প্রধানমন্ত্রীর একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীর সাথে সাক্ষাত্কারে প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি সম্পৃক্ততার দিকেই ইঙ্গিত করে। বর্তমান সরকারের আমলে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক শত শত লোককে গুম করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বিরোধী দলের সাথে জড়িত।
ডেভিড বার্গম্যান, লন্ডন: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদল দমনের অংশ হিসেবে দেশের গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক অপহরণ ও গুমের অনুমতি প্রদান করেছেন।
বলা হয়ে থাকে শেখ হাসিনা দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত দুইজনকে বেআইনি ভাবে তুলে নেয়ার ছাড়পত্র দিয়েছিলেন যাদেরকে মাসের পর মাস ধরে গুম করে রাখা হয়েছে। এমনকি গুমের ২০ মাস পরেও তাদের একজনের ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এইসব গুমের ঘটনাগুলোর কারণে মানবাধিকার সংগঠনগুলো কর্তৃক সমালোচিত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ শত শত লোককে গুম ও অপহরণ করেছে যাদের বেশির ভাগই বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো, এদের মধ্যে অনেকেই লাশ হয়ে ফিরে এসেছেন অথবা কখনোই ফিরে আসেননি।
গত বছরের শুরুর দিকে গুম ও স্বেচ্ছায় আত্মগোপনের উপর কর্মরত জাতিসঙ্ঘের একটি দল ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে ক্রমবর্ধমান গুমের ঘটনা বন্ধ করতে আহ্বান জানায়।
২০১৭ সালের শেষে, বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘অধিকার’ বিগত দুই বছরে ১৮০ টি গুমের ঘটনা চিহ্নিত করে যাদের মধ্যে ২৮ জনকে পরবর্তীতে মৃত পাওয়া যায় এবং ২৫ জন একেবারেই অজ্ঞাত থেকে যায়।
এদিকে প্রথমবারের মতো শেখ হাসিনার একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীর সাথে সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তথ্য থেকে গুমের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি জড়িত থাকার ইঙ্গিত রয়েছে। কোন ধরণের গুমের সাথে সরকার জড়িত নয় মর্মে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এর লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশের পরেই এ তথ্য উদঘাটিত হয়।
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ‘দ্যা ওয়্যার’ ডিজিএফআই কর্তৃক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুবাশ্বের হাসানকে অপহরণের সংবাদ প্রকাশ করে। এরপর বাংলাদেশ সরকার ‘দ্যা ওয়্যার’ এর ওয়েবসাইটটিকে বাংলাদেশে বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে হাসান ছয় সপ্তাহ পর মুক্তি পান।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সেই রাজনৈতিক সহযোগী বলেন, ব্রিটিশ-প্রশিক্ষিত ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমকে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের সামনে ঢাকায় তার বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে তার মায়ের ভাষ্য মতে রাস্তায় গাড়ী থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০১৬ সালের আগস্টে ডিজিএফআই প্রধানমন্ত্রীকে সরকার উৎখাতের গোপন ষড়যন্ত্রের বানানো গল্পে তাদের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করলে তিনি এই দুইজনকে গুমের অনুমতি প্রদান করেন।
নাস্তিক ব্লগারদের ধারাবাহিক হত্যাকান্ডের পরে রাজধানী ঢাকায় একটি রেস্টুরেন্টে আইএসআইএস এর মদদপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় ২০ জন নিহত হওয়ার পর ছয় সপ্তাহ পরে এই দুইজনকে অপহরণ করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার সেই সময়ে বিরোধী দলগুলোর উপর এই হামলার দায় চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলো।
তিনি আরো বলেন, “আমার মনে হয় গোয়েন্দা বাহিনী প্রধানমন্ত্রীর সামনে নিজেদের বড়ত্ব ও গুরুত্ব জাহির করার জন্যেও এমনটা করে থাকতে পারে। এমনটা তারা মাঝে মাঝেই করে থাকে।
আরমান বিন কাসেম হলেন জামায়াত-ই-ইসলামীর এক নেতার পুত্র যাকে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অপরদিকে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর বাবা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর একজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন, ১৯৭১ সালে সংঘঠিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে তারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
যদিও গুম হওয়ার সাত মাস পরে হুম্মাম চৌধুরীকে ঢাকার রাস্তায় মুক্তি দেয়া হয়, আরমান বিন কাসেম এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এদিকে হুম্মাম চৌধুরী ও তার পরিবার তাদের এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।
