অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বেগম খালেদা জিয়া। বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক জোট ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা। ৭৩ বছরের এই নারী দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। সাবেক সেনা প্রধানের স্ত্রী। তার স্বামী একজন সেক্টর কমান্ডার এবং একটি স্বতন্ত্র ফোর্সের প্রধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে ভুমিকা পালন করেছেন। স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবেও পরিচিতি আছে তার স্বামীর। স্বামীকে হারিয়েছেন বহু আগে। জীবন যুদ্ধে একা দুই সন্তানকে মানুষ করেছেন। স্বামীর গড়া দলকে আপোষহীনভাবে নেতৃত্ব দিয়ে ৩ বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন।
আজ তার স্বামী নেই। একটি সন্তান মারা গেছে। আরেক সন্তান বহুদূরে প্রবাসে। মামলার ভয়ে দেশে আসতে পারছে না। এরকম এক বাস্তবতায় ৭৩ বছরের এই হাই প্রোফাইল রাজনৈতিক নেত্রীকে গত ফেব্রুয়ারী মাস থেকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। সেই মাসেই জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট এর একটি কথিত দুর্নীতি মামলায় তাকে ৫ বছরের সাজা দেয়া হয়।
নিম্ন আদালতের ৫ বছরের সাজায় উচ্চ আদালত থেকে সহজেই জামিন পাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও খালেদা জিয়ার বেলায় তা ঘটেনি। বরং ছলচাতুরী ও নানা কৌশল করে, অন্য মামলায় জামিন না দিয়ে তাকে মাসের পর মাস জেলে বন্দী রাখা হয়েছে।
৭৩ বছরের কোন মানুষ মুক্ত অবস্থায় থাকলেও তার শরীরে নানা ধরনের রোগব্যাধি এসে ভীড় করে। সেখানে খালেদা জিয়া একজন মহিলা হওয়া স্বত্বেও তাকে বন্দী রেখে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তার আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানে তাকে চিকিৎসা সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। পৃথিবীর সকল আইনে এমনকি যুদ্ধের বেলায়ও নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে নানা ছাড় দেয়া হলেও বাংলাদেশের বর্তমান সরকার নারী নিপীড়নের নতুন এক ইতিহাস সূচনা করলো এই মেয়াদে।
তারা খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছে। তিনি আসলেই অসুস্থ নাকি ভান করছেন- এমন অযুহাতও তারা তুলেছে। এর উপর আবার জুলুমের মাত্রা বাড়ানোর জন্য আরেকটি দুর্নীতির চলমান মামলাকে ঢাকার পুরনো জেলখানার একটি রুমে স্থানান্তরিত করেছে। খালেদা জিয়াকে বাইরের প্রকাশ্য আদালত ও প্রকাশ্য বিচার থেকে বঞ্চিত করে ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে আরেকবার তড়িঘড়ি করে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যেই সরকার এভাবে কারাগারে আদালত বসিয়েছে। যদিও সামরিক শাসন বা জরুরী অবস্থা ছাড়া আদালতে কোর্ট বসানোর ছিলছিলা এর আগে ছিল না বাংলাদেশে। আর রাজনৈতিক বা সিভিলিয়ান কোন নাগরিকের বিচার তো কখনোই জেল আদালতে করা হয়নি। এটা বেগম খালেদা জিয়া ও তার অসুস্থতার সাথে সরকারের আরেক দফা পরিহাস।
মূলত বিএনপি আন্দোলন করতে ব্যর্থ হওয়াতেই সরকার খালেদা জিয়ার উপর নিত্য নতুন স্টিম রোলার চালাচ্ছে বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা দাবী করছেন। তবে এখন সব রাজনীতির বাইরে যেই বিষয়টা গুরুত্ব দেয়া দরকার সেটা হলো একজন প্রবীন নারীর অসুস্থতা। গতকাল শুক্রবার খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাত করে তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন যে বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। শুধু তাই নয়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিএনপির কারাবন্দী চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিশেষায়িত হাসপাতালে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন জয়নুল আবেদীন।
জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘ম্যাডামকে আমরা যেভাবে দেখেছি, তাতে তিনি কীভাবে আগের দিন আদালতে এসেছেন, সেটা নিয়ে ভাবছি। তিনি বাঁ হাত ও পা নাড়াতে পারেন না। বাঁ পাশ পুরো অবশ হয়ে গেছে। তাঁর চোখেও প্রচন্ড ব্যথা। চোখের ভবিষ্যৎ কী, সেটা বলা যাচ্ছে না।’
খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা না দেয়ায় তাঁর শরীরের এই অবস্থা হয়েছে দাবি করে জয়নুল আবেদীন বলেন, এ কারণে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে বিশেষায়িত হাসপাতালে নেয়া হোক। ইউনাইটেড, অ্যাপোলো বা যেকোনো বেসরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করা হোক। আগে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, পরে বিচার। খালেদা জিয়ারও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তিনি তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে এর আগে তাঁর পরিবারও সাক্ষাত করেছেন। তারাও জানিয়েছেন, নেত্রী অত্যন্ত অসুস্থ। তাঁর বা হাত ও বাম পা প্রায় অবশ হয়ে গেছে। অসহ্য ব্যথা অনুভব করছেন তিনি।
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, সরকার খালেদা জিয়াকে অবৈধভাবে কারাগারে আটকে রেখে হত্যা করতে চায়।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “সরকার জানে যে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। তাই বিভিন্ন মামলায় জামিন পাওয়া সত্ত্বেও বিএনপি চেয়ারপারসনকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি এখনও বিষয়টার রাজনৈতিক তাৎপর্যটা অনুধাবন করলেও মানবিকতার বিষয়টা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি। তাই জনগনের মনেও এ ব্যপারে সঠিক ধারনা নেই। তারা নেত্রীর ব্যপারে সহানুভুতিশীল হলেও দলের ভুমিকায় হতাশ। এমতাবস্থায় সব ধরনের রাজনৈতিক হিসেব নিকেষের উর্ধ্বে উঠে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করা সময়ের অপরিহার্য দাবী।