অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বাংলাদেশকে তিন দিক থেকে ঘিরে আছে ভারত। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতেই ভারতের সাথে সীমান্ত রয়েছে এগুলো আমরা সবাই জানি। কিন্তু সীমান্তবর্তী এই মানুষগুলোর দূর্ভোগ আমরা কতটুকু জানি। এই সব এলাকায় মানুষ আসলে খুবই অসহায় এবং নিরাপত্তাহীন অবস্থায় দিন কাটায়। তাদের আয় রোজগারের অনেক বেশী সুযোগ নেই। বাপ দাদার সময় থেকেই সীমান্তকে কেন্দ্র করেই তাদের ব্যবসা। সেই ব্যবসার কিছু মুনাফা ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তথা বিএসএফ সদস্যদের পকেটেও যায়। তা স্বত্বেও প্রায়শই, সেই বিএসএফ সদস্যদের গুলি খেয়েই জীবন দিতে হয় এই নিরীহ ব্যবসায়ীদেরকে।
শুধু সীমান্ত ব্যবসায়ী নয়, একেবারে সাধারন মানুষ কিংবা রাখাল যে হয়তো সীমান্তের পাশের কোন জমিতে গরু চড়াতে গিয়েছিল, কিংবা কোন মহিলা সে হয়তো সীমান্তের জালে কাপড় শুকাতে দিয়েছিল কিংবা হয়তো ফেলানীর মত ছোট্ট কোন কিশোরী যে কিনা সীমান্তের পাশে খেলাধুলা করতে ছুটে গিয়েছিল- এমন নারী পুরুষকেও এভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশের কোন সেনা বা অস্ত্রধারী বিজিবি সদস্য নয়- বরং একেবারেই নিরীহ ও সাদামাটা বেসামরিক মানুষগুলোকে নির্বিচারে হত্যা করছে বিএসএফ এর সদস্যরা।
সর্বশেষ, গত বুধবার রাতেও রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী-বিএসএফের গুলিতে জামাল উদ্দিন (৩৫) নামে এক বাংলাদেশি রাখাল নিহত হয়েছেন। গোদাগাড়ী সীমান্তের দিয়াড় মানিকচক (ডিএমসি) বিজিবি ফাঁড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত জামাল উদ্দিন গোদাগাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের বারীনগর ঢাবের মাঠ গ্রামের গোলাম মোস্তফার ছেলে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, জামাল উদ্দিন ও তার কয়েকজন সহযোগী বুধবার গভীর রাতে সীমান্তে যায় গরু আনতে। এ সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানার চর আষাড়িয়াদহ ক্যাম্পের বিএসএফের একটি টহল দল তাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করেন। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই জামাল উদ্দিন নিহত হন। ঘটনার কিছুক্ষণ পর তার সহযোগীরা জামাল উদ্দিনের লাশ উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যায়। পর দিন বৃহস্পতিবার সকালে গ্রামের লোকেরা জামাল উদ্দিনের লাশ দাফন করেন।
আমি কখনোই বুঝিনা, ভারতের মত বিশাল দেশের সীমান্ত বাহিনীর গ্রামের নিরীহ মানুষ বা অবলা নারীর প্রতি এই আক্রোশটা আসে কেন? এটা তো হাতির পা দিয়ে পিপড়াকে মেরে ফেলার মত অবস্থা। পৃথিবীতে ভারত বাংলাদেশই প্রতিবেশী দুটি দেশ- এমনটা নয়। মানচিত্র দিয়ে বুঝুন বা ভৌগলিক অবস্থান দিয়ে, পৃথিবীতে এখন সব দেশই পাশাপাশি অবস্থিত। একটি দেশের ভেতর দিয়ে আরেকটি দেশের সীমান্ত থাকাও নতুন কোন ঘটনা নয়। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে যেভাবে ভারতীয় বিএসএফ হত্যাকান্ড চালায়, তেমন একটি হত্যাকান্ড অন্য কোন দেশের সীমান্তে হয়েছে বলে জানা যায় না।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার গতকাল একটি তথ্য প্রকাশ করেছে যাতে দেখা যায় ২০০০ সাল থেকে শুরু কনের ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিগত ১৮ বছরে ভারতীয় বিএসএফ ১১৪৪ জন নিরীহ বেসামরিক বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে। ১০৭৮ লোক বিএসএফের গুলিতে আহত হয়েছেন। যদিও সীমান্ত এলাকার মানুষের হিসেবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশী।
