হাসান রূহী
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের কথা বলছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পেট্রলবোমা হামলায় আহতদের দেখতে গিয়ে মোমবাতির আগুনে পুড়ে যাওয়া শিশু জুঁই এর পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন। মিডিয়ার কল্যাণে এ দৃশ্যের ছবি ও ভিডিও ভাইরালও হয়েছিল। কিন্তু বেরসিক কোন এক সাংবাদিক তুলে ধরেছিলেন আসল সত্য। জানা গিয়েছিল- শিশুটি মোমবাতির আগুনে দগ্ধ। ফলে সেসময় জনমনে প্রশ্ন উঠেছিল- ‘প্রধানমন্ত্রী কি আসলেই দগ্ধদের দেখতে গিয়েছিলেন? নাকি শুধুই ফটোসেশন?’
সে যাইহোক, আমরা আপাতত ধরেই নিচ্ছি তিনি দয়ার সাগর, মাদার অব হিউম্যানিটি। তিনি সত্যিই কেঁদেছিলেন। আহত হয়েছিলেন আহত মানুষের অবস্থা দেখে। ভাল ধারণা আমরা করতেই পারি। এতে দোষের কি?
এবার চলুন আজকের পত্রিকার দিকে নজর দেয়া যাক। দৈনিক প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম – ‘ধর্মঘটে অ্যাম্বুলেন্সকে বাধা, শিশুর মুত্যু।’ ইত্তেফাকের শিরোনাম- ‘পরিবহন ধর্মঘটে অ্যাম্বুলেন্স আটকা পড়ে শিশুর মৃত্যু।’ কালেরকণ্ঠের শিরোনাম- ‘পরিবহন শ্রমিকদের হাতে আটক অ্যাম্বুলেন্স, নবজাতকের মৃত্যু।’ প্রায় সবগুলো জাতীয় পত্রিকায় আজ এ খবর এসেছে। হৃদয়বিদারক এ খবরটি প্রচারিত হয়েছে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও। অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যতম বিতর্কিত মন্ত্রী শাজাহান খানের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা ধর্মঘট চলাকালে অসুস্থ শিশুবাহী ওই অ্যাম্বুলেন্সকে বাধা দেয় শ্রমিকেরা। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়। একইভাবে দাসেরবাজার এলাকায় আটকানোর পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে চান্দগ্রাম বাজারে আবারও শ্রমিকেরা গাড়িটি আটকায়। এ সময় অ্যাম্বুলেন্স চালককে গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করা হয়। শিশুটি তখন একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পথিমধ্যে তাকে বিয়ানীবাজার হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মাত্র কয়েকদিন আগে দুইজন শিক্ষার্থীকে বাসচাপায় হত্যা করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন আমরা সবাই দেখেছি। সেখানে দেখা গেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য ইমার্জেন্সি গাড়ির জন্য আলাদা ইমার্জেন্সি লেন তৈরী করেছে। দেশে বিদেশে তাদের এসব ছবি বেশ প্রশংসিতও হয়েছে। কিন্তু আজ আমরা কেমন এক আন্দোলন দেখলাম? অসুস্থ সাত দিন বয়সের একটি কন্যা শিশু কিছু বুঝে ওঠার আগেই সড়কে ত্রাস সৃষ্টিকারী শাজাহান গ্যাংদের নৃশংসতায় দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল!
পত্রিকার খবর মারফত জানতে পেরেছি নৃশংসতার শিকার ওই শিশুটির পিতার নাম কুটন মিয়া। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে- ব্রহ্মণবাড়িয়ার মোমবাতির আগুনে পুড়ে যাওয়া শিশু জুঁইয়ের মতই কুটন মিয়ার শিশুটির লাশের পাশে কি প্রধানমন্ত্রী দাঁড়াতে পারবেন? পারবেন কি শত শত মিডিয়া ডেকে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে? সাম্ভাব্য উত্তর ‘না’।
কারণটা খুবই স্পষ্ট। কুটন মিয়ার মেয়ের লাশের খবর শুনে শাজাহান খান যদি দাঁত কেলিয়ে হেসে ওঠে তবে সেটিই ঠিক। মানবতা এখানে অর্থহীন। তারচেয়ে বরং ধরে নিন- ভুল করে এ হায়েনার দেশে জন্ম নিয়েছিল কুটন মিয়ার কন্যা। তাই সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিদায় নিয়েছে। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিকভাবে এ নিয়ে রাজনীতি করার কিছুই নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট