অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
দল ও জোটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বৃহস্পতিবার সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের গণফোরামে যোগ দিয়ে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে নির্বাচন করেন সুলতান মনসুর। ৭৯ হাজার ৭৮২ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হন। এখানে নৌকার প্রার্থী ছিলেন বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া সাবেক সংসদ সদস্য এমএম শাহীন। তিনি পান ৭৭ হাজার ১৭১ ভোট। সুলতান মনসুর নৌকার প্রার্থী থেকে মাত্র ২ হাজার ৬১১ ভোট বেশি পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালেও সুলতান মনসুর জাতীয় পার্টির নবাব আলী আব্বাসকে প্রায় ১৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর ২০০১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএম শাহীনের কাছে ৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। এবার তিনি সেই শাহীনকে পরাজিত করে এমপি হয়েছেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি ও ভোটের দিন ব্যাপক জালিয়াতি, কারচুপি, কেন্দ্র দখল, জালভোটসহ নানা অভিযোগে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছে ড. কামাল হোসেন ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। আর গণফোরাম ও বিএনপি থেকে যে ৭ জন নির্বাচিত হয়েছেন তারা শপথ নিয়ে সংসদে না যাওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই গণফোরামের সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান জানালেন তারা শপথ নিয়ে সংসদে যাবেন। এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে আলোচনা সমালোচনা। এমনকি দল ও জোটের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করেই গত দুইদিন আগে তারা স্পিকারকে চিঠি দিয়েছেন শপথের ব্যবস্থা করতে। ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার তারা শপথ নেবেন।
এরই মধ্যে বুধবার গণফোরামের জরুরি বৈঠকের পর জানানো হয়েছে মোকাব্বির খান শপন নেবেন না। সুলতান মনসুর তার শপথ নেয়ার ব্যাপারে অবিচল আছেন।
এখন স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কে এই সুলতান মনসুর? কি তার আসল পরিচয়? দল ও জোটের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে কেন তিনি শপথ নিয়ে সংসদে যাচ্ছেন?
দীর্ঘদিন রাজনীতির বাইরে থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামালের গণফোরামে যোগ দিলেও আসলে সুলতান মনসুর আপাদমস্তক একজন আওয়ামী লীগার। তিনি ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। তার আরেকটি বড় পরিচয় হলো-স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহতের পর মানুষ যখন বলাবলি করছিল যে আওয়ামী লীগের রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে, তখনই ৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে ভিপি নির্বাচিত হন সুলতান মনুসর।
তার আরেকটি বড় পরিচয় হলো- বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সব নেতাকর্মীই আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল। এই কঠিন সময়ে সুলতান মনসুর কাদের সিদ্দিকীর প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিল। এই প্রতিবাদের কারণে তাকে দীর্ঘদিন ভারতের মেঘালয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে।
১/১১’র পর সংস্কারপন্থীদের তালিকায় নাম আসে সুলতান মনসুরের। ভুল স্বীকার করে অনেকে দলে ফিরে আসলেও সুলতান মনসুর আসেনি। কিন্তু, সুলতান মনসুর দলের বাইরে থাকলেও মূলত তার ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তাধারা, মন-মানসিকতায় সব সময়ই লালন করেন বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছে কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগ ছাড়েন নি।
শপথ নেয়ার কারণ
একদাশ সংসদ নির্বাচনে সুলতান মনসুর বিএনপির ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া এমএম শাহীন। নির্বাচনের দিন অন্যান্য জায়গার মতো মৌলভীবাজার-২ আসনেও আগের দিন নৌকায় সিল মেরেছে। কিন্তু নির্বাচনের আগের দিন শেখ হাসিনা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে আবার দলে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এটার মুখ্য হাতিয়ার হলো তাকে এমপি নির্বাচিত করা।
মৌলভীবাজারের একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটের দিন সকালে শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন যে, মৌলভীবাজার-২ থেকে সুলতান মনসুরকে এমপি নির্বাচিত করতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ ব্যালটে নৌকার সিল মারা হয়ে গেছে। এরপর এই ব্যালট বাতিল করে নতুন করে ব্যালট নিয়ে আবার ধানের শীষে সিল মারা হয়। কিন্তু ভোট শেষে দেখা গেছে তারপরও সুলতান মনসুরের ভোট কম হয়। নৌকার শাহীনের ভোট বেশি হয়ে যায়। আর শেখ হাসিনার নির্দেশ হলো সুলতান মনসুরকে বিজয়ী দেখাতে হবে। পরে ভোটের হিসাবে গোজামিল দিয়েই সুলতান মনসুরকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
আর ভোটে এই আসন থেকে নৌকা বাদ দিয়ে ধানের শীষ নিয়ে সুলতান মনসুর কেন স্বয়ং হাসিনা নিজে দাঁড়ালেও নির্বাচিত হতে পারবেন না। এবারতো নির্বাচনের আগে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীরা মাঠেই নামতে পারেনি। ভোট দেয়াতো হলো অনেক পরের কথা। শেখ হাসিনার এ নির্দেশনায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন নৌকার প্রার্থী এমএম শাহীন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন শাহীনের সমর্থকরাও।
তবে আপদমস্তক আওয়ামী লীগার সুলতান মনসুর বিজয়ী হওয়ায় আওয়ামী লীগের লোকজনও খুশি হয়েছে। এখন শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দিয়ে মূলত সুলতান মনসুর শেখ হাসিনার অনুগ্রহের প্রতিদান দিচ্ছেন।