অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আওয়ামী লীগের পায়ের নীচে মাটি নেই। তারা জনগন থেকে সম্পুর্নরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে- এরকম অভিযোগ বিরোধী দলের। অন্যদিকে সরকার মহল দাবী করে বিরোধী দলের জ্বালাও পোড়াও নীতিকে প্রত্যাখান করে জনগন আওয়ামী লীগের উপরই আস্থা রেখেছে। নিজেদের দাবীর যথার্থতা প্রমান করতে গিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক জরিপ প্রতিষ্ঠান আইআরআইকে দিয়েও সম্প্রতি জরিপ চালিয়ে ফলাফল নিজেদের পক্ষে বানিয়ে নিয়েছে। আইআরআই বলছে দেশের ৬৬ শতাংশ মানুষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে দেখতে চায়। পরিস্থিতি যদি এই হয়, তাহলে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের কোন ভয় তো থাকার কথা নয়। সেটা তত্বাবধায়কের অধীনে হোক কিংবা নির্বাচনকালীন অন্য কোন সরকারের অধীনে হোক।
কিন্তু হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশন এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং বা ইভিএম চালু করার ঘোষনা দেয়। সেটা আংশিকভাবে হলেও। বিএনপি ও জামায়াতসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো ইতোমধ্যেই ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দিয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন আওয়ামী সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে ইতোমধ্যেই যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে। তারা সরকারের চিন্তার আলোকেই ইভিএম চালুর ঘোষনা দিয়েছে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। বিষয়টি আরো পরিস্কার হয় যখন বিমসটেক সম্মেলন শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার সংবাদ সম্মেলনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে অবস্থান নেন।
ইভিএম পদ্ধতি কি খুব ভালো কিছু? পৃথিবীর কোথায় কোথায় ইভিএম আছে? ইভিএম ব্যবহারের সুফলই বা কেমন এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে জানতে পারলাম, পৃথিবীর শতকরা ৯০ ভাগ দেশে ই-ভোটিং পদ্ধতি নেই। যে কয়েকটি দেশ এটি চালু করেছিল, তারাও ইতোমধ্যে তা নিষিদ্ধ করেছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল কোর্ট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। একই বছর ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট ইভিএমে সম্পন্ন তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
ড. অ্যালেক্স হালডারমেন নামে এক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছিলেন, আমেরিকায় ভোট কারচুপির প্রতিরোধক (টেম্পার প্রুফ) নয় ইভিএম। ফলে সেই অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকার ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অন্যগুলোতেও তা নিষিদ্ধ হওয়ার পথে।
সম্প্রতি ইভিএম তথা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে কারচুপি সম্ভব বলে অভিযোগ তুলে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ফের ব্যালট পেপারে ভোটের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। তারা একযোগে নির্বাচন কমিশনের কাছে ইভিএমের মাধ্যমে কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ জানিয়েছে। এভাবে বিশ্বব্যাপী আস্থা হারাচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)।
অথচ ঠিক এমনই সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) দেড় লাখ ভোটিং মেশিন কেনার পথে হাঁটছে। এ জন্য ৩৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা।সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে আরপিও সংশোধন করা হচ্ছে। যদিও সমালোচনার মুখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন যে, তিনি ইভিএম নিয়ে সমালোচনাগুলোকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন এবং সংসদ প্রয়োজন মনে করলেই তারা ইভিএম চালুর বিষয়ে কাজ করবেন নইলে নয়।
২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেখানকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের সময় ইভিএম বন্ধ হয়ে যায়। তার পর এটি সারানো আর সম্ভব হয়নি। ফলে ওই কেন্দ্রে আবার ভোট গ্রহণ করতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। এসব সমস্যা চিহ্নিত করতে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বুয়েটকে একাধিকবার অনুরোধ করা হলেও তারা সমস্যা চিহ্নিত করেনি, বরং ইসি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ তোলে বুয়েট।
গত চার বছরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ইভিএম নিয়ে কারসাজির অজস্র অভিযোগ তুলেছে একাধিক বিরোধী দল। এবারে নির্বাচন কমিশনের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে গিয়ে কংগ্রেসসহ একাধিক বিরোধী দল দাবি জানিয়েছে ইভিএম পদ্ধতিটাই বাতিল করে দেয়া হোক।
কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভি বলেছেন, শুধু আমরাই নই। দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দলই মনে করে যত দ্রুত সম্ভব কাগজের ব্যালট আবার ফিরিয়ে আনা উচিত। এই দাবিতে আমরা অনড় থাকব। কারণ ইভিএমের ওপর আমাদের বিশ্বাস চলে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জালিয়াতির সুযোগ থাকায় ইভিএমে এক চাপে ৫০টি ভোট দেয়া সম্ভব। বিদেশের মাটিতে বসেও ইভিএম হ্যাকিং করা যায় এবং একটি ইভিএম হ্যাকিং করতে এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না।
এদিকে প্রথম আলোর ৩০ আগষ্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে আসা গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এখন শেষ সময়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএমের বিষয়টি সামনে এনে নতুন বিতর্ক তৈরি করছে। যদিও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। ইসিও এত দিন বলে এসেছে, সব দল না চাইলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুুতি বা কারিগরি সামর্থ্যও এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। এই সময়ে ইসি কেন বা কার স্বার্থে ইভিএম নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ইভিএম পদ্ধতিতে জালিয়াতি করে এক চাপে ৫০ ভোট দেয়ার সুযোগটাকেই মুল কারন হিসেবে বিবেচনা করছে সবাই। ধারনা করা হচ্ছে, সরকার মহলের পছন্দের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে চাইলে ইভিএম এর মত ইলেকট্রনিক জালিয়াত পদ্ধতির কোন বিকল্প নেই।