মুসাফির রাফি
উন্নয়নের অনেক গল্প শুনি প্রতিনিয়ত। অথচ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা মনে হয় আবার পিছিয়ে গেলাম। দেশের স্বাধীনতার পর থেকেই কোন নির্বাচন গ্রহনযোগ্য হচ্ছিলোনা। নির্বাচন মানেই ছিল ভোট ডাকাতি, ক্ষমতাসীন দলের ত্রাস, সন্ত্রাস, সহিংসতা, হত্যাকান্ড ইত্যাদি।
১৯৯১ সালে তত্বাবধায়ক সরকার নামক মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযমের ব্রেইনচাইল্ড এর একটি প্রয়োগ আমরা দেখলাম। নির্বাচন যে সন্ত্রাস রাহাজানি আর ভোট ডাকাতির বাইরেও হতে পারে, মানুষ যেন তা নতুন করে জানতে পারলো।
১৯৯৬ বা ২০০১ সালেও তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন দুটো হলো তাতে সুক্ষ কারচুপি বা স্থুল কারচুপির অভিযোগ আসলেও বড় আকারের সহিংসতার হাত থেকে বাংলাদেশ কিন্তু রক্ষা পেয়ে গিয়েছিল।
আবার যেন আমরা ৯১ পূর্ববর্তী অবস্থায় পৌঁছে গেলাম। এক ধাক্কায় যেন ২৮ বছর পিছিয়ে গেলাম। ভোটের দিন কি হবে, আল্লাহ জানেন। কিন্তু তার আগে যা দেখলাম তাতে আশাবাদী হওয়ার কোন কারন নেই। পত্রিকাগুলো এখন প্রতিদিন যেন একটা খবরের শিরোনাম রেডি করেই রাখে তাহলো: নির্বাচন পূর্ব সহিংসতা। ইংরেজী পত্রিকাগুলো বলে Pre-Election Violence. এই খবরে প্রতিদিন সারাদেশে কোথায় কি হামলা হয় তা একসাথে কম্পাইল করে ছাপানো হয়। কি আজব এক অবস্থা!!
অনেকেই তত্বাবধায়ক সরকারকে অকেজো বলে। তারা দাবী করে, বিশ্বের আর কোথাও এই ব্যবস্থা নেই। আচ্ছা, বিশ্বের আর কোথাও কি এভাবে গণহারে প্রতিদিন নির্বাচনী সহিংসতা আছে?
তারা আরো দাবী করে তত্বাবধায়ক সরকার দেশের জন্য মানহানিকর। একটা রাজনৈতিক দল দেশে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারছেনা- এটা বললে দেশের সুনাম থাকেনা। যদি তাই হয়, তাহলে এভাবে যে প্রতিদিন সহিংসতা হচ্ছে, প্রার্থীকে গুলি করা হচ্ছে, তাতে কি দেশের সুনাম থাকছে?
আমি মনে করি, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনো ততটা ভাল হয়নি। সরকার মুখে যতই উন্নয়নের কথা বলুক, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই উন্নত হয়নি। ফলে বিশ্বের আর কোথাও না প্রয়োজন পড়লেও বাংলাদেশে ঠিকই তত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এবারের নির্বাচনপূর্ব পরিবেশ তা হাড়ে হাড়ে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
অনেকেই বলবেন, তত্বাবধায়ক আর আসতে পারবেনা, আদালতের রায়ে এই পদ্ধতি বাতিল হয়ে গেছে। এটা সত্য নয়, এটা সরকারী প্রচারণা। আদালত তার রায়ে আরো দুটো নির্বাচন তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের করতে বলেছিলেন। আদালত বলেছিলেন, যদি সংসদ চায় তাহলে আরো দুটো নির্বাচন তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যাবে।
এই সংসদ যদি চায়- রায়ের এই অংশের অপব্যবহার করেছে সরকার। যেহেতু তারা ক্ষমতায়। আর ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের পর গোটা সংসদই তাদের হাতে। এমনকি বিরোধী দলটাও হাতের মুঠোয়। তাই যা ইচ্ছে তা করার যে ক্ষমতা সরকারের আছে তাকে অপব্যবহার করেই সরকার এক ঝটকায় তত্বাবধায়ক সরকারকে বাতিল করে দিয়েছে। তারা দেশের স্বার্থ দেখেনি, দলের ক্ষমতায় থাকার স্বার্থটুকুই শুধু বিবেচনা করেছে।
যেহেতু আদালতের রায়ের খন্ডিত অংশ সরকার মেনেছে, তাই বর্তমান সহিংস পরিস্থিতিতে যে নাগরিক সংক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে রীট করতে পারেন। তারা তত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা এবং সরকারের গোয়ার্তুমির বিষয়টা সামনে এনে আবারও তত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে রিট করতে পারেন। আবার আদালত স্বতপ্রণোদিত হয়ে তত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার রুল জারি করতে পারেন।
এছাড়া চলমান নির্বাচনী সহিংসতার অবসানের আর কোন পথ আমাদের সামনে খোলা নেই। অনেকে মনে করছেন, নির্বাচন যদি কোন মতে হয়ে যায়, তাহলেই এই অবস্থার অবসান ঘটবে, আমি তা মনে করিনা। নির্বাচনের যে হালচাল দেখছি, তাতে নির্বাচন হলেও সবাই মেনে নেবে- এমনটাও হবেনা। ফলে যাই হোক না কেন, আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকেই হাটছে বাংলাদেশ।