হাসান রূহী
আশাবাদী হতে চাই। মোটেও হতাশ হতে চাই না। আমিও চাই না। জনগণও চায় না। কিন্তু এই আশা বেঁধে রাখবো কোন পর্যন্ত? কতক্ষণ? সে ব্যাপারে আমি নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের পরামর্শ চাই।
এই নির্বাচন কমিশনার আজ জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছেন- ‘আপনার ভোট অন্য কেউ দিয়ে দিলেও হতাশ হবেন না।’ সংবাদ মাধ্যমে তার এই বক্তব্য পড়ার পর হতাশ হবো কখন! হাসবো নাকি কাঁদবো সেই সিদ্ধান্তই এখনও নিতে পারিনি।
যাইহোক, কথিত মহাশক্তিধর নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে সিরিজ আকারে বিগত এক মাসে যতগুলো বক্তব্য এসেছে তার অধিকাংশই বিভ্রান্তিকর, হাস্যকর ও হতাশাব্যঞ্জক। বিশ্বের কোনো দেশের কোনো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এ ধরণের আজগুবি বক্তব্য দেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। নির্বাচন কমিশনের এসব দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ ও কথা-বার্তা নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। সে প্রতিবেদনে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের হালচাল তুলে ধরতে গিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো: শাহনেওয়াজ এর মন্তব্য তুলে ধরেছেন বিবিসি বাংলার প্রতিবেদক।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো: শাহনেওয়াজ বলেন- “প্রধানত ভাষা প্রয়োগের কারণেই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। তাদেরকে আরো সাবধানী হতে হবে কারণ সারা জাতি, ভোটাররা তাকিয়ে আছে নির্বাচন কমিশন কখন কী করছে সেটা দেখার জন্য।”
চলুন দেখে নেওয়া যাক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম কি বলতে চাচ্ছেন! তিনি বলেছেন- ‘নির্বাচনের দিন গণমাধ্যমে দেখতে পাই কোন একজন ভোটার বলছেন, আমার ভোটটা দেয়া হয়েছে গেছে! অথচ এটা কোনোভাবেই হওয়ার কথা নয়। নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা ঠিকমত দায়িত্ব পালন করলে একজনের ভোট আরেকজনের দেয়ার কথা নয়। তারপরও এরকম ঘটনা ঘটে গেলে আইনে এর প্রতিকার রাখা আছে।’
অর্থাৎ জনগণকে তিনি আইনের মূলা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এক কথায় যদি বলি তাহলে তার কথার সারমর্ম হলো এই যে, যদি কেউ ভোট দিতে গিয়ে দেখেন তার নামে ভোট দেয়া হয়ে গেছে তবে আইন অনুযায়ী তিনিও ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন। আমি আইনজ্ঞ নই। অতি সাধারণ মানুষ। তাই আইনের ব্যাখ্যাও আমি দিব না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে যাবে কিভাবে? রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে জাতীয় পরিচয় পত্র আর স্মার্ট কার্ড বিতরণ করার ফলাফলটা কি? পরিচয় পত্র ছাড়া একজন কিভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন? যদি তা কেউ করতে পারেনই তবে এই আইডি কার্ডের কাজ আসলে কি?
জানি এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর বর্তমান নখ দন্তহীন মহাশক্তিধর নির্বাচন কমিশনের নেই। আর তা নেই বলেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা একেকজন হাছান মাহমুদ আর ওবায়দুল কাদেরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ফলে কখনও তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মূর্তি বানাতে চাচ্ছেন। কখনও সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়ার নিত্য নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করছেন। কখনও ভোটারদের ভোট দিতে না পারলেও হতাশ না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
কিন্তু এতকিছুর মধ্য দিয়েও জনমনে যে প্রশ্ন ঘুরে ফিরছে তা হলো- এত আজগুবি পরামর্শের ডালা সাজিয়ে ঘুরে বেরালেও ভোট ডাকাতি ঠেকাতে নির্বাচন কমিশন কি করতে পারবে তা বলছে না কেন? অস্ত্র ও পেশীর ক্ষমতা প্রদর্শনকারীদের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কি? ভোটারদের নিরাপত্তার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কি করতে পারবে? কিংবা এবারের নির্বাচনও কি বিগত ১০ বছর ধরে ইউনিয়ন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত প্রহসনের নির্বাচন হবে?
ভোটাররা হতাশ হতে পারেন এমন হাজারো পরিস্থিতি ও উদাহরণ সৃষ্টি করেছে ক্ষমতাসীন আ. লীগ ও তাদের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এমন কী করতে পেরেছে যে এই নির্বাচন কমিশনের উপর হতাশ না হয়ে জনগণ আস্থা রাখতে পারবে?
বিগত কয়েকটি নির্বাচনে অনেকগুলো পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল ‘আপনার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে…বাড়ি যান’ ‘আড়াই ঘন্টায় ব্যালট পেপার শেষ!’ ‘জাল ভোটের পর দুপুরেই ব্যালট শেষ’। শুধু তাই নয়, মৃত মানুষের নামেও ভোট দিয়ে যাওয়ার মত ভয়ানক অবিশ্বাস্য খবরও পত্রিকার পাতায় ছাপানো হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যম আর চায়ের দোকানে হাস্যরসও কম হয়নি।
এসব খবরের কোন ব্যাখ্যা বা সদুত্তর কি নির্বাচন কমিশনের কাছে আছে? একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দিবে এমন দুঃখজনক, লজ্জাজনক পরিস্থিতির প্রতিকার না করে কিভাবে নির্বাচন কমিশন তা মেনে নিয়ে হতাশ না হওয়ার কথা বলছে! জনগণের ভোটের কি কোনই মূল্য নেই!
অন্ধকে হাইকোর্ট দেখানোর মত করে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল হকের আইনের মূলা প্রদর্শনকে কিসের সাথে তুলনা করা যেতে পারে তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব আপনাদের। আমি শুধু একটি গল্প বলে শেষ করতে চাই। কোন এক দুর্ঘনায় একজন লোক নিহত হওয়ার পর তা দেখতে আসা উৎসুক জনতার একজন বলে উঠলো ‘লোকটা মরে গেছে ঠিক। কিন্তু চোখটা ভালো আছে।’
আইন অনুযায়ী যদি এমন হয় যে, একজনের ভোট অন্য কেউ দিলে সত্যিকার অর্থে যিনি ভোটার তিনি ফের তার ভোট দিতে পারবেন। কিন্তু ওই ব্যক্তির নামে কোন ভোট ডাকাত যদি ভোট দিতেই পারে, তবে এই নির্বাচন কমিশন নামক ঠুটো জগন্নাথের থাকার প্রয়োজনটা কি? যদি কোন ভোটারের ভোট অন্য কেউ তার বিপরীত দিকে তথা অপছন্দের প্রার্থীতে দিয়ে থাকে, তবে প্রকৃত ভোটার পরে ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে ভোটের অঙ্কটা কি এমন হবে ১+১ = ০! ব্যাপারটা অনেকটা ক্রন্দনরত কোনো বাচ্চাকে ভূতের গল্প বলে সান্তনা দেয়ার মত হয়ে গেল না?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট