অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
মানুষ তার স্বকীয় রূপের বাইরে যেতে পারেনা। একথা আবারও প্রমাণ করলেন ড. কামাল হোসেন। গণফোরামের এই প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবের ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সরকারেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শেখ মুজিব স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতায় পরিনত হয়েছিলেন তিনি। এমনকি সভাপতির পদ নিয়ে শেখ হাসিনার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন তিনি।
এবারের নির্বাচনের ঠিক আগ মুহুর্তে তিনি জোট করলেন সম্পুর্ন বিপরীত আদর্শের রাজনৈতিক দল বিএনপির সাথে। জাতীয় ঐক্যের নামে এই প্লাটফর্মটি গড়ে তোলা হলেও এই ফোরামে জামায়াতসহ অনেককেই জায়গা দেয়া হয়নি। এই ফোরামের প্রথম এ্যাসাইনমেন্ট ছিল প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপ করা। পরবর্তী সময়ে টকশোর মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, প্রথম যে সংলাপটি হয়েছিল তাতে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের তেমন কোন প্রস্তুতি ছিলনা। তাই তারা অনেকটা গুছিয়ে দ্বিতীয় দফায় আবারও সংলাপে গিয়েছিলেন। ৭ দফা প্রস্তাবনাও দিয়েছিলেন। আবার ৭ দফার একটা দফা না মানার পরও ড. কামাল হোসেন মুলা ঝুলিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনেও নিয়ে গিয়েছিলেন।
আমি প্রায়ই শুনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি নাকি যেতে চায়নি। জামায়াতই নাকি বিএনপিকে সেই নির্বাচনে নিয়ে গিয়েছিল। সেটা নিয়ে বিএনপির অনেককে জামায়াতের উপর রাগও ঝাড়তে দেখি। তারা এবারের নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এবং সেই সিদ্ধান্তের পেছনে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকাকে কিভাবে মুল্যায়ন করবে- তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
যা হোক, ড. কামাল হোসেন বা তার গণফোরাম বাংলাদেশের সবচেয়ে সুবিধাবাদী দল। তাদের দলের একজন নেতাকর্মীও গত ১০-১২ বছরে নির্যাতিত হয়নি, নিহত হওয়াতো দূরের কথা। গণফোরামের কেউ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমও হননি। ড. কামাল হোসেন তার আইনী চেম্বারে এবং দলের অফিসে অবাধে বসতে পেরেছেন, সভা সেমিনার করতে পেরেছেন। ফলে আওয়ামী দুঃশাসনের যন্ত্রনা তাকে একটি মুুহুর্তের জন্যও স্পর্শ করেনি। আর তাই তিনি ভিকটিম ও নির্যাতিত মানুষগুলোর চোখের ভাষা বুঝতে পারেননা। তাদের আবেগ বা কষ্টগুলোকে তিনি পায়ে পিষে যেতে পারেন।
ড. কামাল হোসেনের এর গণফোরামের কোন নেতা আজ অবধি জনপ্রতিনিধি হতে পারেনি। তাই জনগণের ভাষাও তিনি বা তার নেতারা বুঝেনা। বিএনপিকে কোনঠাসা করে ঢাকার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ আসনে তারা নিজেদের প্রার্থীদের মনোনয়ন নিয়ে নিলেন। সাদেক হোসেন খোকার মত জনপ্রিয় নেতা বা তার ছেলেকে না দিয়ে বিএনপি সেই আসনটি ছেড়ে দিলো গণফোরাম নেতা এডভোকেট সুব্রত চৌধুরীকে। পাশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ন আসন দিয়ে দিলো ড. কামালের বিশ্বস্ত সহচর মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে। উত্তরা-বনানীর বিএনপির নেতাকর্মীরা বিগত ১২টি বছর লড়াই করে টিকে রইলো যেই মানুষগুলোর জন্য তাদেরকে মনোনয়ন না দিয়ে এই আসনটিও ছেড়ে দেয়া হলো গণফোরামের আরেক নেতা স্¦পনকে। ফলে ঢাকায় বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীদেরকে নির্বাচনে সক্রিয় করা যায়নি পুরোপুরিভাবে।
নির্বাচনের মহা জালিয়াতি, কারচুপি আর ফলাফলে এমন ভরাডুবির পর বিএনপি যখন শোক কাটিয়ে উঠতে ব্যস্ত তখন আওয়ামী শিবিরে উল্লাস। লক্ষ লক্ষ মজলুম জনগোষ্ঠী যখন আগামী ৫ বছর কেমনে পার করবে সেই পেরেশানিতে কাতর, ঠিক তখন রক্তের সাথে বেইমানী করে গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন তার দলের বিজয়ী প্রার্থীদের শপথ নেয়ার ইংগিত দিচ্ছেন বার বার। ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি বসে শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও ড. কামাল বলে যাচ্ছেন আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তার মানে আপনি একদিকে নির্বাচনকে জালিয়াতি বলছেন, আবার শপথ নিয়ে সেই নির্বাচনকে বৈধতাও দিচ্ছেন। কেনই বা করবেন না, ড. কামাল হোসেন হলেন এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারী। অতীতে কখনো তার দলের কেউ সংসদ সদস্য নির্বাচিত না হলেও এবারই বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে এসে ধরাশায়ী করে দেয়ার পুরস্কার হিসেবে তার দলকে দুটি এমপির পদ ভিক্ষা দেয়া হয়েছে।
গত শনিবার এক সাক্ষাতকারে তিনি বিএনপিকে জামায়াতের সংগ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জামায়াতকে সাথে নেয়াতেই ঐক্যফ্রন্টকে জনগণ গ্রহন করেনি। তাহলে প্রশ্ন জাগে, তিনি যে নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সমাবেশে বলছিলেন যে মানুষ ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে জোয়ারের মত মাঠে নেমে গেছে, সেটা তিনি কেন বলেছিলেন? আসলে এটা এখন স্পষ্ট যে, তিনি দুটো টার্গেট নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট করেছিলেন। যে দুটোই প্রকৃতপক্ষে ছিল ভারতের এজেন্ডা।প্রথম এজেন্ডা ছিল ছলে বলে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসা- এটা তিনি ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করেছেন। আর এখন তিনি বিএনপি-জামায়াতের জোট ভাঙ্গার দ্বিতীয় এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। পাঠকের মনে থাকার কথা, নির্বাচনের ঠিক আগ দিয়ে ভারতীয় একটি মিডিয়াতে দেয়া সাক্ষাতকারেও ড. কামাল একইভাবে জামায়াতের বিরুদ্ধে বিষাদগোর করেছিলেন। যাই হোক, জামায়াতকে বিএনপি থেকে আলাদা করার এই এজেন্ডা বাস্তবায়নেও তিনি সফল হন কিনা এটা সময়ই বলে দেবে।
ড. কামাল হোসেন এখন ৮০ উর্ধ্ব একজন মানুষ। তাকে নিয়ে বিগত একমাস আওয়ামী বুদ্ধিজীবিরা নানা নেতিবাচক কথা বললেও এখন এসে তারাও চুপ হয়ে গেছেন। কেননা, ড. কামাল আওয়ামী লীগের যে উপকার করেছেন, আওয়ামী লীগের কোন নেতাও দলের এত উপকার করতে পারেনি। ড. কামাল তার দীর্ঘ জীবনে দেশের জন্য কি কি ভালো কাজ করেছেন জনগণ না জানলেও বিগত ৪ মাসে তার ভুমিকা জাতির সাথে বেইমানী হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।