প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলেন, “হুম্মাম চৌধুরীকে প্রথমে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার হেফাজতে রাখা হয়, কিন্তু পরে বিন কাসেমকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর উভয়কে ডিজিএফআই এর কাছে হস্তান্তর করা হয়”।
বিশেষ করে হুম্মাম চৌধুরীর ব্যাপারে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “তার (প্রধানমন্ত্রীর) অনুমোদন ছাড়া তারা তাকে তুলে নিতে পারত না” এবং “অবশ্যই” শেখ হাসিনা এটা জানতেন যে তাকে (হুম্মাম চৌধুরীকে) আটক রাখা হচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সহযোগী আরো বলেন, “এই পুরো ব্যাপারটি এমনভাবে ঘটেছে যে আপনি সরকার, প্রধানমন্ত্রী অথবা সরকারের অন্য কাউকে এর সাথে জড়িত বলে অভিযোগ করতে পারবেন না”।
মীর কাসেমের পক্ষের যুক্তরাজ্যের আইনজীবী মাইকেল পলক বলেন, “এটি অকাট্য যে, আরমানের এই পরিনতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হাত রয়েছে এবং তিনি চাইলে একদিনের মধ্যে তাকে ফিরে পাওয়া সম্ভব”। আরমানের বোন তাহেরা তাসনীম বলেন, “আমাদের পুরো পরিবার তার জন্য দুশ্চিন্তায় বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা তাকে ফিরে পেতে চাই। ”
সেই রাজনৈতিক সহযোগী এটাও জানান যে, ব্রিটিশ বাংলাদেশী হাসনাত করিম এবং কানাডীয়-বাংলাদেশী শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খানের গোপন আটক সম্পর্কে এক মাস আগেই শেখ হাসিনা জানতে পেরেছিলেন। এ দুইজন ২০১৬ সালের জুলাইতে হোলি আর্টিসানে সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িত ছিলেন বলে সন্দেহের তালিকায় ছিলেন। উক্ত রাতে তারা ঐ রেস্টুরেন্টে ছিলেন। পরে তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করা হয়। সেই থেকে হাসনাত করিম বিনা অভিযোগে ও বিনা বিচারে কারাগারে আটক আছেন।
আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই
বিশ্লেষকরা বলছেন যে প্রধানমন্ত্রীর জড়িত থাকার ব্যাপারে ঐ সহযোগীর অভিযোগ অপ্রত্যাশিত নয়।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের বাংলাদেশী মুখপাত্র মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, “গোপন আটক ও গুমের অনুমতি প্রদানে প্রধানমন্ত্রীকে জড়িত করে যে সব বক্তব্য দেয়া হচ্ছে সে বিষয়ে আমি মোটেই অবাক নই।” তিনি বলেন, এই সব ঘটনায় তাদের তদন্ত ও তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন আশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের তদন্তে এটা প্রমান করে যে বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত বড় বড় ব্যক্তিকে গুমের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরাসরি জড়িত ছিলেন।
চ্যাথাম হাউস এশিয়া প্রোগ্রামের সহযোগী ফেলো চারু লতা হক এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “বিচার বহির্ভুত মৃত্যুদণ্ড এবং গুমের দৌরাত্ম্য অব্যাহত রয়েছে। এই নতুন অভিযোগগুলোতে আশ্চর্যের কোন বিষয় নেই এজন্য যে, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন গুলোর নথি থেকে এই সব কুকর্মে রাষ্ট্রের সহযোগীতার প্রমান রয়েছে।
বারবার অনুরোধ করার পরেও শেখ হাসিনা এ অভিযোগের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সেই রাজনৈতিক সহযোগী আরো বলেন যে, আধাসামরিক বাহিনী, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), পুলিশের গোয়েন্দা শাখা, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট এবং ডিজিএফআই এর বিশেষ শাখাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা অনেক নাগরিককে তুলে নেয়ার ও গুম করা বা গোপনে আটক রাখার সাথে জড়িত রয়েছে।
“প্রথমে তারা একাজে র্যাবকে ব্যবহার করত। এরপর র্যাবের কুকীর্তি ছড়িয়ে পরার পর তারা ডিবিকে একাজে লাগায়। তারাও র্যাবের মত সেই কথিত বন্দুকযুদ্ধ শুরু করে। আর তারা এটা করে অনুমতি প্রাপ্ত হয়েই। সুতরাং র্যাব ও ডিবির কাজের মধ্যে মূলত কোন পার্থক্য নেই” ।
“দূর্ভাগ্যবশত, হুম্মাম ও আরমানের ক্ষেত্রে এই কাজটা শুরু করেছে ডিজিএফআই। এটাই পার্থক্য, যা আসলে তাদের কাজের আরেকটি ভিন্ন ধরণ”।
২০০৯ সালে বিশাল ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। কিন্তু এরপরে বিএনপি ও জামায়াত-ই-ইসলামীসহ বিরোধীদল কর্তৃক বর্জিত বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। এ বছরে নতুন নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। বিশ্লেষকরা এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
দ্যা ওয়্যারের প্রতিবেদন লিংক: Sheikh Hasina Complicit in Secret Detentions by Bangladesh Intelligence, Says Source
(ভারতের ‘দ্যা ওয়্যার’ পত্রিকায় প্রকাশিত ডেভিড বার্গম্যানের লেখা প্রতিবেদন। ভাষান্তর করেছে অ্যানালাইসিস বিডি।)