আবুল মোমেন
এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এ দেশের ছাত্র-গণ-আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসের এক গর্বিত অংশীদার। ছাত্রলীগের এ ইতিহাস কেউ অস্বীকার করবে না। সম্ভবত এখন আর বিতর্ক নেই যে সেটা ইতিহাসই। ছাত্রলীগের বর্তমান নিয়ে গৌরব বা গর্ব করার উপায় আছে কি? গৌরবময় ইতিহাসকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কি বর্তমানের নেতিবাচক ভূমিকাকে আড়াল করা যাবে? ছাত্রলীগের বা আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা যদি এমনটাই ভাবেন তো তাঁদের জানতে হবে, সেটা মোটেও বাস্তবতা নয়। বাস্তবতা হলো ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের বুঝদার নেতা-কর্মীরাই প্রকৃত বাস্তবতা নিয়ে বিব্রত এবং তাঁদের অনেকেই স্পষ্টভাবে অসন্তুষ্টিও প্রকাশ করে থাকেন।
এ কথা সত্য, গত শতকের ষাটের দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন একযোগে কাজ করেছে। ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তি ও ছয় দফা ঘোষণার পরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের নেতৃত্বেই সেদিন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। এ কথাও সত্য, ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পরে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তির কাজ করেছে।
এরশাদের স্বৈরশাসনের সময় জিয়াউর রহমান-সূচিত জামায়াত-শিবির পুনর্বাসনের কাজ সম্পন্ন হয়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এলাকায় তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এ সময় ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপক হারে অস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। ক্যাম্পাসে দখলদারি চালু হয় এবং মাস্তানি ছাত্ররাজনীতির অংশ হয়ে ওঠে। সত্যের খাতিরে এ কথাও বলতে হবে, স্বাধীনতার পরপর একদিকে সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের জন্য প্রাপ্ত মর্যাদার অপব্যবহারে লিপ্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীও।
আর অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে ছাত্রলীগের বিভক্তির ফলে দলের অনেক মেধাবী নেতা-কর্মী নতুন অংশে যুক্ত হয়ে যান। এভাবে স্বাধীনতার পর থেকেই মূল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং তার প্রভাবে অন্যান্য পর্যায়েও মেধাবী আদর্শবাদী দক্ষ রাজনৈতিক কর্মীর ঘাটতি শুরু হয়। পরবর্তীকালে এই ঘাটতি সব দলে কমবেশি ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণে আজ জাতীয় রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, এখনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য হওয়ার মতো নেতা-সংগঠকেরা সবাই ষাটের দশকের ছাত্ররাজনীতি থেকেই উঠে এসেছেন।
সরকারের দিকে তাকালেও দেখব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পর্যন্ত যাঁরা রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করছেন, সবাই ষাটের আন্দোলনের সৃষ্টি-যদিও জনাব কাদের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছিলেন। অন্যান্য দল থেকে এ রকম রাজনৈতিক ব্যক্তি যাঁরা আওয়ামী লীগে এসেছেন এবং বর্তমানে চৌদ্দ দলের শরিক হিসেবে সরকারে যোগ দিয়েছেন, তাঁরাও ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল।
অথচ স্বাধীনতার পরে, বিশেষ করে পঁচাত্তরের নির্মম ঘটনা ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে আন্দোলন-সংগ্রাম তো কম হয়নি। কত কত ছাত্র-তরুণ শহীদ হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন এবং অসংখ্যজন বিভিন্ন দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। যত দিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে, তত দিন ডাকসু ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি-সম্পাদক হিসেবেও তো কম নেতা-কর্মী দায়িত্ব পালন করেননি। কিন্তু কই তাঁদের কারও নাম কি জনস্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে? তাঁদের মধ্যে অনেকে অর্থবিত্তের দিকে গেছেন, অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে ছা-পোষা জীবন যাপন করছেন, হয়তো অনেকেই রাজনীতিতে আছেন, বড় দলেই আছেন, কিন্তু নেতা হিসেবে তাঁরা পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়েছেন-এমন কথা বলা যাবে না।
