সারা দেশের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক ও কর্মচারীর এমপিওভুক্তিতে জালিয়াতির অভিযোগে করা মামলায় চার্জশিট দেওয়ার আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তকারী কর্মকর্তা ও উপপরিচালক আব্দুস সাত্তার সরকার ও তাঁর সহকারী এনামুল হক শিক্ষা অধিদপ্তরের পাঁচ কর্মকর্তার কাছে মোট এক কোটি ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘুষের টাকা না পেয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা শিক্ষা অধিদপ্তরের কম্পিউটার সিস্টেম (ইএমআইএস) বিভাগের ওই পাঁচজনের মধ্যে চারজনকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই কর্মকর্তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, তাঁদের কাছে জনপ্রতি ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। সেটা না পেয়ে তাঁদের ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই কর্মকর্তাদের কাছ থেকে দুদক কর্মকর্তার ঘুষ চাওয়ার দুটি অডিও রেকর্ড সংগ্রহে করেছে ‘দৈনিক কালের কণ্ঠ’। সেসব অডিও ও কালের কন্ঠের প্রদিবেদক হায়দার আলীর প্রদিবেদনে উঠে এসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। উঠে এসেছে দুদককে ঘুষ দিয়ে কিভাবে পার পেয়ে যান মূল হোতারা?
অভিযোগ ওঠা দুদকের উপপরিচালক আব্দুস সাত্তার সরকার সম্প্রতি অবসরে গেছেন। তাঁর সহকর্মী এনামুল হক সহকারী উপপরিদর্শক পদে চাকরিতে আছেন। অভিযোগ করা শিক্ষা অধিদপ্তরের চার কর্মকর্তা হলেন সিস্টেম অ্যানালিস্ট আবুল ফজল মো. বেলাল, প্রগ্রামার জিয়াউর রহমান, সহকারী প্রগ্রামার মো. রফিকুল ইসলাম ও নজিব উদ দৌলা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৩ সালের মে মাসে জালিয়াতি করে সারা দেশের ২৬৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করে সরকারের ৪২ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৫ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিস্টেম অ্যানালিস্ট আবুল ফজল মো. বেলালসহ পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন আব্দুস সাত্তার। তিনিই মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পান।
অভিযোগ রয়েছে, এমপিওভুক্তিতে জালিয়াতিতে যাঁরা সরাসরি জড়িত—অফিস সহকারী, সহকারী প্রধান, সহকারী পরিচালক ও উপপরিচালকদের কাছ থেকে আব্দুস সাত্তার মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাঁদের মামলার আসামি করা থেকে বাঁচিয়ে দেন। জালিয়াতির মাধ্যমে যাঁরা এমপিওভুক্ত হয়েছেন সেই ২৬৫ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা কিংবা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাঁরা নিয়মিত বেতন পেয়ে যাচ্ছেন। যাঁদের স্বাক্ষরে ওই শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হন, তাঁরা হলেন শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী প্রধান, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, সহকারী পরিচালক ও উপপরিচালক। তাঁদের বিরুদ্ধে দুদক কর্মকর্তা কোনো ব্যবস্থাই নেননি। কিন্তু শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির বিষয়ে যাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, কোনো স্বাক্ষরই নেই—এমন পাঁচ কর্মকর্তাকে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, জালিয়াতির মূল হোতা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাধন কুমার দাস, সহকারী পরিচালক তানজির মোশারফ, আব্দুল কুদ্দুসসহ তাঁদের সিন্ডিকেটের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে মামলা ও চার্জশিট থেকে তাঁদের বাদ দিয়েছেন আব্দুস সাত্তার।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এমপিওভুক্তির বিষয়ে নিজে বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছিলেন আব্দুস সাত্তার। শাহবাগ থানায় করা মামলা দুটির মধ্যে একটি স্কুল শাখার এমপিওভুক্তির জালিয়াতি, অন্যটি মাদরাসা শাখার জালিয়াতি। মামলার পর কমিশন থেকে স্কুল শাখার জালিয়াতির তদন্তের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। আর মাদরাসা শাখার তদন্ত করেন উপপরিচালক হেলালউদ্দিন। মাদরাসার শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জালিয়াতির মামলায় সিস্টেম অ্যানালিস্টদের স্বাক্ষরসহ কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় তাঁদের নাম বাদ দিয়েই চার্জশিট দেওয়া হয়। কিন্তু আব্দুস সাত্তার স্কুল শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জালিয়াতির বিষয়ে চার্জশিটভুক্ত করেন সিস্টেম অ্যানালিস্ট বিভাগের ওই