবীর বাইরে টেকসই জীবনের মূলমন্ত্র, যা অপ্রাপ্তিকে ভরে দেয় পূর্ণতায়। জীবন হয়ে ওঠে সফল ও পরিতৃপ্ত। তখনই কেবল আশা করা যায় অনাচার আর দুর্বৃত্তায়নের নিয়ন্ত্রণ।
[email protected]