ফারুক ওয়াসিফ
নিজ দেশে নির্বাসিত আমরা কিছু লোক
এক চোখে জ্বালা আর অন্য চোখে শোক
কথা বুজে আসে রক্তে, শ্বাসে চাপা দম
হত্যার লটারি আজ তুলল কার নাম?
জঙ্গি নামক খুনিদের হামলার সময়ও মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়। ভয় না–পাওয়া কিছু মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ, যাঁদের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের লোকও আছেন, তাঁদের হাতেও ধরা পড়েছিল কয়েকজন। বনানীর সুউচ্চ ভবনের সেই আগুনে মানবতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন অগ্নিসেনা সোহেল। ভয় তাঁকে অবশ দর্শক করেনি। রানা প্লাজার নরকের গর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ বাঁচাতে ভয় পায়নি অজস্র তরুণ। কিন্তু যখন প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎ হত্যা হয়, যখন বদরুল চাপাতি তোলে খাদিজার গায়, যখন হাতুড়ি পিটিয়ে কোমর ভাঙা হয়, আর যখন বরগুনার রিফাত শরীফকে কোপানো হয়, তখন মানুষ জড় পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। প্রকাশ্যে সশস্ত্র সন্ত্রাস দেখামাত্রই মানুষ বুঝে যায় তাদের পরিচয়। কারা এখন বাংলাদেশে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে ঘুরতে পারে? কোপাতে পারে যাকে-তাকে? কারা তারা, কারা তারা? চাপাতি–হাতুড়ি–বন্দুক কয়েকজনকে হয়তো খুন করে, কিন্তু হত্যা করে অধিকাংশের মানবতাকে, সাহসিকতাকে।
মানুষ সবচেয়ে ভয় পায় তাদেরই, যাদের নাম নেওয়াও বিপজ্জনক। তখন মানুষ দর্শক হতেও ভয় পায়, পুলিশে ফোন দিতেও ভয় পায়। ধরুন, কিছু মানুষ ঘুরে দাঁড়াল। জাপটে ধরতে গেল অস্ত্রধারীকে। হয়তো সে নিজেও আহত হলো। কিন্তু সেখানেই তো ঘটনাটা শেষ হবে না। দুষ্টের বিচার আর শিষ্টের সুরক্ষা হবে না। অস্ত্রধারীরা ফোন দেবে তার দলবল-ভাইবেরাদরকে। তারা আসবে। প্রতিবাদকারীদেরও পেটাবে বা খুন করবে। থানা থেকে অপরাধীকে ছিনিয়ে নেবে। বিচারের দড়ি লম্বা করতে করতে কয়েক বছর পার করে ফেলবে। এর মধ্যে বাধাদানকারীরা তো বটেই, তাদের আপনজনেরাও ঝুঁকিতে পড়বে। সোনাগাজীর আগুনে–শহীদ নুসরাতের বাড়িতে পুলিশ পাহারা দিতে হয়েছিল কেন? অপরাধীদের পুলিশে দিয়েও ভয়ে থাকতে হয়, এই বুঝি খুনিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে প্রতিশোধ নিতে এল? এমনকি বিচারে শাস্তি হওয়ার পরও নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না, মহান ক্ষমার ছায়া যদি ওদের বিদেশ পাঠিয়ে দেয়! মানুষ সব জানে ও দেখে। মানুষকে দুষে লাভ নাই।
রিফাত শরীফের হত্যাকাণ্ড বোঝায়, কোন চেতনা অবশ করা ভয়ের পরিবেশে আমরা বাস করছি। যে ক্ষমতার চাপাতি রিফাত-খাদিজা-তনু-সাগর-রুনীকে কোপায়, যে ক্ষমতার হাতুড়ি মাজা ভাঙ্গে ছাত্রের, সেই চাপাতি–হাতুড়ি–বন্দুকই ক্ষমতার আসল চরিত্র—বাকিসব লোকভোলানো বিজ্ঞাপন।
মানুষ দর্শক হয়ে যায়। কারণ মানুষ জানে চাপাতি একা নয়, সঙ্গে সহমতভাইরা আছে। এক চাপাতি বাধা পেলে হাজারো চাপাতি দৌড়ে আসবে, এক মানুষ খুন হলে লাখো মানুষ ভয় পাবে।
মানুষ নৃশংস হয়ে যায়, কারণ তারা ক্ষমতার চরিত্রকে কপি করে ক্ষমতায়িত হতে চায়, কোনো বাধা তো নেই। বাধা তো আছে কেবল বাঁচতে চাওয়ায়। দুর্বৃত্ত ক্ষমতা মানুষকেও নষ্ট করে কাউকে ভীরু দর্শক আর কাউকে নির্দয় জানোয়ার বানিয়ে তোলে।
