অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিন এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মিনাক্ষী গাংগুলী সম্প্রতি ‘এ ভায়োলেশন অব হিউম্যান রাইটস’ শীর্ষক একটি কলাম রচনা করেছেন যেখানে তিনি বাংলাদেশের চলমান ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভুত হত্যাকানণ্ড নিয়ে বেশ কিছু মতামত ব্যক্ত করেছেন। কলামটির ভাষান্তর করেছে অ্যানালাইসিস বিডি। পাঠকের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো।
“বছর খানেক আগে আমি শামসুন্নাহার নামে এক মহিলার সাথে সাক্ষাত করেছিলাম। তার ২৪ বছরের ভাইটিকে র্যাব গুলি করে হত্যা করে। র্যাবের পক্ষ থেকে এই হত্যার ব্যপারে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, কামরুল ইসলাম ওরফে বাপ্পী নামের একটি ছেলে ঐ এলাকায় আছে জেনে তারা অভিযানে যায়। পরবর্তীতে ঐ ক্রিমিনাল তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে, র্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়ে এবং সেভাবেই বাপ্পীর মৃত্যু হয়।
কিন্তু র্যাব আসলে হত্যা করে উপরোক্ত শামসুন্নাহারের ভাই কায়সার মাহমুদকে, যার ডাক নাম বাপ্পী। র্যাব নাকি শুধু বাপ্পী নামটি জেনেই কায়সারকে তুলে নিয়ে যায়। শামসুন্নাহার এই প্রসঙ্গে বলেন, তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শুনেছেন, তার ভাই বেশ কয়েকবার র্যাব সদস্যদেরকে অনুরোধ করেছিল আর বলেছিল, “আমাকে মারবেন না দয়া করে। আপনারা ভুল করছেন। আমি একটি ভাল ছেলে, ভাল পরিবারের সন্তান”। কিন্তু তার এই সব অনুরোধ কোন কাজেই আসেনি।
ঘটনাটি নিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ বেশ চাপ দিলে কর্তৃপক্ষ এই হত্যাকান্ডের বিষয়ে একটি তদন্ত চালায় যাতে তারা শেষমেষ স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে র্যাব আসলে ভুল মানুষকে হত্যা করেছে কেননা তারা প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে সঠিকভাবে যাচাই করেনি। তদন্তকারীরা সেসময় ঘটনার সাথে দায়ী ব্যক্তিদেরকে বিচার করার কথাও সুপারিশ করেছিল কিন্তু সরকার তা আমলে নেয়নি।
এরকম কিছু ঘটনা বাংলাদেশে ঘটছে বলেই চলমান মাদক বিরোধী অভিযানের কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়েও মানুষের মনে উদ্বেগ উৎকন্ঠা বেড়েছে কয়েকগুন। এভাবে বিচার বহির্ভুত হত্যা চালিয়ে র্যাব ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হচ্ছে।
যদিও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবী করছেন যে নিরীহ কেউ মারা গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু আজ অবধি তার কোন লক্ষন দেখা যায়নি। বরঞ্চ আইনশৃংখলা বাহিনীকে মানুষ মারার ওপেন লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হয়েছে।
গত মাসের শেষ দিকে, তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত কক্সবাজারের পৌর কাউন্সিলর একরামের পরিবার হত্যা পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে দুটি অডিও ক্লিপ ফাঁস করে। সেটা শুনে অবশ্য দেশের সুশীল সমাজের টনক নড়ে যায়। তারা বিবৃতি দিয়ে জানায়, প্রতিদিন যেভাবে অসংখ্য মানুষকে বিচার বহির্ভুত উপায়ে হত্যা করা হচ্ছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এভাবে মানুষ হত্যা কল্পনাও করা যায়না। এ ধরনের ঘটনায় গোটা মাদক বিরোধী অভিযানই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে বলেও তারা অভিমত ব্যক্ত করে।
একরামের পরিবার ঐ সংবাদ সম্মেলনে অডিও ক্লিপ ফাঁস করার সময় আরো দাবী করে যে একরামকে বন্দুকযুদ্ধে নয় বরং ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। উল্লেখ্য কথিত এই মাদক বিরোধী অভিযানের নামে মাত্র ২৪ দিনে ১৪০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
তবে র্যাব যে হারে মানুষ মারছে এবং যেভাবে মিথ্যা প্রমানের ভিত্তিতে নিরীহ মানুষদেরকে হত্যা করা হচ্ছে এবং যেভাবে বন্দুকযুদ্ধের নামে সাজানো হত্যার প্রমান বেরিয়ে আসছে তাতে অনেকেই বিশেষ করে দেশী বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো বেশ কয়েক বছর ধরে র্যাবকে বিলুপ্ত করার দাবী জানিয়ে আসছেন। বাংলাদেশের পুলিশের বিরুদ্ধেও এভাবে বিনা বিচারে হত্যা এবং কাস্টডিতে নিয়ে হত্যা করার অসংখ্য অভিযোগ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাওয়া গেছে।
একরাম হত্যার পর বাংলাদেশের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এরকম দুই একটা ভুল হতেই পারে। আমরা তদন্ত করে দেখছি।
তবে বিগত কয়েক বছরের ইতিহাস বলে বাংলাদেশের সরকার কখনোই এসব ঘটনায় আন্তরিকভাবে তদন্ত করতে চায় না। তারা মানুষকে বোকা বানানোর জন্য সাময়িকভাবে এসব তদন্তের বুলি আওড়ায়।
সরকার যদি সত্যিকারার্থেই মাদক দমনে আন্তরিক হয়, তাহলে তাদেরকে আইন শৃংখলা বাহিনীর এসব অপরাধের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে, কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সর্বোপরি প্রতিটি বিচার বহির্ভুত হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদেরকে শাস্তি দিতে হবে। তাহলেই মানুষের মনে আইন শৃংখলা বাহিনীর প্রতি আস্থা ফিরে আসবে। নতুবা আইন শৃংখলা বাহিনীর ঐসব বন্দুকযুদ্ধের বয়ানকে জনগন মিথ্যা বলেই গন্য করবে সবসময়।