অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে কয়েকশত গুমের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই বিরোধী দলের নেতাকর্মী। তাদেরকে অপহরন করেই অজ্ঞাতনামা স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের আর কোন খোঁজ কেউ পায়না। বুধবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশের এই ভয়াবহ অবস্থার কথা। ‘বাংলাদেশে গুম হওয়া মানুষগুলোর আজও সন্ধান মেলেনি’ শিরোনামে আল জাজিরার প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করেছে অ্যানালাইসিস বিডি। পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য মীর কাসেম আলীর শাহাদাতের মাসখানেক আগে তার সন্তান ও আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমান নিখোঁজ হন। ঘটনাটি ঘটে ২০১৬ সালের ৯ আগষ্ট। এই সময় তার স্ত্রী ও বোন অভিযোগ করেন সেদিন রাতে ৮/১০ জন সাদা পোশাকধারী লোক তাদের বাড়ীতে এসে অভিযান চালায় এবং আরমানকে তুলে নিয়ে যায়। যদিও তারা কেউ তখন নিজেদের পরিচয় দিতে পারেনি। কোন গ্রেফতারি পরওয়ানাও তারা দেখাতে পারেনি। তার স্ত্রী ফারহানা তাহমিনা জানান, আরমানকে রেডি হতে তারা মাত্র ৫ মিনিট সময় দিয়েছিলো।
আরমানের স্ত্রী ও বোন সাথে সাথেই আশেপাশের মানুষগুলোর কাছে সাহায্য চাইতে ছুটে গিয়েছিলেন কিন্তু কয়েক মিনিটের মাঝেই আরমানকে খালিপায়ে তারা টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় এবং একটি নাম্বারহীন মাইক্রোবাসে তুলে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আরমানের দুই শিশু মেয়ের আর্ত চিৎকার কিংবা স্ত্রী ও বোনের আহাজারি কোন কিছুই তাদেরকে এই অপকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
ঘটনার পর দুই বছর সময় পার হতে চললো, আজও আরমানের পরিবার জানতে পারেনি সে কোথায় আছে। বিভিন্ন জায়গায় ও আইন শৃংখলা বাহিনীগুলোর কাছে ধর্না দিয়েও তারা আরমানের কোন সন্ধান পায়নি। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে এটাই একমাত্র নয়। গত কয়েক বছরে এরকম প্রায় কয়েকশ ঘটনা ঘটেছে।
আরমানের পরিবার অভিযোগ করেন, মীর কাসেমের ফাঁসি বা আরমানের অপহরনের পরও তাদের বিরুদ্ধে আইন শৃংখলা বাহিনীর হয়রানি থামেনি। এখনও প্রায়শই তাদের বাড়ীতে হানা দেয় আইন শৃংখলা বাহিনী। আরমানের পরিবার আরো জানায়, প্রথমদিকে সরকার বলতো যে, মীর কাসেমের ফাঁসিকে বিলম্বিত করার জন্যই পরিবার আরমানের নাটক মঞ্চস্থ করছে। অথচ সেই ফাঁসি হওয়ারও দুই বছর পার হতে চললো, আজও আরমান বাড়ি ফেরেনি।
আল জাজিরা এই ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেও তিনি এই ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
২০১৩ সাল থেকে বিরোধী দলীয় প্রায় শতাধিক নেতাকর্মীকে একইভাবে গুম করা হয়েছে বলে বিরোধী পক্ষ অভিযোগ করে আসছে। তাদেরকে অপহরন করেই অজ্ঞাতনামা স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের আর কোন খোঁজ কেউ পায়না।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিন এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মিনাক্ষী গাংগুলী এই প্রসংগে জানান, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে গোপন আটক ও গুমের ঘটনা আশংকাজনকভাবে বেড়ে গিয়েছে। এদের কাউকে কাউকে হয়তো সপ্তাহ বা মাসখানেক পরে পাওয়া যায় আবার অনেককে পরবর্তীতে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এর হিসেবে ২০০৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৪১৪ জন ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন যাদের প্রত্যেকেই গুমের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের বিশেষ আইন শৃংখলা বাহিনী র্যাবের বিরুদ্ধেই এই ধরনের গুমের অভিযোগ বেশী তোলা হয়। ২০১১ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে বলা হয় র্যাবের বিরুদ্ধে কাস্টডিতে বন্দী হত্যা করার যে পরিমান অভিযোগ এসেছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। যদিও আল জাজিরা র্যাব এর মিডিয়া উইং এর পরিচালক মুফতি মাহমুদ খানের সাথে আলাপ করলে তিনি বলেন র্যাবের বিরুদ্ধে আনীত এই সব অভিযোগই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
সেপ্টেম্বর ২০১৬ তে ব্যারিস্টার আরমানের পরিবার বৃটিশ আইনজীবি ও মানবাধিকার কর্মী মাইকেল পোলাককে আরমানের মুক্তির লবিং এর জন্য নিয়োগ দেয়। পোলাকের সাথে আল জাজিরা যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আরমানের নিখোঁজ ও মুক্তি বিষয়ে তিনি লেবার পার্টি চেয়ারম্যান জেরেমি করবিন এবং একই দলের এমপি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আপন বোনের মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিককে বেশ কয়েক দফা চিঠি লিখেছেন। তবে তাদের কাছ থেকে তিনি এখনো কোন উত্তর পাননি। কমনওয়েলথ দেশগুলোরও বেশ কয়েকবার দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সার্বিক নিষ্ক্রিয়তায় পোলাক হতাশাও ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এর আগে নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আসলে কমনওয়েলথ সেসব দেশের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশের ব্যপারে তারা এখনো হাত গুটিয়ে বসে আছে।
আরমানের মত একইভাবে গুম হয়েছেন জামায়াতের আরেক শীর্ষ নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আমান আজমী। তিনি গুম হয়েছেন ২০১৬ সালের ২২ আগষ্ট। আজ অবধি তারও কোন সন্ধান পায়নি তার পরিবার।
তার ভাই লন্ডন প্রবাসী সালমান আযমী জানান তারা এখনো আমান আজমীর জন্য উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে তাদের বৃদ্ধা, অসুস্থ মা আমানের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এখন তার শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়েছে।
দু:খজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশ সরকার বরাবরই এই অভিযোগগুলোকে অস্বীকার করেছে।
আলজাজিরার প্রতিবেদনটির লিংক: Without a trace: Enforced disappearances in Bangladesh