আমরা তো আরও বহু অন্যায়ের দর্শক। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপ, হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট ও পাচার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি সুন্দরবন ধ্বংস হচ্ছে, ভোট ডাকাতি হচ্ছে, প্রতিবাদের অধিকার লোপাট হচ্ছে ৫৭ ধারায়। দেখতে দেখতে আমরা চীনদেশীয় সম্রাটের মাটির প্রজার মতো ভঙ্গুর ও জবরজং হয়ে গেছি। একটা আদিবাসী প্রবাদ আছে, যখন মাটি নষ্ট হয়, তখন মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়। সমাজ হলো মানবজমিন, সেই জমিনটাকে দুঃশাসন, দুর্নীতি, লোভ, ভয় আর লাভের টোপে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। যখন জনগণ শাসক বদলাতে পারে না, তখন শাসকেরাই জনগণের চরিত্র নষ্ট করে দেয়, বদলে দেয়। তাদের করে তোলে ভীরু, লোভী ও পলায়নপর।
সাধারণ মানুষের দশা এখন খাঁচায় পোরা মুরগির মতো। একটি মুরগিকে তুলে নিয়ে জবাই করার সময় বাকি মুরগিগুলো কিন্তু নীরবই থাকে। তারা একসঙ্গে চিৎকার করে না, ছোটাছুটি করে না, খাঁচায় কামড় বসায় না। তাতে হয়তো কিছুই হতো না, কিন্তু কসাইয়েরা জানত যে মুরগিরা পোকামাকড়ের চেয়ে বেশি সরব ও প্রতিবাদী। যদি মানুষ এমন করে চিৎকার করত, ঠেকাতে যেত বা দূর থেকে ঢিলটাও মারত, তাহলে একজন মানুষের প্রাণ বাঁচতো আর খুনিরাও বুঝত, নাগরিক একা নয়, বিচ্ছিন্ন নয়, দুর্বল নয়। তারা ভয় পেত। বুঝে যেত যে কারও বউকে চুরি করা, কারও বোনকে উত্ত্যক্ত করা, কারও মেয়েকে ধর্ষণ করা কারও ভাইকে বা কারও বাবাকে হত্যা করা যাবে না।
কিন্তু তা হয় না আর আজকাল। খুনের দৃশ্যের দর্শকেরা জানে, যে যেখানে দাঁড়িয়ে সে একাই দাঁড়িয়ে। সে বিচ্ছিন্ন নাগরিক। আইনের সুরক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন, সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন। সে নৈরাষ্ট্রের নৈনাগরিক। কিন্তু একজন মাস্তান, সন্ত্রাসী, ক্যাডার, নেতা যখন একটা আঙুলও তোলে, মানুষ বুঝে যায় সেই আঙুলের পেছনে পাওয়ারফুল বডি আছে। সেই বডিতে রাবণের মতো আছে মাস্তান, সন্ত্রাসী, ক্যাডার, নেতা, দল, এমনকি প্রশাসনের বহু মাথা। একটি রাখাল যেভাবে শত শত ভেড়ার পালকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমরা সেভাবেই জীবন চালাচ্ছি।
আমাদের হাত বাঁধা। বাঁধা অবস্থায় আমরা বিশ্বজিতের খুনিদের ছাড়া পেতে দেখি, সাগর-রুনি-তনু-অভিজিতের খুনের বিচার হতে দেখি না, দেখি প্রতিবাদীকে আরও বিপদ চাপাতে। দেখে দেখে আমরা নীরব হয়ে যাই। বাস্তবতা নামক টেলিভিশনে আমরা দেখি অপরাধের দৃশ্য আর হাত গুটিয়ে থাকি। হাত তুলতে পারি কেবল তালি দেওয়ার জন্য, যখন নাকি সেখানে ক্রিকেট খেলা হয়।
যাদের কোনো ক্ষমতা নেই, তাদের জন্য অবশ্য রয়েছে ফেসবুকে সীমিত সুযোগের বিরাট অফার। প্রতিবাদ প্রতিবাদ প্রতিবাদ প্রতিবাদ। ভুলে যাওয়া ভুলে যাওয়া ভুলে যাওয়া ভুলে যাওয়া। আবার হত্যা হত্যা ধর্ষণ ধর্ষণ। আবার প্রতিবাদ, ভুলে যাওয়া, আহা উহু উফ্। ফেসবুকের প্রতিবাদের উৎসবে বিবেক শান্ত হতে পারে কারও, কিন্তু বাস্তবতা কিছুমাত্র বদলায় না। সীমিত মাত্রায় প্রতিবাদ করা যাবে কিন্তু কিছুই বদলাবে না, এমন পরিস্থিতিও টিকিয়ে রাখা হয় যাতে শেষ পর্যন্ত মানুষ বুঝে ফেলে যে প্রতিবাদ করে লাভ নেই।
গত কয়েক বছরে সমাজে যে ভয়াবহ নৃশংসতা ঘটতে দেখছি, তা ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজের আলামত। মানবজমিন যদি বিষাক্ত হয়ে যায়, মানুষ যদি ক্ষমতার দ্বারা অবদমিত থাকে, তাহলে বিকারগ্রস্ততা দেখা দেবে। বিদেশি দখলদারির কঠিন পরিবেশে, স্বৈরশাসনে, ভয়ানক দারিদ্র্য ও বেকারত্বে হতাশা যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে সামাজিক স্তরে একের দ্বারা অপরের বিনাশ। এই বাস্তবতা আলজেরিয়ায় দেখেছি, হাইতিতে দেখেছি, আফ্রিকা–এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার স্বৈরশাসনাধীন দেশে দেখেছি। মানুষ যখন নিপীড়নকারী ব্যবস্থা বদলাতে পারে না, তখন নিজেরাই বদলে যায়। তখন কেউ হয়ে পড়ে নিপীড়নের সহযোগী আর কেউ তার শিকার। শিকার ও শিকারি ছাড়া জংলি বাস্তবতায় আর কাউকে দেখা যায় না। ভাই তখন ভাইকে হত্যা করে, প্রতিবেশী ছাল তোলে প্রতিবেশীর।
সমস্যার মধ্যেই সমাধান আছে। যখন প্রতিবাদে কাজ হয় না, তখন প্রতিরোধ করতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিপীড়নের প্রতিবাদে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ড লিখে একাই ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেছিলেন। বিবেক যাদের ছিল, তারা তাতে নড়ে উঠেছিল। আমেরিকায় ষাটের দশকে এক কৃষ্ণাঙ্গ মা তাঁর শিশু হত্যার প্রতিবাদে লড়াই শুরু করে অনেককে জাগিয়েছিলেন। একসময় বদলে গিয়েছিল আমেরিকার বর্ণবাদী চেহারা। আজ আমাদের দৃষ্টান্ত চাই প্রতিবাদের, জাগরণ চাই মানবিকতার। একটা–দুটা বিচার হলেই সব থেমে যাবে না—যদিও সেই বিচারই–বা করে কে। বিচার হলেও হয় অনেক দেরিতে। এমন অবস্থায় সমাজ ও জনতা বলে কিছু যদি থেকে থাকে, তলানি থেকে তাকে জেগে উঠতেই হবে।
মাঠপর্যায়ে অপরাধীরা অপরাধ করার আগে, পকেটে পিস্তল বা হাতে চাপাতি নেওয়ার সময়ই যাতে ভয় পায় পুলিশকে। পুলিশ যাতে ভয় পায় জনতার কাছে জবাবদিহিকে। জনতাকে যাতে ভয় পায় প্রশাসক ও শাসকেরা। তাই গণতন্ত্র যেমন লাগবে, তেমন লাগবে আইনের গণপাহারা। কিন্তু যখন জনতার মধ্যে সুবিধাবাদ, পুলিশ-শাসক-প্রশাসকের মধ্যে জবাবদিহির অভাব খুব বেশি, তখন সমাজটা হয়ে ওঠে মুরগির খোঁয়াড়। তখন অপরাধী ভয় পায় না, পুলিশ যেমন উচিত তেমন করে নড়ে না, তখন ক্ষমতাসীনেরা সুবচন দিয়ে শিশু ভোলানোর মতো কোটি কোটি মানুষকে ভোলান।
তখন যা হওয়ার কথা, তা–ই হলো বরগুনার শরীফ হত্যাকাণ্ডে। আমরা কোন অবস্থায় বেঁচে আছি, তা যেন দেখিয়ে দিয়ে গেল। আমরা এমন এক জীবনমৃত্যুর খেলার লটারি কিনেছি, যেখানে কবে কার নাম উঠবে, তা আগাম বলার উপায় নেই। তবে এটা নিশ্চিত, আমাদের কারও কারও জন্য হয়তো আজই শেষ দিন। শেষ হবার আগেই জেনে যাওয়া ভাল, প্রথম হত্যাটা হয় অবিচারের মাধ্যমে তৈরি হওয়া খুনের পরিবেশ, দ্বিতীয় হত্যা জনতার দর্শক হয়ে যাওয়ার মধ্যে। তৃতীয় যে হাতটি হত্যাটা ঘটায় সেটা করে খুনীরা। রিফাত হত্যা দৃশ্যে এই তিনপক্ষই যার যার ভূমিকায় দাঁড়ানো। নুসরাত হত্যায়ও কিন্তু জড়িত ছিল বহুপক্ষ। আমরা বড়জোর, খুনের প্রত্যক্ষ হাতটার বিচার চাই, প্রথম দুই হাতটাকে রেহাই দিয়ে গেলে মৃত্যুর লটারিতে আমাদের নাম ওঠানো আর বন্ধ হবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।