সবচেয়ে ভয়ংকর যে তথ্য পাওয়া যায়, তাহলো যত মানুষ খুন বা আহত হয়েছে তার থেকে বেশী মানুষ বিএসএফ দ্বারা অপহৃত হয়েছেন। কাগজ কলমে অপহৃত মানুষের সংখ্যা ১৩৬৫ হলেও আসলে এদের কোন খোঁজও নেই। এরা কি জীবিত আছেন, ভারতীয় কোন জেলে বন্দী আছেন নাকি অন্য কোথাও এদেরকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে, তার কোন ধারনা কারও কাছে নেই। এর বাইরে নিখোঁজ হয়ে আছেন আরো ১১১ জন। এমনকি ভিকটিম পরিবারগুলো বছরের পর বছর বিএসএফের কাছে ধর্ণা দিয়েও নিখোঁজদের কোন হদিশ পাচ্ছেনা। এরা আর বেঁচে নেই বলেও অনেকে ধারনা করছেন। কিন্তু এ নিয়ে ভুক্তভোগীদের বিচার চাওয়ারও কোন জায়গা নেই। আর ভারতীয় আদালত যে বিএসএফ সদস্যদের কোন অন্যায়ের বিচার করবেনা, আর করলেও ভিকটিমের সাথে বিচারের নামে প্রহসন করা হবে- সেটাও প্রমানীত হয়ে গেছে ফেলানীর বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই। কয়েক বছর ধরে বিচার চেয়ে ফেলানীর পরিবারকে অবশেষে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে।
বিএসএফ সদস্যরা শুধু যে মানুষ হত্যা বা অপহরন করেই থেমে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। তারা সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ব্যপক হারে লুটপাটও চালাচ্ছে। এছাড়া নিয়মিতভাবে বাংলাদেশী নাম দিয়ে অবৈধভাবে অসংখ্য ভারতীয় লোককেও বাংলাদেশে পুশ ইন করে দিচ্ছে তারা। ইদানিংকালে ভারত রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সীমান্ত দিয়ে তারা যেভাবে ভারতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদেরকে জোর করে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিচ্ছে তা কোন সৌজন্যতার সংজ্ঞায় পড়েনা।
ভারতীয় বাহিনীর হাতে সীমান্তের অনেক গ্রামের মুসলিম নারী, তরুণী এমনকি কিশোরীরাও ধর্ষিত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এই খবরগুলো মুল ধারার মিডিয়াতেও সেভাবে আসেনা বলে এই নির্যাতিত মানুষগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেই এই অন্যায়গুলোকে বছরের পর বছর ধরে সহ্য করে যাচ্ছে।
ভারতীয় সীমান্তবাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশের সীমান্তে যে অন্যায় করে বেড়াচ্ছে তা যে কোন যুদ্ধবাজ সেনাবাহিনীকেও হার মানায়। তাই সময়ের দাবী হলো, বিএসএফের সকল অনিয়ম ও বিএসএফের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ তদন্ত করা। আর যেহেতু ভারতের আভ্যন্তরীন আদালত এই বাহিনীকে অঘোষিত ছাড় দিয়ে সব ধরনের অপরাধের দায় থেকে মুক্তি দিয়ে রেখেছে, তাই এখন বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভারত তোষন নীতি বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের শরনাপন্ন হওয়া। এই ভারতবান্ধব সরকার হয়তো কখনোই সেটা করবে না তবে ভারতীয় বিএসএফ সীমান্তে যা করছে তা রীতিমত যুদ্ধাপরাধের শামিল আর এজন্য তাদের বিচার হওয়া সময়ের দাবী।