অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
যে কোন সরকার তার মেয়াদের শেষ দিকে এসে ভাল কাজ বেশী করবে। উন্নয়নের গল্প বেশী শোনাবে। আর পেছনে করে আসা ভুল বা অন্যায়গুলো থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে। এটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার বোধ হয় একমাত্র ব্যতিক্রমধর্মী সরকার যে কিনা নির্বাচনের দোরগোড়ায় এসেও পুরনো স্টাইলেই বেপরোয়াভাবে তার অন্যায়কর্মগুলো চালিয়ে যাওয়া অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনগুলো সাধারণত ব্যর্থ হয় না। কিন্তু এবার কোটা আন্দোলন ও তার পরবর্তীতে নিরাপদ সড়কের দাবীতে ছাত্রদের যে আন্দোলন হয়েছে সেটার মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ সরাসরি বাধা না দিয়ে বরং চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছে। কোটা আন্দোলনকারীদের আশ্বাস দিয়ে থামিয়ে দিয়ে পরে তাদের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছে। কোটা আন্দোলনের সকল নেতাদেরকে একে একে আটক করেছে।
সড়ক আন্দোলনের একেবারে শেষ দিকে বেসরকারী নর্থ সাউথসহ আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সম্পৃক্ত হয়। আন্দোলনটি থেমে যাওয়ার পর ব্লক রেইড দিয়ে পুলিশ ছাত্রদেরকে আটক করেছে। আর সেখানেই সরকার তার পুরনো বর্বরতম কৌশলটি আবার প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। সেটা হলো, কোন ওয়ারেন্ট ছাড়াই সাদা পোশাকে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং তাকে আদালতে হাজির না করা।
গত দুই মাসে কয়েক দফায় এরকম করে প্রায় শতাধিক ছাত্রছাত্রীকে অজ্ঞাত পরিচয়ে তুলে নিয়ে পরবর্তীতে তা অস্বীকার করা হয়েছে। সর্বশেষ যে ১২ জন ছাত্রকে নানা স্থান থেকে আটক করে নেয়া হয়, তাদের পরিবারগুলো সন্ধান চেয়ে অনেক দৌড় ঝাঁপ করলেও, সংবাদ সম্মেলন করলেও প্রশাসনের তাতে টনক নড়েনি। বরং পুলিশ বলেছে এরকম কাউকে নাকি তারা আটকই করেনি। অথচ ১৩ দিন পর তাদেরকে আদালতে উপস্থিত করা হয়। নিজেদের অন্যায় ধামাচাপা দেয়ার জন্য পুলিশ আটককৃতদের বিভিন্ন জনের যে সময় উল্লেখ করে তা আটককৃত ছাত্ররা অস্বীকার করেন। ফলে পুলিশের নয়ছয়টা সকলের কাছে ধরা পড়ে যায়।
এরপর একইভাবে হজ্ব থেকে ফেরত বাবা-মাকে রিসিভ করতে গিয়ে গোপন গ্রেফতার অভিযানের ভিকটিম হয় ছাত্রশিবির ঢাকা পূর্বের সভাপতি শফিউল আলম। অবাক লাগে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় পড়ে আছি যেখানে আপনজনকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করাটাও কারও কারও জন্য ঝুকিঁপূর্ন। একটা বাবা-মা যারা সদ্য আল্লাহর ঘর বা রাসুলের (সা.) রওজা জিয়ারত করে তৃপ্তি সহকারে দেশে ফিরলেন, তাদের জন্যেও বিষয়টা কতটা অমানবিক তা অনুমান করাটা কঠিন নয়।
শফিউলের গ্রেফতারের পর তার মোবাইলের সুত্র ধরে আরোও ৪জন ছাত্রকে আটক করা হয়। তাদের পরিবার পরিজনেরাও থানায় থানায় ধর্না দিচ্ছেন। কিন্তু যথারীতি এবারও পুলিশ এসব আটক হওয়ার দাবীকে অসত্য বলে অস্বীকার করছে। বাংলাদেশের ফৌজধারি বিধি অনুযায়ী যে কোন অভিযুক্তকে আটকের ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার বিধান রয়েছে। মহামান্য হাইকোর্টও বেশ কয়েকবার এ ব্যপারে পুলিশ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে এবং তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছে। কিন্তু কয়লা ধুলেই কি আর ময়লা যায়?
এই অপকর্মগুলো পুলিশের রক্ত মজ্জায় একেবারে মিশে গেছে। হয়তো দু একদিন পর পুলিশ আটক ৫ ছাত্রকে আদালতে তুলে বলবে গতকাল রাতেই এদেরকে আটক করা হয়েছে। অতএব ২৪ ঘন্টা পার হওয়ার কোন প্রশ্নই আসেনা।
বাংলাদেশে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এর আগে নানা সময় অভিযোগ তুলে বলেছে যে, র্যাবসহ সরকারের বিভিন্ন আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে আটকের পর দীর্ঘসময় তা গোপন করে রাখছে।
আইনজীবীরা বলেছেন, কাউকে আটকের পর ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা না হলে, সেটা হবে আইন বহির্ভূত। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন এ প্রসংগে বলেন, “এমন ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ঘটনা কিন্তু অহরাহ ঘটছে।আমরা পর্যবেক্ষণে অনেক ক্ষেত্রে দেখছি, কেউ নিখোঁজ হওয়ার পর তাদের আতœীয় স্বজনরা থানায় জিডি করেছেন। এর দীর্ঘদিন পর আটক ব্যক্তিকে কোন মামলায় আটক দেখিয়ে হাজির করা হচ্ছে।”
তবে আইনজীবী তানজীব-উল-আলম বলেছেন, “সংবিধানেই বলা আছে, আটক ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বা আদালতে হাজির করতে হবে। এই যে একটি মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি সংবিধানে আছে। সকল আইন সংবিধানের আলোকে করতে হয়। ফলে আটকে কোন ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে হাজির করবে না, এমন কোন সুযোগ বাংলাদেশে নেই। ফলে কাগজ কলমে পুলিশকে অন্তত তাই দেখাতে হচ্ছে”
আইন শৃংখলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা অবশ্য কাউকে আটকে ক্ষেত্রে আইন অনুসরণের দাবি করেছেন। তারা বলছেন, কারও যদি মনে হয় যে তার ক্ষেত্রে আইন সঠিকভাবে মানা হয়নি তাহলে তাহলে তিনি আদালতে যেতে পারেন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ভয় কাজ করে। ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা এমন বিষয় নিয়ে কখনও চ্যালেঞ্জ করতে চায় না।
আইন শৃংখলা বাহিনী বা আইনকে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে এ সরকার যেভাবে জনগনের সাথে তামাশা করলো, তার নজির সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের কোথাও দেখা যায়না। স্বাধীন দেশে কোন সরকার তার জনগনের সাথে এভাবে অন্যায় করবে, মায়ের বুক থেকে বিনা অপরাধে সন্তানকে কেড়ে নিয়ে যাবে- এটা মেনে নেয়াও যায়না।