চার কর্মকর্তাকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য প্রথমে আবেদন করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান। তাঁর আবেদনটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কাগজপত্র পাঠানো হয় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। সেখানে নানা প্রক্রিয়া শেষে আবেদনটি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ফরোয়ার্ডিংসহ পাঠানো হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে। সেখান থেকে উপপরিচালক সাধন কুমার দাস স্বাক্ষর করার পর অফিস সহকারী ফাইল অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। অফিস সহকারী, প্রধান সহকারী থেকে সহকারী পরিচালক তানজির মোশারফ ও সহকারী পরিচালক আব্দুল কুদ্দুসের স্বাক্ষরের পর উপপরিচালক সাধন কুমার দাস হয়ে ফাইলটি অনুমোদিত হয়।
এরপর অফিস সহকারীরা অনুমোদিত শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করেন (ভেটেড শিট)। এই ভেটেড শিট অফিস সহকারী, প্রধান সহকারী, সহকারী পরিচালক ও উপপরিচালকের স্বাক্ষর শেষে প্রশাসন বিভাগে যায়। এরপর সিস্টেম অ্যানালিস্টের কাছে সেই শিট জমা দেওয়া হলে অপারেটররা শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর সহকারী পরিচালক তানজির মোশারফ ও আব্দুল কুদ্দুস এবং সাধন কুমার দাসের স্বাক্ষরসহ চূড়ান্ত এমপিও শিট ব্যাংকে বেতনের জন্য পাঠানো হয়। শিক্ষক এমপিওভুক্তির এই প্রক্রিয়ার দাপ্তরিক কাজে কোথাও কম্পিউটার সেলের কর্মকর্তাদের কোনো ক্ষমতাই থাকার কথা নয়।
২০১৬ সালে দুদকের উপপরিচালক আব্দুস সাত্তার ও এনামুল হক ঘুষের টাকা না পেয়ে চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট আদালতে পাঠান। একজন আসামি সহকারী প্রগ্রামার মো. আসাদুজ্জামানকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়।
গতকাল সোমবার সকালে কথা হয় সিস্টেম অ্যানালিস্ট আবুল ফজল মো. বেলালের সঙ্গে। তিনি দুদকের মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে বলেন, ‘জালিয়াতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দুদক প্রতিবেদন জমা দেয়নি, মামলাও করেনি। আমাদের কাছে দুদক কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার সরকার ও এনামুল হক কয়েক দফায় ২৫ লাখ টাকা করে চেয়েছিলেন; কিন্তু আমরা দিইনি। আমরা যে অপরাধ করিনি তার জন্য কেন দুদক কর্মকর্তাকে টাকা দেব। টাকা না দেওয়ায় আমাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। সেই মামলায় এখন আদালতে ঘুরতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ঘুষ চাওয়ার কয়েকটি অডিও রেকর্ডও আছে আমার কাছে। দুদক কার্যালয়ে বসেই ঘুষ চান আব্দুস সাত্তার। আমার অফিসে এসেও টাকা চেয়েছিলেন।’
মামলার আরেক আসামি সহকারী প্রগ্রামার জিয়াউর রহমান বলেন, ‘এমপিওভুক্তির জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতরা টাকা দিয়ে বেঁচে গেলেও আমাদের ফাঁসিয়ে দিয়েছেন দুদক কর্মকর্তা। আমার কাছে টাকা চেয়েছিলেন। আমি বলেছি, মিথ্যা মামলায় জেল খাটব; কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘দুদকের কর্মকর্তাদের জুলুমের কারণে আমার পরিবারটিই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সন্তানরা লজ্জায় কারো সঙ্গে মিশতে পারে না। এই কষ্টের কথা কাউকেই বলতে পারি না।’
অভিযোগের বিষয়ে দুদকের সহকারী উপপরিদর্শক এনামুল হক বলেন, ‘শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার জালিয়াতি নিয়ে আব্দুস সাত্তার স্যার কাজ করছিলেন। আমি স্যারের সঙ্গে ছিলাম। স্যার বিভিন্ন কাজে আমাকে পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু আমি কারো কাছে ঘুষ চাইনি।’ কোটি টাকা ঘুষ চাচ্ছেন—এমন অডিও রেকর্ড আছে জানালে এনামুল বলেন, ‘ভাই, আপনি তো বোঝেন, আমরা বসের অধীনে কাজ করি। এখন কিছু বলতে পারছি না। আমি ঢাকার বাইরে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে আছি। ঢাকায় ফিরে বুধবার আপনার সঙ্গে দেখা করব।’ এ কথা বলেই তিনি লাইন কেটে দেন।
সদ্য অবসরে যাওয়া আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘অনেক দিন আগের ঘটনা, আমি এখন কিছুই বলতে পারছি না। আর আমি কারো কাছ থেকে ঘুষ দাবি করিনি।’ ঘুষ চাওয়ার অডিও রেকর্ড কাছে আছে জানালে তিনি বলেন, ‘আমি অবসরে চলে এসেছি, এখন এসব মনে নেই আমার। এসব রেকর্ড মানুষ নিজের হাতে বানাতে পারে। কত কিছুই বানাতে পারে মানুষ, কণ্ঠও বানাতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এনামুল যদি ঘুষ চেয়ে থাকে সেটা তার ব্যাপার।’
সূত্র: কালের কন্ঠ