সত্য হলো, ছাত্ররাজনীতির আজ দুর্দশা চলছে। এ কেবল আদর্শের ঘাটতি নয়, মুক্তিযুদ্ধের পরে তারুণ্যকে দেশ গড়ার গঠনমূলক কাজে লাগানোর যথাযথ পরিকল্পনা আমাদের নেতৃত্বের ছিল না। যুদ্ধফেরত তরুণদের রণাঙ্গনের, দেশান্তরের, শরণার্থী জীবনের যে ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা ঘটেছিল, তা তাঁদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিল। ১০ জনকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো বীরত্বব্যঞ্জক কিছু করার তাগিদ নিয়েই সেদিন তাঁরা ছটফট করেছেন। তাঁদের সেই প্রাণশক্তি ও ইচ্ছাকে দেশ গঠনের কাজে লাগানোর ভাবনা-পরিকল্পনা দেখা যায়নি। অনেকে নিজের খেয়ালে নানা অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়েছেন, অনেকে ক্ষমতার ছায়ায় থেকে যথেষ্ট কর্তৃত্বের সুযোগ নিয়েছেন। সেই দাপট হলের ক্যানটিনে, লন্ড্রিতে, আশপাশের দোকানপাটে যেমন, তেমনি অন্য সংগঠন কিংবা নিরীহ-অসহায় ছাত্রদের ওপরও চলেছে এবং তার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। কাউকে আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার সামর্থ্য হারিয়ে আজকের নেতৃত্ব ক্ষমতার আশ্রিত হয়ে জবরদস্তির মাধ্যমে কর্তৃত্ব চালাচ্ছে।
কর্তৃত্ব আর মহত্ত্বের তফাত আশা করি সবাই বোঝেন। একে সাধারণ ছাত্ররা অত্যাচার হিসেবেই গণ্য করে। কিশোর-তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণাদানকারী ভাষণ, বক্তব্য কিংবা আলাপচারিতার যোগ্যতা হারিয়ে যাঁরা স্বাভাবিক নেতা নন, তাঁরা অস্বাভাবিক আচরণই তো করবেন। অস্ত্র ও বলপ্রয়োগ তারুণ্য এবং রাজনীতি উভয়েরই বিকারের লক্ষণ। এই অবক্ষয়ের ধারা না রাজনৈতিক দল, না বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাঙ্গনের কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকেরা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন; বরং এই অরাজক ব্যবস্থাকে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগিয়ে লাভবান হচ্ছেন নানাজন। এ রকম জবরদস্তির মাধ্যমে অর্জিত ক্ষমতা নিরঙ্কুশ আধিপত্য নিশ্চিত করতে অপর সবাইকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে তোলে।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে যে বর্বর কায়দায় ছাত্রলীগ দমন করার চেষ্টা চালিয়েছে, তাকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মুখর অংশ উসকানি দিয়েছে এবং নির্দলীয় আন্দোলনটিকে পিটিয়ে ঠান্ডা করার পক্ষে যুক্তি হিসেবে চক্রান্তের দোষ ধরা হলো। যখন এসব কথা বলা হচ্ছে, তখন খোদ আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সম্পাদক উভয়েই দলের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের অনুপ্রবেশ ও চক্রান্তের কথা বলেছেন। কারা আওয়ামী লীগের ঘর দখলের কিংবা ঘর ভাঙার দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের আওয়ামী লীগকেই খুঁজে বের করতে হবে। তবে তাদের খোঁজ যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মধ্যে মিলবে, সে সম্ভাবনা খুবই কম; বরং আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগে ঢোকার সুযোগ অনেক সহজ, এমনকি ঢুকে এমপি ও নেতা হওয়াও সম্ভব। এই সহজ পথ ছেড়ে কেন কেউ হাতুড়িপেটা হওয়ার জন্য পিঠ, হাত, পা পেতে দেবেন?
কেন ছাত্রলীগ ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত এ আন্দোলনকে থামাতে বর্বর আক্রমণের পথ বেছে নিল? কেনই-বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও একশ্রেণির আওয়ামী নেতার মতো কথাবার্তা বলে পিটুনিবাহিনীকে মদদ দিচ্ছেন, তা বোধগম্য নয়। বোধগম্য নয় আরও এ কারণে যে সরকার এবং খোদ প্রধানমন্ত্রী তো কোটা সংস্কারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। এ জন্য কমিটিও গঠন করা হয়েছে এবং প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য কমিটিকে মাত্র ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। আসলে একটা পুরোনো রোগ ভেতরে-ভেতরে ঘুণপোকার মতো ক্ষমতার রাজনীতিতে লালিত হচ্ছে বহুদিন ধরে। আর সেটা হলো ক্ষমতাসীন দল ছাড়া আর কেউ মাঠে নামতে পারবে না, ভালো বা ন্যায্য কাজের জন্যও নয়। ভালো-মন্দ সব কাজ, সব কথা কেবল ক্ষমতাবানদেরই এখতিয়ারের বিষয়। মাঠে ওরা একাই থাকবে, কোনো প্রতিপক্ষ নয়।
এ অবস্থায় নিরপেক্ষ কিংবা ভিন্নমতকেও সহ্য করার ক্ষমতা আর থাকে না। এই মনোভাবটা কিন্তু আইয়ুব-মোনায়েমদের এনএসএফের চেয়েও মন্দ। কারণ এনএসএফ সরকারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বক্তব্য বা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে তখন দুরমুশ পার্টি হিসেবে মাঠে নামত। কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে কোনো পাগলেও সরকার পতনের আন্দোলন বলবে না। আর কেউ যদি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে সে রকম জুজুর ভয় দেখিয়ে সফল হতে পারে, তবে তাকে বাহবা দিতে হবে। বুঝতে হবে তাদের চক্রান্তের সফল হয়েছে।
আওয়ামী লীগ বানের জলে ভেসে আসা দল নয়, আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার শক্ত ভূমির ওপরই এতকাল দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজকাল জুজুর ভয়ে কাতর হওয়া একশ্রেণির নেতা-কর্মীর মুখে আবোলতাবোল কথা শুনে মনে হয় যে হ্যাঁ, আওয়ামী লীগে-ছাত্রলীগে হুড়মুড় করে বেনোজল ঢুকে পড়েছে। ভয় এই যে তারাই স্রোতটা তৈরি করে বইঠা হাতে নিয়ে নেয় কি না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
সূত্র: প্রথম আলো